নাইম আবদুল্লাহ:
পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালী জাতির প্রাণের উৎসব। এদিন থেকেই শুরু হয় বাংলা সনের গণনা। বাঙ্গালী তার নিজস্ব জাতি সত্ত্বার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য যতগুলো উৎসব পালন করে তার মধ্যে বৈশাখ বরণ অন্যতম । বৈশাখ বরণের সাথে যে অনুষ্ঠানটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তা হল বাঙ্গালীর ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা।
বৈশাখী মেলা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যাত্রা, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, জারি-সারি, গম্ভীরা কীর্তন, পালার আসর, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠি ও হাডুডু খেলার কথা। সেই সাথে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগসূত্র।
গত ৮ই এপ্রিল (শনিবার) পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু পরিষদ সিডনি অস্ট্রেলিয়া সিডনির টেম্পি পার্কে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালী কমিউনিটির প্রানের মেলা ঐতিহ্যবাহী 'বৈশাখী মেলা'র আয়োজন করে।
সিডনির এই বৈশাখী মেলা যেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙ্গালী ও অন্যান্য ভাষা-ভাষীদের এক মহামিলন মেলা। বঙ্গবন্ধু পরিষদ সিডনি, অস্ট্রেলিয়া গত ১৫ বছর ধরে সিডনিতে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে আসছে। টেম্পি রিজার্ভের একই ভ্যানুতে এই মেলা ছিল তাঁদের ১১তম আয়োজন।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ সিডনি অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ সম্পাদক এবং মেলা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক গাউসুল আজম শাহাজাদা জানান, অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা বাঙালী প্রজন্মকে জাতির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও এর ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াই এই মেলার প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি বলেন অলাভজনক এই মেলাটি আমার একার নয়, অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসি সকলের। প্রবেশ মূল্যহীন এই ঐতিহ্যবাহী 'বৈশাখী মেলা'র প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে মেলায় আগত দর্শকগণ।
এবারের মেলা প্রাঙ্গণ দর্শক-অতিথিতে ছিল কানায় কানায় পূর্ন। শুধু অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙ্গালীরাই নয়, অন্যান্য ভাষা-ভাষীর অতিথিদের উপস্থিতিও ছিল উল্লেখযোগ্য।
সিডনির দূর দূরান্ত ছাড়াও ক্যানবেরা, মেলবোর্ন থেকেও মেলায় অগনিত দর্শকদের সমাগম ঘটে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে প্রবীনরাও বৈশাখী সাজে সজ্জিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন এ মেলাতে। মেলা প্রাঙ্গণে মুখরোচক দেশীয় খাবার নিয়ে পাটি বিছিয়ে অনেককে খেতে দেখা যায়। “মেরিকভিলের টেম্পি রিজার্ভ নয়, এ যেন এক বাংলা মায়ের কোল”।
অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কাজী ইমতিয়াজ হোসেন এই ঐতিহ্যবাহী 'বৈশাখী মেলা'র শুভ উদ্ভোধন করেন। ড. মাসুদুল হকের সভাপতিত্বে এবং অস্ট্রেলিয়া আওয়ামিলীগের সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবি সিরাজুল হকের উপস্থাপনায় আলোচনা পর্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন, নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেট পারলামেন্টের ল্যাকেম্বা আসন থেকে নির্বাচিত এমপি জিহাদ দিব, ক্যানটারবেরি সিটি কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি মেয়র ও কাউন্সিলর কার্ল সালেহ, ম্যারিকভিল সিটি কাউন্সিলের সাবেক মেয়র স্যাম ইস্কান্দার, ক্যাম্বেলটাউন সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলের মাসুদ চৌধুরী, স্টেইথফিল্ড সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলর রাজ দত্ত, অস্ট্রেলিয়া আওয়ামিলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদ্যুৎ সিং চুন্নু, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ প্রেস অ্যান্ড মিডিয়া কাউন্সিল'র সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মেদ আব্দুল মতিন, আরটিভি'র এজিএম মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন, ডেপুটি সেক্রেটারী এটিএম কামরুল ইসলাম তালুকদারÂ প্রমুখ।
ঐতিহ্যবাহী এই “বৈশাখী মেলা” প্রাঙ্গণে চারিদিক ঘিরে ছিল বাঙালী খাবার ও দেশীয় পোশাকের নানাবিধ স্টল। খাবারের স্টলগুলিতে ছিল নানা ধরনের মুখরোচক দেশীয় খাবার পুরি, চটপটি, পিয়াজু, হালিম, জিলাপি, সিঙ্গারা বিরানি, রকমারি পিঠা ও মিষ্টি। আর তৈরি পোশাকের স্টল গুলিতে ছিল সালোয়ার কামিজ, জামদানি ও অন্যান্য তাঁতের শাড়ির বিপুল সমাহার। মেলায় বিভিন্ন রকমের রাইড বড় দর্শকদের যেমন গ্রাম্য নাগরদোলার স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে তেমনি ছোট ছোট বাচ্চাদের সারা-বেলা আনন্দে মাতিয়ে রেখেছে। মেলায় নামাজের জন্য তৈরী করা হয়েছিল আলাদা প্যান্ডেল।
এ ছাড়াও সন্জয় টাবুর পরিকল্পনায় এবং মুনা মোস্তফার উপস্থাপনায় বৈশাখী মেলার উম্মুক্ত মঞ্চে ছিল শিশু কিশোর শিল্পীদের অংশগ্রহণে দেশাত্মবোধক গান, ছড়া, কবিতা ও নাচের সুবিশাল আয়োজন। বিকেলে কমিউনিটি বাংলা স্কুলের ক্ষুদে শিল্পীদের একক ও দলীয় মনোরম নৃত্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করা হয়। ক্ষুদে শিল্পীদের নৃত্যে পুরো মেলা প্রাঙ্গণে ছিল মুহূর্মুহু করতালি।
মেলায় লরেন্স ব্যারেলের পরিকল্পনা ও উপস্থাপনায় কবিতা আবৃতিতে অংশ নেন ড. রতন কুন্ডু, আশীষ বাবলু, শাফিন রাশেদ প্রমুখ, ক্যমেলিয়া জেলি প্রমুখ।
মাগরিবের নামাজের বিরতির পর সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত চলে মূল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সবশেষে সিডনির ঐতিহ্যবাহী ব্যান্ড কৃষ্টি তাদের গান পরিবেশন করে মেলার দর্শকদের সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে রাখে। দর্শকদের কাছ থেকে বারবার গানের অনুরোধ আসতে থাকে।
এছাড়াও মেলায় উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ, সিডনি থেকে প্রকাশিত অনলাইন ও পেপার পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকবৃন্দ, লেখক, সাহিত্যিক, কবি ও সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
মেলার আয়োজকরা গত দশ বছর ধরে ম্যারিকভিল সিটি কাউন্সিলের সার্বিক সহযোগিতার কথা গভীর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। মেলাকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য আহ্বায়ক গাউসুল আজম শাহাজাদা সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
মেলায় পার্কিং এর ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। অনেক দর্শকদের পার্কিং না পেয়ে বাসায় ফিরে যেতে দেখা গেছে। দর্শকরা আগামী বছরের মেলায় ম্যারিকভিল সিটি কাউন্সিলের কাছে অতিরিক্ত পার্কিং এর ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মেলার আয়োজকদের প্রতি অনুরোধ করেছেন। টেম্পি রিজার্ভের এই ভ্যানুতে দর্শক সংকুলান না হওয়ায় আরো বড় ভ্যানুতে পরবর্তী মেলা করার জন্যও অনেকেই মেলা কমিটির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
< Prev | Next > |
---|