ctg15স্টাফ রিপোর্টার: চট্টগ্রামের সীতাকু- পৌরসভার লামারবাজার আমিরাবাদের একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে এক নারী জঙ্গিসহ দুইজনকে আটক করেছে পুলিশ।

ওই দুই জঙ্গির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কলেজ রোড এলাকার চৌধুরীপাড়ার আরেকটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।

বুধবার বিকেলে চৌধুরীপাড়ার ছায়ানীড় ভবনের নিচতলার একটি বাসায় অভিযান শুরু করে পুলিশ। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে জঙ্গিরা হ্যান্ডগ্রেনেড ছোঁড়ে। এতে সীতাকু- থানার ওসি (তদন্ত) মোজাম্মেল সহ দুই পুলিশ সদস্য আহত হবার কথা শোনা যায়। এরপর পুলিশ সদস্যরা পিছু হটেন। পরে বাইরে থেকে পুরো ভবনটি ঘিরে রাখে পুলিশ।

পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৫ দিন আগে জঙ্গিরা ছায়ানীড় ভবনের নিচতলার বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল। ওই ভবনে আরও কয়েকটি পরিবার ভাড়া থাকেন। রাত আটটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ওই আস্তানার ভেতরে নারী ও শিশুসহ আরও তিনজন থকার খবর পাওয়া গেছে। অভিযান শুরু পর জঙ্গিরা তিনটি হ্যান্ডগ্রেনেড ছুঁড়ে। ধরা পড়ার আগে কোমরে হাতবোমা লাগানো সুইসাইড বেল্ট বেঁধে নিয়েছিলেন আটক হওয়া নারী জঙ্গি। তবে বাড়ির মালিকের স্ত্রী কৌশল আর বুদ্ধিমত্তায় সেই হাতবোমার বিস্ফোরণ ওই নারী ঘটাতে পারেনি বলে জানিয়েছেন ঘটনাস্থলে থাকা সীতাকু- থানার ওসি ইফতেখার হাসান। এদিকে সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে ওই নারী ও তার স্বামী এবং তাদের এক শিশুসন্তানকে আস্তানা থেকে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। সাধন কুটিরের মালিক সুভাষ দাশ সুরেশ জানান, ২৭ ফেব্রুয়ারি তিন পুরুষ ও এক নারীসহ চারজন এসে খালি বাসাটি দেখে যায়। এ সময় তারা নিজেদের কাপড় ব্যবসায়ী পরিচয় দেয় এবং ভাড়া নিতে সম্মত হয়। ২ মার্চ দুটি আলনা ও ব্যাগ নিয়ে দুজন ওই বাসায় রাখতে যায়।

৪ মার্চ রিক্সায় করে আটক হওয়া নারী-পুরুষ ওই বাসায় উঠে। তবে শুরু থেকেই তাদের আচরণে সন্দেহ হয় মালিক সুরেশ ও তার স্ত্রী ছবি রাণী দাশের। কারণ যে রিক্সায় করে তারা সুরেশের বাসায় এসেছিল সেই রিক্সাচালক ছিল পূর্বপরিচিত। সুরেশ রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, তারা এসেছে সীতাকু-ের প্রেমতলা থেকে। অথচ ভাড়াটিয়ারা জানিয়েছিল তারা এসেছে রামু থেকে। এছাড়া তাদের সন্দেহ করার আরও একটি কারণ হচ্ছে, তাদের বাসার দরজা সবসময় বন্ধ থাকত। তারা কারও সঙ্গে কথা বলত না। গত মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে মালিক সুরেশ টাইলস লাগানোর জন্য বাথরুম ওই বাসায় যায়। এ সময় তাকে দেখে একটি কক্ষে বিদ্যুতের তারসহ কিছু ছোট ছোট সার্কিট পা দিয়ে খাটের নিচে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে জসিম। এতে সুরেশের সন্দেহ হয়। তিনি জিজ্ঞেস করলে বলেন, এগুলো দিয়ে তারা লাইট তৈরি করে। সুরেশ তাদের কাছ থেকে দুটি সার্কিট খুঁজে নিয়ে সকালে পৌরসভার একটি বাজারে ইলেকট্রিকের দোকানে যান। সেখানে একজন তাকে জানান, সার্কিটগুলো খুবই মূল্যবান।

ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম শহর ছাড়া সেগুলো পাওয়ার কথা নয়। সেগুলো ভাল কাজে এবং খারাপ কাজেও ব্যবহার করা যায়। সকাল ১০টার দিকে সুরেশ আবারও তাদের বাসায় গিয়ে ভাড়াটিয়ার তথ্য নিবন্ধনের জন্য পরিচয়পত্র চান। এ সময় তারা যে পরিচয়পত্র দেয় সেটা অনলাইনে যাচাইবাছাই করে জসিম ভূয়া বলে নিশ্চিত হয়। এরপর দুপুর ১টার দিকে সুরেশ ও স্ত্রী ছবি এবং সুরেশের বন্ধু সাগর ও তার বন্ধু মুক্তি গিয়ে তাদের জোর করে বাসা থেকে বের করে দিতে চান। তারা পাঁচদিন সময় দাবি করেন। তখন হঠাৎ আটক নারী রুমের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। পরে বের হন বোরখা পরে। কোমরে ছিল বেল্ট বাঁধা।

