স্টাফ রিপোর্টার: বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম দিকে সিরাজগঞ্জ জেলায় ১১০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল। মোট জমির মধ্যে এক হাজার ৪১ একরের ব্যবস্থা করেছে সরকার। বাকি ৫৯ একর জমি নিজেদের উদ্যোগে কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত দেশের বিভিন্ন খাতের প্রতিষ্ঠিত ১১ উদ্যোক্তা কোম্পানি। এখন চলছে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ভূমি উন্নয়নের কাজ। সমীক্ষা আর মাস্টার প্ল্যান তৈরির জন্য জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার যে চারটি কম্পানি অংশগ্রহণ করেছে, এখন চলছে তার বাছাই প্রক্রিয়া। এই চারটির মধ্যে একটি কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হবে। জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন। জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৯৭ কোটি টাকা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) মাধ্যমে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দিয়েছে ১১ উদ্যোক্তা কোম্পানি। চলতি মাসের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন। সূত্র জানায়, বেজা গভর্নিং বোর্ডের প্রথম সভায় ২০১২ সালের মার্চে সিরাজগঞ্জে সরকারি ব্যবস্থাপনায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছিলো। ২০১৩ সালে জমি অধিগ্রহণের অনুমোদনও পাওয়া গিয়েছিলো।
এ প্রকল্পে বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে যুক্ত হয়েছিলো বিশ্বব্যাংক। কিন্তু দুই দফা সময় বৃদ্ধি করেও ভূমি উন্নয়নের জন্য ডেভেলপার নিয়োগে কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে না আসায় বিশ্বব্যাংক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রকল্প থেকে সরে আসে। তবে এগিয়ে আসেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। ১১ জন শেয়ার হোল্ডার নিয়ে গঠিত সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল কোম্পানি এটি গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা। বেজা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, বেসরকারিভাবে এখন পর্যন্ত ১৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের ১১ উদ্যোক্তা কম্পানি সিরাজগঞ্জে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার আগ্রহ দেখিয়েছে। এটি নিয়ে হবে ১৪টি। বেসরকারিভাবে এটি হবে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল। যে ১১টি উদ্যোক্তা কোম্পানি যৌথভাবে সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে তারা হলো মিড এশিয়া, রাইজিং গ্রুপ, মাহমুদ গ্রুপ, বাংলাভিশন গ্রুপ, প্রভিটা গ্রুপ, রাতুল গ্রুপ, স্কয়ার ইলেকট্রনিকস, প্যারাগন সিড, টেক্সটাউন গ্রুপ বাংলাদেশ, মানামি ফ্যাশন লিমিটেড এবং চেঞ্জ বাংলাদেশ। পবন চৌধুরী বলেন, প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলটি প্রতিষ্ঠিত হলে পুরো উত্তরবঙ্গের আর্থসামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন আসবে। সেখানে গ্যাস-বিদ্যুতের সুবিধা আছে। সড়ক, রেল ও নৌ সুবিধাও ভালো। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে আদর্শ।
১১টি উদ্যোক্তা কোম্পানির যৌথভাবে সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে তিন হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে পোশাকশিল্প, বস্ত্রশিল্প, ওষুধ, চামড়া, বিশ্বমানের ট্রেড হাউস, অটোমোবাইল, আইটি শিল্প ও কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ কারখানা গড়ে তোলা হবে। উদ্যোক্তাদের মতে, উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বলা হয় সিরাজগঞ্জকে। ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব বিবেচনায় সেখানে গড়ে উঠেছিল নৌ বন্দর ও রেল সংযোগ। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সেতু করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলায় মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা যে হারে উন্নতির আশা করা হয়েছিল, সেভাবে হয়ে ওঠেনি। উদ্যোক্তারা আশা করছে, প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলটি প্রতিষ্ঠিত হলে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। সিরাজগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আগ্রহ কেন তৈরি হলো জানতে চাইলে একাধিক উদ্যোক্তা বলেন, সেখানে নদীপথ আছে। সড়ক ও রেল সংযোগও ভালো। সেখানে গ্যাস-বিদ্যুতের সুবিধা আছে। বিনিয়োগ করার জন্য সিরাজগঞ্জ আদর্শ জায়গা। সেখানে বিনিয়োগ করতে এরইমধ্যে দেশি-বিদেশি অনেক বড় বড় কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। এনার্জিপ্যাক, স্পিনিং কম্পানি, ওষুধ কোম্পানিসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছে, বাংলাদেশে গত এক দশকে শিল্প ও সেবা খাতে ব্যাপক বিকাশ ঘটলেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে কৃষি খাত এখনো প্রধান পেশা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সামপ্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ফল এবং সবজি নষ্ট হয়ে যায় সঠিক প্রক্রিয়াজাত এবং সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে। শীতকালে দেশে নানা জাতের সবজি ও ফল উৎপাদিত হলেও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণ পদ্ধতি না থাকায় সেই পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। লোকসান গুনতে হয়। এ কারণে অনেকে কৃষির ওপর আস্থা হারিয়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছে। কৃষকদের কথা মাথায় রেখে সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চলে আম, আলু, ভুট্টাসহ কৃষি ও খাদ্যজাত পণ্যের প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা থাকবে। দুগ্ধ ও তাঁতশিল্পের জন্যও পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলটি হবে সবুজ ও পরিবেশবান্ধব। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধানগার নির্মাণে ৩০০ কোটি টাকা খরচ হবে। আড়াইশ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হবে এক হাজার ৬০০ কোটি থেকে দুই হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া, অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি সেবা পেতে খরচ হবে বাকি টাকা।
< Prev | Next > |
---|