রতন কুন্ডু । ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
যদুমাস্টার এর সাতকুলে কেউ আছে বলে মনে হয়না। কুন্ডু বাড়িতে তার পাঠশালার বয়স একযুগ পার হয়েছে। হাছন করিকর একজন গয়াল। ফসলের মৌসুমে তার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ফসল কাটার
আগেই টরকী বন্দরে গিয়ে সে মেয়েদের চুড়ি, মাকরি, আলতা স্নো থেকে যাবতীয় প্রসাধনী কিনে নিয়ে আসে। তার সাথে বসতবাড়ির নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ। যেমন গামছা, লুংগী, কইরা প্লেট, বাটি, চামচ ইত্যাদি তার বাঁশের চটি দিয়ে তৈরী দুটি ঝাঁকায় পূর্ণ করে। রশি দিয়ে অপেক্ষাকৃত মোটা বাঁশের ধনুকাকৃতি ভাড় এর দুপাশে ঝুলিয়ে দুর দুর গাঁয়ে ফেরি করতে যায়। ছেলে মেয়েদের
জিজ্ঞেস করলে বলে-
-আব্বা গাঁওয়ালে গেছে। গাঁওয়াল হল একজাতীয় পণ্য বদলের ব্যবসা। গাঁয়ের মেয়ে, মহিলাদের কাছে কখনই টাকা পয়সা থাকতনা। তাই ফসল কাটার মৌসুমে তারা পর্যাপ্ত চাহিদা মোতাবেক ধান দিয়ে নিজেদের পছন্দের সাজানী, হাড়ি , পাতিল ,বাসন কোশন কিনে নিত। পূরাকালে যখন অর্থের প্রচলন ছিলনা তখন পন্য বদলই ছিল কেনা কাটার একমাত্র অবলম্বন। ফরাসী, ব্রিটিশ ও পর্তুগীজ বেনিয়ারাও তাদের লোভনীয় পণ্যসামগ্রী পালের জাহাজে করে দেশ-দেশান্তরে ব্যবসা করে বেড়াত। হাছন কারিকর প্রচন্ড পরিশ্রমী একজন মানুষ। শীতকালে খেজুর গাছ, তাল গাছের রস পেড়ে মালিককে আধা ভাগ দিয়ে বাকিটা বাড়ি এনে জ্বাল দিয়ে পাটালী গুড়, মুচি গুড় তৈরী করে হাটে বিক্রি করত। ফসল বোনার সময় জমিদারদের ক্ষেতে কামলা দিত। জীবনের কোন এক পর্যায়ে জোবেদা খাতুন নামে এক অনাথ ফুলপরীকে বিয়ে করে নিজের ঝুপড়ি ঘরে সংসার পাতে।
দেখতে দেখতে আলাল, বেলাল, খাদিজা আর ফাতিমা নামে আরও চারজন সে পরিবারে সামিল হয়। যখন গাওয়াল থাকেনা, ক্ষেতিবাড়ির কাজ থাকেনা, কিংবা গাছের রস শুকিয়ে যায়, তখন কুন্ডুদের সাথে হাটে যায়। গন্জের হাটে যেতে নৌকা লাগে। পণ্য বোঝাই নৌকা চালানোর দায়িত্ব হাছনের।
রাতে একবেলা পেটভর্তি খাবার ছাড়াও নগদ কুড়ি টাকা পায়। এভাবেই হাছন ক্রমে ক্রমে কুন্ডু বাড়ির একজন সদস্য হয়ে যায়। গাঁওয়ালে গেলে হরেক কেছেমের হরেক রংএর মানুষের সাথে পরিচয় হয়। এমনি করেই পরিচয় হয় প্রত্যন্ত বিলাঞ্চলের এন্ট্রান্স ফেল ভবঘুরে যুবক যদুনাথ হালদার এর সাথে। পিতৃমাতৃ হীন, সহায় সম্বলহীন যদুনাথ, হাছন এর চলার পথে সংগী হয়। হাছন এর নিজেরই মধুসূদন অবস্থা, যদুনাথকে রাখবে কোথায়? খাওয়াবে কি? নিতান্ত নিরূপায় হয়ে ইন্দ্রভূষণ কুন্ডু বাবুর শরনাপন্ন হয়।
-কর্তা, ছেইলাটা শিক্ষিত। এন্ট্রান্স ফেল। আপনাদের পোলাপাইনগুলা মানুষ অইয়া যাইব। সেই থেকে যদুনাথ এ বাড়িতেই আছে। পাঠ বিষয়ে তার যে অবাধ জ্ঞান তা দুদিনের মধ্যেই সবাই টের পেয়ে যায়। শুধুমিাত্র গণিত নয়, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, সনাতন ধর্ম সব বিষয়ে তার পান্ডিত্য প্রকাশ পায়।
