motamott॥ এম. কে. দোলন বিশ্বাস ॥

আজ থেকে সাত দশক আগে পাকিস্তান নামক দেশটির জন্ম। দেশ গঠনের পর থেকে ৭০ বছরে পাকিস্তানের মোট ১৭ জন প্রধানমন্ত্রীর একজনও তাদের মেয়াদের নির্ধারিত পাঁচ বছর পূর্ণ করতে পারেননি। বরং মেয়াদ পূর্ণের আগেই ওইসব প্রধানমন্ত্রীকেই আউট হতে হয়েছে ক্ষমতার মসনদ থেকে। ফলে পূর্ণ মেয়াদহীন পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসা সব প্রধানমন্ত্রীর খতিয়ান।

১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবসময় উত্তাল। এ সময়ের মধ্যে স্বৈরশাসকদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাত হয়েছে চারবার, একজন প্রধানমন্ত্রীকে গুপ্তহত্যা এবং আরেকজনকে ফাঁসি দেয়া হয়। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টদের নির্দেশে আরও অনেকেই অবসরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। আবার কাউকে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের ধোঁয় তুলে মেয়াদ পূর্ণ করতে দেয়া হয়নি। দু’জন প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিমকোর্টের মাধ্যমে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাগ্যেও ব্যতিক্রম হয়নি। বরং তাকেও পূর্বসুরিদের মতোই মেয়াদ পূর্ণের আগেই বিদায় নিতে হল ক্ষমতার মসনদ থেকে। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের উৎস জানাতে ব্যর্থ হওয়ায় পানামা পেপারসের নথি কেলেঙ্কারির পর দুর্নীতির মামলায় পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট গত ২৮ জুলাই নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। ওই ঘোষণার কিছুক্ষণ পরই স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন নওয়াজ শরিফ। এভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইতিহাসের বারবার পুনরাবর্তন ঘটছে।
দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লিয়াকত আলী খান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিধিবাম! লিয়াকত আলী খানের ভাগ্যে ক্ষমতা বেশি দিন সইনি। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন। এরপর প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দীন। দুই বছরের মাথায় দ্বিতীয়তম প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনকে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের নির্দেশে ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল অবসরে যেতে বাধ্য হন।
এরপর তৃতীয়তম প্রধানমন্ত্রী হন মুহাম্মদ আলী বোগরা। এক বছরের মাথায় ১৯৫৪ সালে তাকেও ক্ষমতা তেকে সরিয়ে দেন গভর্নর গোলাম মোহাম্মদ। ক্ষমতা ফিরে পেতে তিনি আদালতের দ্বারস্ত হন। আদালত তাকে ফের ক্ষমতায় ফেরার রায় দেন। তিনি পুনর্বহাল হয়েও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। দুই বছরের কিছু বেশি সময় পর ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা বরখাস্ত করেন মোহাম্মদ আলী বোগরাকে। কারণ পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হন তিনি। একই বছর চতুর্থতম প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৩ মাস। ১৯৫৬ সালের নতুন সংবিধান বলে প্রেসিডেন্ট হন ইস্কান্দার মির্জা। ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী।
এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের (পরবর্তীতে বাংলাদেশ) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের নেতা নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বরে তাকে পঞ্চমতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মুসলিম লীগের বাইরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই প্রথম কোনো ব্যক্তি। এক বছর পর ১৯৫৭ সালে ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে মতানৈক্যের জেরে তিনি পদত্যাগ করেন।
ষষ্টতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইবরাহিম ইসমাইল চন্দ্রিগরকে নিয়োগ করেন ইস্কান্দার মির্জা। মাত্র দুই মাসের মাথায় ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরোজ খান নুনকে নিয়োগ দেন। আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন।
সামরিক শাসনের ১৩ বছর পর ক্ষমতায় আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৩ সালে নতুন সংবিধান পাস হওয়া পর্যন্ত ভুট্টো বিশেষ ব্যবস্থায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। একই বছর নতুন সংবিধান গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্যে ভুট্টো প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল করেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭৭ সালে তিনি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন এবং পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ওই বছরের জুলাই মাসে জেনারেল মোহাম্মদ জিয়াউল হক এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ১৯৭৯ সালে দেশটির শক্তিশালী সামরিক আদালতের এক রায়ে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়।
এরপর ১৯৮৫ সালের এক নির্বাচনে স্বৈরশাসক জিয়াউল হকের অধীনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোহাম্মদ খান জুনেজো। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তাকে স্বৈরশাসক জিয়াউল হক হুমকি মনে করেন। অতএব ১৯৮৮ সালের ২৯ মে ভেঙ্গে দেয়া হয় মোহাম্মদ খান জুনেজোর সরকার। ওই একই বছর মারা যান স্বৈরশাসক জিয়াউল হক। ফলে ১৯৮৮ সালে একটি সাধারণ নির্বাচিত অনুষ্ঠিত হয়।

