আজাদ আলম
সব কিছুরই শুরু আছে। তেমনি অস্ট্রেলিয়ায় বাংলা পত্রিকা প্রকাশনার ধারা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে।
১৯৭৯ সালের কথা। সিডনিতে বাংলাদেশি পরিবারের সংখ্যা ছিল সাকুল্যে চল্লিশ বা পয়ঁতাল্লিশ । এর বিরাট অংশ ছিল উচ্চ শিক্ষার জন্য আসা ইউনিভার্সিটির ছাত্র, কম্পিউটার প্রফেশনাল অথবা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক।। এই সালের জুন মাসে সিডনিতে যোগ হয় এক দল তরুণ দামাল ছেলে। চার বছর মেয়াদের বিমান প্রকৌশলীর প্রশিক্ষণ নিতে আসে এরা । সদ্য দেশ থেকে আসা এদের জন্য সিডনির বাঙ্গালীরা যেন অপেক্ষাই করছিল। পরিকল্পনা, এই সমস্ত ছেলেদের নিয়ে দেশি সংস্কৃতির চর্চা জোরদার করা যায় কিনা। উইকেন্ড এ খেলাধুলা এবং বাংলা স্কুল চালু করাটাও তাঁদের প্লানে ছিল এদেরকে নিয়ে।

উৎসাহের কমতি হলো না কোন পক্ষেরই। বিমানের এই ছেলেরা যেমন পেল বড় ভাই ভাবী সম তুল্য প্রিয় জন, অভিভাবক তেমনি স্বজন ছেড়ে আসা এই পরিবারগুলোও কাছে পেল যেন ছোট ভাইদেরকে। পেল আদর আপ্যায়ন করার বাড়তি আনন্দ।

প্রায় সব উইকেন্ডেই তখন সবার ব্যস্ততা। হয় বাংলা স্কুলের চত্বরে, অথবা কুইন্স পার্কের ক্রিকেট মাঠে নয়ত বা কোন নাটক, গানের রিহার্সালে। সবার মুখে এক কথা। আমরা দেশের বাইরে এসেও দেশের সাথে বেশ যুক্ত হয়ে গেলাম।

বাকি ছিল বাংলা পত্রিকার। সেটাও বাকি থাকে কেন। সামনেই ষোলই ডিসেম্বর। নিদেন পক্ষে একটা দেয়াল পত্রিকা তো বের করা যায়। দায়িত্বটা আমার ঘাড়ে এসে পড়লো বন্ধুদের পিড়াপিড়িতে । গান গাইতে পারি না। ক্রিকেট খেলাতেও তথৈবচ। লেখাপড়া ছাড়া বাড়তি যে টুকু পারতাম তা টুকটাক, মনের খোরাক লেখালেখি । এর খেসারত স্বরুপ ভাগে পেলাম পত্রিকা প্রনয়ণ । আমাকে দেয়াল পত্রিকা বের করতে হবে। হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা।

এও কি সম্ভব! বিদেশ বিভুঁইতে অল্প সময়ে স্বল্প সম্বল নিয়ে দেয়াল পত্রিকা বের করা! কলেজে দেখেছিলাম সহপাঠি মোরশেদ (আন্তর্জাতিক খ্যাত স্বল্প দৈর্ঘ্য চল চিত্র “আগামি”র নির্মাতা) কি না কষ্টটাই করেছিল দেয়াল পত্রিকা বের করতে। লেখা সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাচাই বাছাই আঁকা আঁকি, কত কিছু। সব যেন তারই মাথা ব্যাথা।

এগিয়ে আসলো বন্ধু আতাউল কবির এবং নওশের আলি। (দুজনেই বর্তমানে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার)। ঝকঝকে তকতকে হাতের লেখা কবিরের । নওশেরের তুলির আঁচরে ( আসলে সাইন পেন!) ফুটে উঠল শাপলা ফুল। পত্রিকার নাম দেয়া হলো “শাপলা”।

এক রাতেই বেরিয়ে আসল আমাদের শাপলা। একেই বলে, “তারুণ্যের তেজী সাজ, যেই কথা সেই কাজ।“ ৭৯ সালের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান। স্থান, র্যা ন্ডউইক কমুনিটি সেন্টার, বান্ডক স্ট্রিট। সেন্টারের দরজার সামনে সাটিয়ে দেয়া হলো সারা রাত জাগার ফসল, প্রিয় জাতীয় ফুল শাপলা।

সে দিনের সেই ছোট অনুষ্ঠানের এই দেয়াল পত্রিকা সংযোজন ছিল বড় ভাইদের কাছে অপ্রত্যাশিত পাওনা। চমকিত এবং সেই সাথে আনন্দিত বটে! পাওয়া গেছে লেখক, প্রকাশক সম্পাদক চিত্রশিল্পী সবই। গামা ভাই, মোখলেসুর ভাই, শাহাদত ভাই, আলমগীর ভাই, মোস্তফা ভাই, ব্যারিস্টার সালাহ উদ্দিন ভাই সহ আর কিছু ভাইদের তখন নতুন প্রত্যাশা। বাংলা পত্রিকা বের করি না কেন আমরা। দেশের কিছু খবর এবং এখানে আমরা যা কিছু করি সেগুলো খবরের আকারে বের করি বাংলা পত্রিকায়।

