pmphfhdস্টাফ রিপোর্টার: নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও জ্ঞান বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ‘সায়েন্স ডিপ্লোমেসির’ ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় আয়োজিত সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, জ্ঞান চর্চা ও বিনিময়ের মধ্য দিয়ে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে আমরা বিজ্ঞান কূটনীতির ওপর জোর দিচ্ছি। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ভিয়েনা সম্মেলন কেন্দ্রে শুরুর হওয়া দুই দিনের এই সম্মেলনে আফ্রিকা, এশিয়া, উইরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের নেতারাও অংশ নেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের সহযোগিতা নিয়ে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বাধিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান জানান।

ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন দ্য আইএইএ টেকনিক্যাল কো-অপারেশন প্রোগ্রাম; সিক্সটি ইয়ারস অ্যান্ড বিয়ন্ড- কন্ট্রিবিউশন টু ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই আণবিক শক্তির শন্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিরলস কাজ করে যাওয়ার জন্য আইএইএ-এর মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানোর নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে আইএইএর সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশকে গত ৪৫ বছর ধরে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসায় আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনকেও ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সাত শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন আমাদের এ অর্জনে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন মডেল হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে পাবনার রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথাও বলেন। ২০১৩ সালের অক্টোবরে এ প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৪ সালের অগাস্টে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনায় কোম্পানি গঠন করতে সংসদে বিল পাস হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ বাংলাদেশের উন্নয়নের দ্বার খুলে দেবে এবং উন্নয়ন সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করবে- এমন আশা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৬ কোটি মানুষের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নিউক্লিয়ার এনার্জি সোর্স ব্যবহার করবে।

রাশিয়ার সহযোগিতায় নির্মাণাধীন এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিটের মাধ্যমে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের কারিগরি কর্মসূচিতে পর্যাপ্ত সহযোগিতা নিশ্চিত করতে উন্নত দেশগুলোর প্রতিও প্রধানমন্ত্রী দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়শীল দেশগুলোর টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ও এর বিস্তার রোধে বাংলাদেশের বাংলাদেশের দৃঢ় অস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে এবং পাশে থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জনে আমাদের লক্ষ্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের পুরোপুরি ব্যবহার করা। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতিমালা এবং সপ্তম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যা চিহ্নিত করা এবং তা সমাধানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিছু নাগরিক সেবার ডিজিটাইজেশন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গ্রামীণ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ইতিবাচক ফল দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা পাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইএইএ’র কারিগরি সহযোগিতায় আমরা সফল ভাবে ১৩৮টি জাতীয় প্রকল্প সম্পন্ন করেছি। আঞ্চলিক সহযোগিতা চুক্তির (আরসিএ) অধীনে একশো ১১টি আঞ্চলিক সহযোগিতায় অংশ নিয়েছি। আএইএ কারিগরি সহযোগিতা কর্মসূচির অধীনে বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার শিক্ষা, গবেষণা, খাদ্য নিরাপত্তা, মানব স্বাস্থ্য উন্নয়ন, শিল্প ক্ষেত্রে প্রয়োগ, ফসল ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে, পোকামাকড় দমনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা পেয়ে আসার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি, তেজস্ক্রিয়তাসহ অন্যান্য উন্নত কৌশল ব্যবহার করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা) বিভিন্ন ফসলকে অধিক ফলনশীল, উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ, সল্প সময়ে উৎপাদন এবং লবণ ও বন্যাসহিষ্ণু জাতের বীজ উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১৩টি ফসলে ৯২টি বৈচিত্র্য এনেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমনকি বাংলাদেশ অতিরিক্ত খাদ্য শস্য রপ্তানিও করছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নিউক্লিয়ার সায়েন্সের সুফল তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ যারা রোগ নির্ণয়ে মেডিকেল সেবা নিতে পারছে। নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেবা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করায় গত ২০ বছরে এ সংখ্যা ১০ গুণ বেড়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় বাংলাদেশ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কথাও তিনি বলেন। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে তার সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, জনস্বাস্থ্য সূচকের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ স্টাবলিশমেন্ট এই কেন্দ্রে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে সফলভাবে একটি ছোট পারমাণবিক গবেষণা চুল্লী চালু রয়েছে, যার মাধ্যমে গবেষণা, রেডিওআইসোটোপ উৎপাদন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে পরমানু বিজ্ঞানের বিকাশে বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানি এম এ ওয়াজেদ মিয়া কথাও স্মরণ করেন শেখ হাসিনা। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী সকালে ভিয়েনা সম্মেলন কেন্দ্রে পৌঁছালে আইএইএ-এর মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানো তাকে স্বাগত জানান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে তাদের মধ্যে বৈঠকও হয়। দুই দিনের এই সরকারি সফরে শেখ হাসিনা অস্ট্রিয়ার ফেডারেল প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভ্যান ডের ব্যালেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন এবং চ্যান্সেলর ক্রিস্টিয়ান কার্নের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন। এর আগে গত সোমবার ভিয়েনায় অস্ট্রিয়া প্রবাসীদের দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন শেখ হাসিনা। এসময় বিএনপির নেতিবাচক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে প্রবাসীদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বিদেশিদের কাছে তুলে ধরতে হবে, কীভাবে তারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারল। আইএইএ র ৬০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত সোমবার ভিয়েনা পৌঁছনোর পরপরই গ্র্যান্ড হোটেলে অস্ট্রিয়া আওয়ামী লীগের দেওয়া গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন শেখ হাসিনা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের লাগাতার হরতাল-অবরোধে গাড়িতে আগুন দেওয়ায় শতাধিক মানুষ মারা যায়। পরের বছরও সরকার হটাতে বিএনপি-জামায়াত জোটের তিন মাসের কর্মসূচিতে পেট্রোল বোমা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর কথা প্রবাসীদের বলেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারল, আর তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা যাবে না? যারা পরিকল্পিতভাবে হত্যাকা- চালিয়েছে; অবশ্যই এর বিচার হবে। শত শত মানুষ যে পুড়িয়ে মেরেছে; এর বিচার করব। হুকুমের আসামির বিচার করব। প্রবাসীদের এই অনুষ্ঠানে বক্তব্যে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিরীহ মানুষকে হত্যা করা, আত্মঘাতী হওয়া, আত্মহত্যা মহাপাপ, আত্মহত্যা করা একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রবাসীদের সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আপনাদের সহযোগিতা চাই। আপনাদের দায়িত্ব রয়েছে দেশের প্রতি। এই অশুভ অসুস্থ প্রক্রিয়া থেকে আমাদের দেশের মানুষকে সরিয়ে আনা। জঙ্গিবাদকে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারা বিশ্বে ঘটনা ঘটছে। এটা একটা দেশের না। এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। এই সমস্যা বাংলাদেশের মানুষকে যেনো ক্ষতি করতে না পারে, সেটা আমাদের সবাইকে দেখতে হবে। সকলের জন্য এটা একটা বিরাট দায়িত্ব। সংবর্ধনায অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, সর্ব ইউরোপ আওয়ামী লীগের সভাপতি অনীল দাসগুপ্ত, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ শরীফও বক্তব্য রাখেন।

সাম্প্রতিক