গণতান্ত্রিক এ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ১৯৮৮ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন বেনজির ভুট্টো। প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান তার সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার ১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট বেনজির ভুট্টোর সরকার ভেঙ্গে দেন। বেনজির ভুট্টোর পর একই বছর প্রথমবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ।
১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসাক খান তাকে বরখাস্ত করেন। পরে সুপ্রিমকোর্ট তাকে পুনর্বহাল করলেও তৎকালীন সেনাপ্রধান ওহিদ কাকার নওয়াজ শরীফ এবং গোলাম ইসাক খান উভয়কেই একই বছরের ১৮ জুলাই পদচ্যুত করেন।
এরপর বেনজির ভুট্টো ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয় বারের মতো পুনঃরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি তিন বছর ক্ষমতায় স্থায়ী হন। ১৯৯৬ সালে এসে তারই নিয়োগ দেয়া প্রেসিডেন্ট ফারুক লাঘরি ষড়যন্ত্র করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণ নির্বাচনের সুবাদে নওয়াজ শরিফ দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। তবে ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ দেশে জরুরি অবস্থা জারি অর্থাৎ সেনাশাসন ঘোষণা করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
স্বৈরশাসক অধীনে দায়িত্ব পালন : তিনজন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের অধীনে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি দায়িত্বে ছিলেন মাত্র ১৯ মাস। (২০০২-২০০৪)। এরপর ২০০৪ সালে মোশাররফের বন্ধু শওকত আজিজ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত মাত্র ২ মাস ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন চৌধুরী সুজাত। শওকত আজিজ দায়িত্ব পালন করেন ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি-পিপিপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করায় ইউসুফ রাজা গিলানি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২০১২ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন গিলানি। আদালত অবমাননার মামলায় সুপ্রিমকোর্টের এক রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে পদত্যাগ করেন তিনি।
পিপিপি সরকারের বাকি সময়ে দায়িত্ব পালন করেন রেজা পারভেজ আশরাফ। ২০১২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এরপর ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাজা পারভেজ আশরাফ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। নিজের মেয়াদ পূর্ণ করার প্রায় ১ বছর আগে দুর্নীতির অভিযোগ সুপ্রিমকোর্টে অযোগ্য ঘোষিত হয়ে পদত্যাগ করলেন নওয়াজ শরিফ। (তথ্যসূত্র : যুগান্তর- ২৯.০৭.২০১৭)
এছাড়াও ক্ষমতায় আসেন গোলাম মুস্তফা (১৯৯০), মইনুদ্দিন আহমেদ কুরেশি (১৯৯৩), মালিক মেরাজ খালিদ (১৯৯৬-১৯৯৭), মোহাম্মদ মিয়া সুমরো (২০০৭-২০০৮), ও মির হাসান খান খোসা (২০১৩)। এদের কেউই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। (তথ্যসূত্র : দ্য ডন/বাংলাদেশ প্রতিদিন- ২৯.০৭.২০১৭)

রাজনৈতিক জীবনে নওয়াজের উত্থান-পতন : রাজনৈতিক জীবনে বহু উত্থান-পতন হয়েছে পাকিস্তানের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের জীবনে। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে ১৯৪৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন নওয়াজ। তার ধনাঢ্য পিতা ছিলেন ইত্তেফাক ও শরীফ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নওয়াজ পরিবারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়। এরপরই রাজনীতিতে প্রবেশের চিন্তা করেন তারা। নওয়াজ ব্যবসায় ভালো করতে পারবেন না এমন চিন্তা থেকেই তার বাবা তাকে রাজনীতিতে ঢোকার পরামর্শ দেন। এরপর ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান মুসলিম লীগে যোগ দেন নওয়াজ।
জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে নওয়াজ প্রথম পাঞ্জাব মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৮১ সালে তিনি পাঞ্জাব উপদেষ্টা বোর্ডে যোগ দেন। ১৯৮৫ সালে নওয়াজ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে সামরিক শাসন শেষে তিনি আবারও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের ১ নভেম্বর প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন নওয়াজ শরীফ।
১৯৯৭ সালে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ। এরপর বহু উত্থান পতনের পর ২০১৩ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু তৃতীয়বারের পূর্ণ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন এই পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী। (তথ্যসূত্র : আল-জাজিরা, লাইভ মিন্ট, জিওটিভি, ডেইলি টাইমস/যায়যায়দিন-২৯.০৭.১৭)
যবনিকা : টালমাটাল পাকিস্তান। এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু। ‘রাজনীতির ভূমিকম্পে’ কাঁপছে চারপাশ। বৃটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে এ দেশটি। পাকিস্তানের ৭০ বছরের যে ইতিহাস তা অধরাই রয়ে গেল; এখন পর্যন্ত সেখানকার কোনো একজন প্রধানমন্ত্রীই তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না। ফলে সেখানকার ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও তার ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে সুপ্রিম কোর্টের অযোগ্য ঘোষণা, তারপর তিনি পদত্যাগ করায় বিশ্ব তাকিয়ে আছে পাকিস্তানের দিকে। আমরাও চাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু পাকিস্তানের উত্তোরতর উত্তোরণ ঘটুক। চর্চা হোক গণতন্ত্রের।
(এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক )

সাম্প্রতিক