তখন দেশের খবর সংগ্রহের রাস্তা ছিল সীমিত। নতুন কেউ আসলে সাথে নিয়ে আসতেন কিছু সাপ্তাহিক বিচিত্রা অথবা সাপ্তাহিক রোববার এবং দু তিন দিনের বাসি খবরের কাগজ। আর সম্বল ছিল বি বি সি এবং ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা প্রোগ্রাম। কিন্তু বড় ভাই ভাবীদের জোর দাবি এক মাসে না হোক দুই মাসে না হোক অন্তত তিন মাসে হলেও একটা পত্রিকা দরকার।

কিন্ত কিভাবে? মাল মসল্লা নাই, কোন অভিজ্ঞতা নেই , নেই কোন বাংলা টাইপ রাইটার। যাকে বলে, “ঢাল নাই তলোয়ার নাই, নিধি রাম সর্দার।“ এই এত কিছু নাই এর মধ্যেই সম্বল ছিল সেই দিপ্তিময় তারুণ্য, যাদের কাছে সব সমস্যাই নগণ্য।

টার্গেট, ১৯৮০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী। বের করতে হবে বাংলায় প্রথম ত্রৈমাসিক পত্রিকা, শাপলা।

আগেই বলেছি সিডনিতে বাংলাদেশি কমিউনিটি ছিল ছোট কিন্তু তাতে কি আসে যায়? আমাদের আসার আগে থেকেই মন প্রান উজার করে দিয়ে ঠিকই বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারী এবং স্বাধীনতা দিবস পালন করে আসছেন এনারা নিয়মিত। বাঙ্গালী যেখানে যায়, সেখানেই যেন সাথেই নিয়ে যায় গোটা বাংলাদেশকে। পত্রিকার বের করার ব্যাপারেও একই রকম সাড়া পাওয়া গেল। অনেক ভাই ভাবী এগিয়ে আসলেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। মোজাফফর ভাবী আনলেন চিকেন বিরিয়ানি রান্নার রেসিপি, মহুয়া ভাবী দিলেন বিয়েতে কিভাবে সাজবেন তার টিপস,বিশাল ফিরিস্তি। গামা ভাই সাপ্লাই দিলেন অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন বাৎসরিক কার্যক্রমের তালিকা এবং সেই সাথে হাই কমিশনের সাথে যোগাযোগের ঠিকানা।দেশের কিছু অতি প্রয়োজনীয় বদলের খবর জানালেন আনিস ভাই ( ভয়েস অফ আমেরিকা থেকে পাওয়া)। দেশের খেলার খবর সংগ্রহ করে দিলেন বন্ধু ফজলে রহমান ( বর্তমানে মালয়েশিয়া প্রবাসী), সংস্কৃতির খবর যোগার করে দিলেন তঔফিক ইমাম ( বর্তমানে কানাডা প্রবাসী , পরবর্তীতে এর পরিচালনায় অস্ট্রেলিয়ায় রেডিও 2EW থেকে প্রথম বাংলা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। সাথে ছিলেন মহুয়া ভাবি এবং বন্ধু মুহিবুল আলম ) আমার এবং নওশেরের কবিতা , ছোটদের জন্য কুইজ কর্নার নিয়ে বের হয় সবার কাংখিত দশ পাতার হাতে লেখা শাপলার প্রথম সংখা।

শাপলা পত্রিকার অনুলিপি মাত্র

চল্লিশ কপি বিলি বণ্টন করি একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে । শাপলা এভাবেই প্রকাশিত হতে থাকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। আমরা কোর্স শেষে চলে যাবার পরেও শাপলা পত্রিকা প্রকাশিত হয় মাঝেমধ্যে ।
বাংলাদেশীদের অভিবাসনের সংখ্যা বাড়তে থাকে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে অনেক লেখক, সাহিত্য অনুরাগীর দের সংখ্যাও । পরবর্তীতে সিডনিতে এসে শুনেছি প্রিন্ট আকারেও বের হয়েছিল শাপলা আশির দশকের সেষ ভাগে। সম্পাদনায় ছিলেন জনাব আশিষ বাব্লু।
অস্ট্রেলিয়ায় বেড়েছে বাংলাদেশের বাঙ্গালী। সেই সাথে বহুল পরিমানে বেড়েছে বাংলায় ইন্টারনেট ওয়েব এবং প্রিন্ট মিডিয়া । দেশের এবং এদেশের বাঙ্গালী অভিবাসিদের যাবতীয় খবর এখন একটি আঙ্গুলের ডগায়। স্বাভাবিক কারনেই জন্ম নিল অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল। প্রত্যাশা করি এই সংগঠনের সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলা পত্রিকা প্রকাশনার সার্বিক মান উচ্চ আসনে আসীন হবে।

নিচে সেই সময়ের কিছু কর্মকান্ডের ছবি।

১৯৮১ সালের বার্ষিক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।

 সেন্টিনিয়াল পার্কের পাশের কুইন্স পার্কে ক্রিকেট খেলার দৃশ্য ১৯৭৯

সাম্প্রতিক