motamottমোমিন মেহেদী

১৪৪ কোটি ব্যবহারকারীরা প্রতিদিন ফেসবুকে ৭০০ কোটি মিনিট ব্যয় করে। গুগলে যত সময় ব্যয় করা হয়, মানুষ ফেসবুকে তার চেয়ে দ্বিগুণ সময় ব্যয় করে থাকে। ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা ছবি, লিংক, ভিডিও, বিভিন্ন স্ট্যাটাস আপলোড, শেয়ার ও কমেন্ট করতে পারে। এ ছাড়াও ফেসবুকে বিভিন্ন খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে, রয়েছে হওেশ রকম অ্যাপ্লিকেশন, যার মাধ্যমে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বার্তা আদান-প্রদান ও খোশগল্প বা চ্যাট করা যায়। ২০০৪ সালে বন্ধু ডাস্টিন ও ক্রিসের সঙ্গে মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুক চালু করেন। সীমিতসংখ্যক বন্ধুবান্ধব ও স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এই মাধ্যমের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখা ছিল জাকারবার্গের প্রাথমিক ইচ্ছা। কিন্তু উদ্বোধনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২০০ ছাত্রছাত্রী ফেসবুকে ‘সাইন আপ’ করে ফেলল। এর পরের ঘটনা শুধু ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পাশাপাশি সমস্যার জালে আচ্ছন্ন এই ফেসবুক। কেন বললাম কথাটি? একারনে যে, যত্তরকম ভালো দিক আছে ফেসবুকের, সবরকম ভালো দিকের পাশাপাশি সমস্যার জালও ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বললে বলা যায়, স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে ফেসবুক। এই খবরের পরও যারা ফেসবুকে সময় ব্যয় করবেন বলে স্থির করেছেন, তাদের উদ্যেশ্যে বলছি- ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীর (ইউজার) সংখ্যা ছিল ৯০০ মিলিয়ন বা ৯০ কোটি। ২০১৫ সালের প্রথমদিকের হিসাবে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৪ কোটিতে। এর অর্থ হল, প্রতি মাসে ১৪৪ কোটি ব্যবহারকারী ফেসবুকে সক্রিয় থাকে। এর মধ্যে ১২৫ কোটি হল মোবাইল-ফেসবুক ব্যবহারকারী। এক পুরনো হিসাব অনুযায়ী ফেসবুকে প্রতিমাসে ২০০ কোটি ছবি ও ১ কোটি ৫০ লাখ ভিডিও আপলোড করা হয়।
একটু অতিতে চোখ রাখলে দেখতে পাবো যে, সারা বিশ্বে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ল ফেসবুক। বর্তমানে এটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সামাজিক গণসংযোগ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বন্ধুত্ব, যোগাযোগ স্থাপন ও বিনোদনের জন্য যে মাধ্যমটি একসময় চালু করা হয়েছিল, তা আজ বিশ্বের লাখো-কোটি মানুষের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্য সমস্যার এক বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে ইদানীং আমার মনে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উদয় হয়েছে। অবশ্য এই প্রশ্ন নতুন নয়। বহুদিন আগে থেকেই মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবছেন এবং উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করছেন। প্রশ্নটি হল, বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে ফেসবুক ব্যবহার কি আশক্তির পর্যায়ে পড়ে? এর উত্তর কারও কারও জন্য ‘না’ হলেও অসংখ্য উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়ের জন্য ফেসবুক ব্যবহার অবশ্যই আসক্তির পর্যায়ে পড়ে বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা ইদানীং মনে করছেন। এ প্রশ্নের জবাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য যুবক-যুবতী ও বয়স্ক মানুষ খোলামেলা জবাব দিয়েছেন।
তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-অর্থনীতি ও সমাজকর্মী হিসেবে স্বীকার করি আমি সত্তর ভাগ ফেসবুকে আসক্ত। আমি বুঝি ফেসবুক আমার জন্য প্রচন্ড ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক অবশ্যই আসক্তির পর্যায়ে পড়ে। আমি ফেসবুক নিয়ে বসলে কখন দিন কেটে যায় টের পাই না। এতে আমার মন ও স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। একটি অনলাইন ভিত্তিক তথ্য প্রতিষ্ঠান বলেছে যে, ফেসবুক এমন এক পরিবেশ তৈরি করে যা ছেড়ে ইচ্ছা করলেই কেউ চলে যেতে পারে না। এটি জুয়াখেলার মতো একটি আসক্তি সৃষ্টিকারী মাধ্যম। একজন ইউজার ‘ফেসবুক চক্র’ আখ্যায়িত করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস উপস্থাপন করেছে। চক্রে ইউজার দেখিয়েছে, ফেসবুকে বসলে সময় নষ্ট, সময় নষ্ট করার কারণে যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়া, কাজ জমে গেলে কাজের চাপ বৃদ্ধি পাওয়া, কাজের চাপ বৃদ্ধির ফলে ফেসবুকে লগ ইন করা এবং লগ ইন করলে আবার সময় নষ্ট। এভাবে চলতে থাকে ফেসবুক চক্র। তার মতে, এই গোলকধাঁধায় অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারী ঘুরপাক খাচ্ছে। এ ধরনের গোলকধাঁধা থেকে বের হয়ে আসার সহজ কোনো পথ নেই। একজন আন্তর্জাতিক মনোবিজ্ঞানীর মতে, বর্তমান প্রেক্ষিতে ফেসবুক আসক্তিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি এই সমস্যাকে শুধু আসক্তিতে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। তিনি মনে করেন, ফেসবুক ব্যবহার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং এই প্রবণতা এমন সব জটিল সমস্যা তৈরি করছে যে, এই অবস্থাকে ডিসঅর্ডারের পর্যায়ে ফেলে সংজ্ঞায়িত করতে হবে।
শারীরিক ও মানসিক অবস্থার এই অবনতিকে বলা হয় ফেসবুক অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডার (ঋধপবনড়ড়শ অফফরপঃরড়হ উরংড়ৎফবৎ) বা ফেসবুক আসক্তি সংকট। ফেসবুক আসক্তি সংকট এমন এক অবস্থা যখন কেউ এত বেশি সময় ফেসবুকে কাটায় যে, তার স্বাভাবিক জীবন ও স্বাস্থ্যের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এক হিসাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৫০ কোটি মানুষ ফেসবুক আসক্তিতে ভুগছে। কেউ এই সংকটে ভুগছে কিনা তা বোঝা যায় কতগুলো উপসর্গ থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ হল ধৈর্য। এই শব্দটি ব্যবহার করা হয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর বেপরোয়া আচরণ বর্ণনা করার জন্য। এরা তত বেশি সময় ফেসবুকে কাটায় যতক্ষণ পর্যন্তনা তাদের পরিপূর্ণ তৃপ্তি আসে। কিন্তু এতে তাদের সম্প্রতি একটি দৈনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ-এর একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে ফেসবুক বিষয়ে। আর এই লেখাটিতে তিনি লিখেছেন, ব্যক্তিগত জীবনে প্রচন্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও মা-বাবারা এই শ্রেণীর মানুষকে এককথায় আসক্ত বলে অভিহিত করেন। দ্বিতীয়ত, এসব আসক্ত মানুষকে দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম করার জন্য যদি ফেসবুক ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা হয় বা প্রতিহত করা হয়, তবে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, হতাশা প্রচন্ড রূপ ধারণ করে। সেখানে তিনি আরো লিখেছেন, ইউজারদের অনুপস্থিতিতে ফেসবুকে কী কী নতুন জিনিস পোস্ট করা হয়েছে তা জানার জন্য এরা সারাক্ষণ অস্থির থাকে। তৃতীয়ত, ফেসবুক আসক্তদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, এমনকি বাবা-মা’র সঙ্গে কাটানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে না। এমনকি এরা প্রয়োজনীয় কাজ, পড়াশোনা বা খেলাধুলা পর্যন্তছেড়ে দেয় ফেসবুকে সময় কাটানোর জন্য। ফেসবুক আসক্তির কারণে এরা অনেক সময় দরকারি টেলিফোন কল পর্যন্তগ্রহণ করে না। অনেক ফেসবুক ইউজার সময়মতো ও ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না, সময়মতো ঘুমাতে যায় না, রাত জেগে ফেসবুক চর্চা করে- যার ফলে এদের শরীর ও মনের ওপর প্রচন্ড ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। অনেকেই মনে করেন, নেটের প্রতি আসক্তি অন্যান্য ভয়াবহ আসক্তির মতোই একটি খারাপ আসক্তি এবং সাবধানে ও যতœসহকারে এর চিকিৎসা করা দরকার।