সুরেশ জানান, এ সময় তার স্ত্রী ছবি ওই নারীকে জাপটে ধরে ফেলে। ছবিকে কামড়ে দেয় ওই নারী। তখন মুক্তিও তাকে জাপটে ধরে। সুরেশ ও সাগর মিলে জসিমকে ধরে ফেলে। এরপর পুলিশকে খবর দেয়া হয়। সীতাকু- থানার ওসি ইফতেখার হাসান জানিয়েছেন, বেল্টে বাঁধা বোমার বিস্ফোরণ যে কোন মুহুর্তে ঘটতে পারত। বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়াই ছিল তার লক্ষ্য। তার কোমর থেকে বেল্ট খুলে তারপর তাকে আটক করা হয়েছে। এদিকে পুলিশের অভিযানের ফলে পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জঙ্গি আস্তানার ভেতরে আটকে পড়া নারী ও শিশুদের স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

এ ছাড়া উৎসুক জনতাও ভিড় করে। তবে পুলিশ সবাইকে নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে দিয়ে পুরো বাড়িটি ঘিরে রাখে। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সীতাকু- পৌরসভার কাউন্সিলর শফিউল আলম মুরাদ জানান, এর আগে লামারবাজার থেকে দুইজনকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই এখানে অভিযান চালানো হয়েছে। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা বলেন, আস্তানার ভেতরে অস্ত্র-গুলি, হ্যান্ডগ্রেনেড ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে। সীতাকু- থানার ও জেলার রিজার্ভ টিম অভিযানে যোগ দেয়।

লামারবাজারের আমিরাবাদের সাধন কুটির ভবনের নিচতলার বাসাটি ১০-১২ দিন আগে ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গিরা। ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম পূরণের জন্য তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি চান বাড়ির মালিক। কিন্তু ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে গিয়েই বাড়ির মালিকের কাছে ধরা খায় জঙ্গিরা। আর তারপর সোজা পুলিশের হেফাজতে।

বুধবার সীতাকু- পৌরসভার লামারবাজার আমিরাবাদের সাধন কুটির থেকে দুই জঙ্গিকে আটকের পর এসব তথ্য জানা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন জানান, সাধন কুটির ভবনটির মালিক সুভাষ নামে এক ব্যক্তি। বেশ কিছুদিন আগে তিনি জামালপুরে বেড়াতে যান। এর ফাঁকে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী এসে বাসা ভাড়া চাইলে সুভাষের স্ত্রী তাদের দ্বিতল ভবনটির নিচতলার বাসা ভাড়া দেন। গত মঙ্গলবার রাতে ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম পূরণের জন্য তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি চান সুভাষের স্ত্রী। এ কথা শুনে রাতেই পুরুষদের দুইজন পালিয়ে যায়।

বুধবার দুপুরে আবার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি চাইলে বাসায় থাকা এক নারী ও পুরুষ বাড়িওয়ালীকে একটি কাগজ ধরিয়ে দেন। সুভাষদের পাশের বাসায় থাকেন সাগর নামে এক যুবক। তিনি কম্পিউটারের ব্যবসা করেন। সাগরের কাছে কাগজটি নিয়ে গেলে কম্পিউটারে চেক করার পর সেটি যে ভুয়া তা ধরা পড়ে। সাথে সাথে নিচতলার বাসায় গিয়ে দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন সুভাষের স্ত্রী ও সাগর।

সুভাষের স্ত্রী এ সময় বলেন, তোমরা তো ভুয়া কাগজ দিয়েছ। তোমাদের তো সমস্যা আছে। এর আগে ওই বাসায় বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামও দেখেছিলেন সুভাষের স্ত্রী।

এরপর জঙ্গিদের ধরতে গেলে নারী জঙ্গিটি সুভাষের স্ত্রীর হাতে কামড় দেয় ও পুরুষ জঙ্গির সঙ্গে ধস্তাধস্তির ফলে সাগরের শার্ট ছিঁড়ে যায়। শোরগোল শুনে আশপাশের মানুষ এসে জঙ্গিদের আটক করে ও পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে জঙ্গিদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। এ সময় জঙ্গিরা জানায় তারা আগে কলেজ রোডের ছায়ানীড় ভবনে ভাড়া ছিল। এরপরই ছায়ানীড় ভবনে অভিযান শুরু করে পুলিশ।

সাম্প্রতিক