ইন্দ্রভ’ষণ কুন্ডুর বোন সুখীর বিয়ে হয়েছে এ বছর। সুখীকে বিয়ে দেয় বানারীপাড়ার এক ধনাঢ্য পরিবারে। বিরাট ব্যবসায়ী পরিবার। আটচল্লিশা বন্দ বসত বাটি। এখানে বলে রাখা ভাল দেশী হিসাবে ঘরের জায়গার পরিমাণ ও চালার হিসাব অনুযায়ী তাকে বিভাজন করা হয়েছে ২৪, ৩২, ৩৬, ৪০, ৪৪ ও ৪৮ শা বন্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। শুধুমাত্র জমিদার কিংবা হাওলাদার বাড়িতে দু একটা ৫৬ বন্দ ঘর দেখতে পাওয়া যেত। একান্নবর্তী পরিবার হওয়ার কারণেই ঘরের আকার এত বড় হতো।
যাই হোক, শুকীর বিয়ের পরে ছোট বোন সোনাই একা হয়ে যায়। সোনাই দেখতে ছিল পাকা কলার মত সুন্দর, হলদে রঙের ডাগর শরীর, ভেতরটা কলার মতই নরম, গাল বুক ও পিছনের পেলব অংশগুলো দিনকে দিন বড় হচ্ছে আর সোনাইর চলন, বলন, কথা বলার ভংগী, অহেতুক খিল খিল হাসি বলে দেয় সোনাই সাবালিকা হয়েছে। দুপুরে সবাই যখন মধ্যহ্ন ভোজনের পরে একটু ভাতঘুম দেয় সোনাই তখন জলপাই কুড়াতে যায়। যদুনাথ জানে সোনাই এখন দিঘীর পাড়ে জলপাই গাছের নীচে। নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা সামনের আড়া থেকে গামছাটা কাঁধে ফেলে খালি গায়ে দিঘীর পাড় বনৌষধি খুজতে যায়। তার ঈগল চোখে- রায়ট পাতা, ভাটগাছ, ঢেকি শাক, খারকোল পাতা, গন্ধ ভাদালে পাতা খেলা করে সোনাইর চাপা হাসি পাতার খসখস শব্দ ছাপিয়ে দিঘীর জলে তরঙ্গ ওঠে-
-মাস্টারমশাই এই ভর দুপুরে জংগলে কি খোজেন? যদুনাথ লজ্জিত হয়। গামছা দিয়ে শরীরটা আধ ঢাকা করে নেয়। নাকি সুরে তোতলাতে তোতলাতে বলে -ঔষধি গাছ খুজতে আইলাম। জানো সোনাই সৃষ্টিকর্তা এই জংগলের মধ্যেই মানুষের যাবতীয় রোগের নিরাময়ের জন্য গাছালী তৈরী কইরা রাখছেন। যে চিনতে পারে, যে ব্যবহার জানে সে হল বড় কবিরাজ। সোনাই ফোড়ন কাটে,
-তা, এই মাঝদুপুরে আপনে কি বনাজী খুজতে বার হলেন! আপনার কি অসুক অইচে? যদুনাথের বুকের ভেতর মাদল বাজে। যে কথা এতোদিন বলা হয়নি। আজকে তা প্রকাশ করার অপূর্ব সুযোগ এসেছে।
সুনসান দুপুরে দিঘীর পাড়ে জলপাই গাছের নীচে দুজন মানব মানবী। দুষ্টু বাতাস তাদের গায়ে হালকা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, পাখীরাও খানিকটা বিশ্রাম নিচ্ছে, গাছের পাতার চোখ ফাঁকি দিয়ে সূর্যের দৃষ্টি সোনাইর গালে আছড়ে পরে। শাড়ীর বাঁধন আলগা হয়। বুকটা হাপরের মত ওঠাবসা করে। এক দুর্নিবার আকর্ষণে যদুনাথ চুম্বকের মত আকৃষ্ট হয়। আগুনের শিখা যেমনি পতঙ্গঁ আকৃষ্ট করে এবং পতঙ্গঁ কিছু না বুঝেই সে আগুনে ঝাপ দিয়ে মারা যায়। যদুনাথের আজ মরতে ইচ্ছে করছে ৷ সোনাই নামক এক অগ্নিপিন্ডের মধ্যে ঝাপ দিতে ইচ্ছে করে। মৃত্যুভয় পরাজিত হয়। যদুনাথ ঝাপ দেয়। অবাক হয়- আগুনে তার সর্বাঙ্গঁ পুড়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে হাত, মুখ, ঠোট, গাল, বুক, পিঠ, নিতম্ব, উরু, চিন্তা, ভাবনা, চেতনা, অনুভব, সব পুড়ে যাচ্ছে। এযে সুখের আগুন !