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের একটি বড় অংশ তাদের প্রচারের জন্য বেছে নিয়েছেন ফেসবুককে; এই পথেই হেঁটে চলছেন নতুন প্রজন্মের সেলিব্রেটিগণ। বিশেষ করে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি আর রাজনৈতিক অঙ্গণের মানুষেরা। ফেসবুক অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডার (ঋঅউ) এক ধরনের খামখেয়ালিপনা বা খেপামি (ভধফ) কিনা, তা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। যে যাই বলুক, ফেসবুক আচ্ছন্নতা (ড়নংবংংরড়হ) বর্তমান সমাজে জটিল ও আজগুবি সব সমস্যা তৈরি করছে। এটা সংকট কী সংকট নয় তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু ফেসবুকের কারণে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক যেসব সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তা দূর করা দরকার- এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। এখন ফেসবুক ইউজার অসংখ্য মানুষ, বিশেষ করে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা অনলাইনে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে প্রোফাইল, ছবি ও স্ট্যাটাস আপলোড করতে ও দেখতে গিয়ে যে সময় নষ্ট হচ্ছে, তাতে করে তাদের জীবনের ওপর প্রভাব পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে ফেসবুক আনন্দদায়ক এবং উপকারীও বটে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফেসবুকে অনেক দরকারি, শিক্ষণীয় ও মূল্যবান উপকরণ থাকে। কিন্তু তারপরও ফেসবুক বিশ্বব্যাপী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আচার-আচরণ ও জীবন পদ্ধতির ওপর প্রচন্ড ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। অনলাইনে মানুষ আজকাল এত বেশি সময় ব্যয় করছে যে, তার ফলস্বরূপ দৈনন্দিন জীবনের অপরাপর প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান কাজে বেশি সময় দিতে পারছে না। মানুষের আসল জীবনের চেয়ে অনলাইন জীবন যেন অনেক বেশি অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান কোথায়? আমরা কীভাবে এমন একটি সমস্যার সমাধান খুঁজব, যখন পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ অনলাইন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। এর উত্তর দেয়া হয়তো তত সহজ হবে না। তবে উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের মা-বাবারা এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন বলে অনেকেই মনে করেন। কিন্তু বাবা-মায়েরা যখন সন্তানের ফেসবুক বন্ধু হয়ে যান, তখন কী করার থাকে! বয়স্ক মানুষের চেয়ে উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরাই ফেসবুক নিয়ে তাদের অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছে। ফেসবুক নিয়ে এত বেশি সময় কাটানো উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের উপকারের চেয়ে অপকারই করছে বেশি।
এমন একটা সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছি আমরা; যে সময়ে আমাদের চারপাশে সমস্যা আর সমস্য্ সমাধানের উদ্যেগ নেই। টক শো, আলোচনা সভা বা সেমিনারে রাজনীতিকদের গলাবাজীর পাশারপাশি সুশীল সমাজের চাপানো গলার কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা। তাদের কেবল সমাধান প্রয়োজন; নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে সেই সমাধানের জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছি নিরন্তর। সেই সুবাদে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করছি- ১. ধর্মীয় উগ্রবাদীতা বন্ধে বিটিআরসির পদক্ষেপ ২. ফেসবুককে কেউ বা কোন গোষ্ঠি যাতে অপব্যবহার করতে না পারে এজন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষক দল নিয়োগ করা ৩. ফেসবুক-ই শুধু নয় সকল সামাজিক মাধ্যমকে অপব্যবহারের হাত থেকে রক্ষার জন্য নতুন প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা, আইনী নির্দেশনা ও ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরা ৪. স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যার কথাটি ফেসবুক বা অনলাইন ইউজারদের সামনে তুলে ধরা। এই কাজগুলো করলে আমার বিশ্বাস সকল সমস্যা থেকে উত্তরণের রাস্তা তৈরি হবে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি এবং উপদেষ্টা, জাতীয় শিক্ষাধারা

সাম্প্রতিক