পুড়ে পুড়ে এক সময় নিঃশেষ হয়ে যায়।
সোনাইর চোখে জল।
-মাস্টার মশাই, কেন করলেন? কেন কেন কেন? আজ আমি কলংকীনি হইয়া গেলাম। আমারতো নরকেও ঠাই হবেনা। যদুনাথ সস্নেহে বলে
-কিছু ভাইবোনা। আমি চিরদিন তোমার দেবদাস হইয়া থাকব। তোমার কলংক আমি আমার নিজের ছায়া দিয়ে সারাজীবন ঢেকে রাখব। সোনাই নিজেকে সম্বরণ করতে পারেনা। যদুনাথের বুকে ঝাপিয়ে
পরে কান্নায় ভেঙে পরে।
কচা নদীটা এককালে প্রবল খরস্রোতা ছিল। অনেক মাছের বাস ছিল। জেলেদের নৌকা ভরে যেত একসময়। মহাজনী নৌকা পাল তুলে দুর বন্দরে যেত। একতলা-দোতলা লঞ্চ ভেপু বাজিয়ে ঢেউ তুলে
চলে যেত। আজ কচানদী শুকিয়ে গেছে। লঞ্চ ট্রলার চলা বন্ধ হয়ে গেছে। কচা নদীতে বাতাস কোন ঢেউ তোলেনা। সোনাইকেও বিয়ে দিয়েছিল সেই বড়বোনের শ্বশুরের বাড়িতে। যদুনাথ কোন প্রতিবাদ
করতে পারেনি। সোনাই মানা করেছিল। কিন্তু প্রতিদিন রাতে শোওয়ার সময় যদুনাথের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। তারপরও কোন এক মায়ায় কুন্ডু বাড়ি ছেড়ে যেতে পারলনা। বাচ্চাদের পড়ায় আর
বনৌষধি খোজ করে। জলপাই গাছের নীচে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
বছর না ঘুরতেই সুকী- সোনাই দু বোনই বাপের বাড়িতে চলে আসে। পড়নে চিকন পাড়ের শাদা শাড়ী, অলংকারহীন হাত, গলা, কান, নাক, খালি পা। কুন্ডু বাড়িতে মরা কান্না শুরু হয়। বসন্ত মহামারীতে
মা-শিতলা দুবোনের স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। মাংগলিক অপবাদ দিয়ে ভাতার খাগী, কামেশ্বরী, ডাইনি উপাধি গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ির লোকজন দুবোনকে তাড়িয়ে দিয়েছে। যদুনাথ কান্নার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে খালপাড় গিয়ে থপ করে বসে পরে। মাংগালিক নামটা কত সুন্দর অথচ এরা কত কুৎসিৎ অর্থে সেটা ব্যবহার করে। যেসব মেয়েদের বিয়ের এক বছরের মাথায় স্বামীর মৃত্যু হয় তাদের মাংগলিক বলে। গ্রাম্য বাংলায় বলে ভাতারখাগী। যদুনাথ বিশ্বাস করেনা। তাইলে তো তার আরও অনেক আগেই মারা যাওয়ার কথা ছিল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক হয়েছে আর না। সে সোনাইকে নিয়ে দেশান্তরী হবে।
< Prev | Next > |
---|