-মাহমুদুল বাসার
বাংলাদেশের সুশীল সমাজও আওয়ামীলীগ-বিএনপি-জামায়াতের উর্ধ্বে নন, তাই নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে তারা একমত হয়ে পরামর্শ দিতে পারেন নি। স্ব স্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই যা বলার বলেছেন। নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগের কথা বলেছেন কেউ কেউ, এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন ২/১ জন। সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা বলেছেন যারা তারা কেমন করে এমন একটি প্রস্তাব দিলেন তাই ভাবছি। মনে হয় তারা নির্বাচন কমিশনকে সামনে রেখে সরকারকে কথা গুলো বলেছেন। কেননা সংসদ ভাঙার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই। এমন উদ্ভট কথা বলার চেয়ে যারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে যাননি তারাই বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। পৃথিবীর কোন্ দেশে এমন দৃষ্টান্ত আছে যে নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন সংসদ ভেঙে দেয়? এত বড় বিদ্বান হয়েও যা নির্বাচন কমিশনের আওতায় নেই তাও প্রস্তাব করেছেন।
সহায়ক সরকার গঠন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে যা তাদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। সেনাবাহিনী নিয়োগ ও সহায়ক সরকার এ দুটো বিএনপির প্রস্তাব। যে ব্যাপারে সরকার অনড় অবস্থানে আছে। এ প্রসঙ্গে সুশীল সমাজের একটি অংশ বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীর কাজ হলো দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ফলে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব দেয়া ঠিক হবে না।’ তারা সংসদ ভাঙারও বিরোধিতা করেন।
সেনাবাহিনী ২০০১ সালের নির্বাচনে কী সাংঘাতিক ভূমিকা পালন করেছিলো তা আমাদের মনে আছে। হোসেন জিল্লুর রহমান সাহেব যে ভয় দূর করার কথা বলেছেন, তখন সেনাবাহিনী ওই ভয়ের প্রকোপ ছড়িয়ে দিলেছিলো। নির্বাচনের দিন তুফানের গতিতে মানুষ পেটানো শুরু হয়েছিলো। নৌকার ভোটারদের মাঠ ছাড়া করা হয়েছিলো। ভয়ে সংখ্যা লঘুরা ঘর থেকে বের হতে পারেনি।
দেশে পুলিশ, আনসার, র্যাব, বিজিপি আছে, তা সত্ত্বেও একেবারে সেনা ক্যাম্পের দ্বারস্থ হতে হবে? সামনে কি নির্বাচন হবে না সশস্ত্র যুদ্ধ হবে? নাকি অপারেশন ক্লিন হার্ট করা হবে?
নির্বাচনকে ফেয়ার করার ব্যাপারে সিভিল সমাজেরও ভূমিকা আছে, সে ব্যাপারে সুশীল সমাজ কোন কথাই বলেননি। জনগণেরই জেগে ওঠা উচিত যাতে কোনো দল কোনো পক্ষ কেন্দ্র দখল করতে না পারে, জাল ভোট দিতে না পারে, ভোট কেনা-বেচা না হতে পারে। আমি ২৪ বছর একটি বেসরকারী কলেজের শিক্ষক ছিলাম। আমিও পিজাইডিং অফিসার ছিলাম। যে ভোট কেন্দ্রে যে দলের জোর বেশি থাকে সেই দল সেই ভোট কেন্দ্র দখল করে। সে যে দলই হোক। ২০০১ সালের নির্বাচনে যিনি স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন, তিনি ছিলেন জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তিনি সমগ্র পুলিশ ও সেনা প্রশাসনকে প্রভাবিত করেছিলেন বিএনপির পক্ষে এবং নৌকার বিপক্ষে। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারও কোনো গোপন করেননি বিএনপিকে পক্ষ দিতে। সেখানে আওয়ামীলীগ সরকারকে এত সন্দেহ কেন? নির্বাচনের ইতিহাস সামনে আনা দরকার, কোন্ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ভোট ডাকাতি করে, সেনাবাহিনী ব্যবহার করে ক্ষমতায় এসেছে। ২০১৪ সালে বিএনপি জামায়াত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করলে প্রমাণ হয়ে যেতো আওয়ামীলীগ সরকারের ভূমিকা। তা প্রমাণ করার ঝুঁকি নিতে পারেনি বিএনপি। সামনের নির্বাচনে প্রমাণ হবে আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো জঘন্য ভূমিকা নেয় কিনা।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর মীরপুর ও মাগুড়ায় বিএনপি সরকার যে কুর্কীতি করেছিলো, তেমন কাজ করেনি আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালের পর কোনো একটি উপনির্বাচনে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ৫টি সিটি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলো ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ। সে পরাজয় আওয়ামীলীগ সরকার মেনে নিয়েছিলো। প্রথম পরাজয় ঘটে চট্টগ্রামে। সিটি নির্বাচনে। সে পরাজয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ দল মেনে নিয়েছিলো। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে আন ফেয়ার বলার সুযোগ কমই। এর দায় বিএনপির কম নয়। বিএনপি অংশ নিলে প্রমাণিত হতো ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের নির্বাচনী আচরণ, তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রমাণ হতে যাচ্ছে অনেক কিছু। এটা নিশ্চিত যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। ২০১৪-১৫ সালে মানুষ পোড়ানোর রাজনীতি না করে নির্বাচনে অংশ নিলে দেশের সংসদীয় রাজনীতির জন্য এবং বিএনপির জন্য অনেক ভালো হতো। বিএনপি জামায়াতকে খুশি করার জন্য নির্বাচন অংশ নেয়নি।
আমাদের সুশীল সমাজ ইসির সাংবিধানিক ক্ষমতার কথা না ভেবে, ইসিকেই সরকার মনে করে পরামর্শ প্রদান করেছেন। আওয়ামীলীগ সরকারকে এত সন্দেহ কেন? আওয়ামীলীগ সরকার কি জিয়া, এরশাদের মত গণভোট দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে? এই দলের তো পরাজয় মেনে নেবার অভ্যাস আছে। এই দলের যোগ্যতম রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ড. কামাল হোসেন পরাজিত হয়েছিলেন বিচারপতি সাত্তারের কাছে। আওয়ামীলীগেরই রাষ্ট্রপতি প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী পরাজিত হয়েছিলেন জিয়াউর রহমানের কাছে। আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেয়া একটি দল। যে দল আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বিকাশিত হয়েছে। জনগণের সমর্থন আওয়ামীলীগের ভিত্তি। এ দলের মেরুদ- চুরমার করে দেবার জন্য দেশি-বিদেশী ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং হচ্ছে। দৈনিক জনকন্ঠে দেখলাম যে, লন্ডনে লবিস্ট নিয়োগ করেছে বিএনপি-জামায়াত বর্তমান সরকারের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করার জন্য। খবরটির শিরোনাম হচ্ছে, ‘লন্ডনে লর্ড কার্লোইলরা জামায়াত- বিএনপির লবিস্ট।’ এরা লাগাতার ভাবে আওয়ামীলীগ সরকারের বিরোধিতা করে যাচ্ছে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য।
এটা ইতিহাসেই লেখা আছে, আওয়ামীলীগ বরাবর পরাজিত হয়েছে মিডিয়া ক্যু, ভোট ডাকাতি, স্থূল কারচুপি, ষড়যন্ত্র, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ত্ব ও জঘন্য অপপ্রচারের কাছে। ১৯৯১ সালে আওয়ামীলীগ অবশ্যই সুক্ষ্ম কারচুপি এবং সাম্প্রদায়িক অপ প্রচারের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পরাজিত হয়েছিলো। যেমন বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশারফকে হত্যা করা হয়েছিলো ভারতকে জড়িয়ে অপপ্রচার করে।
গত ৫টি সিটি নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থীদের পরাজিত করার ব্যাপারে হেফাজতের অপপ্রচার অমোঘ অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে আওয়ামীলীগ ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার মোকাবেলা করে আসছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিলো দলটিকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র। জনগণের সমর্থন গভীর না হলে দলটি এতদিনে নিশ্চিহ্ন হযে যেতো। শেখ হাসিনা পরাজিত হতে হতে জয়ী হয়েছেন। সৈয়দ মুজতবা আলী এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছেন, ‘জীবনের বহু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বহু অপ্রত্যাশিত আঘাত পেয়েছিলেন। তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের আর্শীবাদ পান, তৎ সত্ত্বেও বাংলাদেশ বহুদিন ধরে তাঁকে কবি বলে স্বীকার করতে চায়নি। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে বহু গণ্যমান্য লোক এমন সব অন্যায় আক্রমণ এবং আন্দোলন চালান যে, রবীন্দ্রনাথকে হয়তো অল্প বয়সে কিটসের মতো ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ইহলোক ত্যাগ করকে হত। রবীন্দ্রনাথ যে বহু বেদনা পেয়েও কিটসের মতো ভেঙে পড়েননি তার অন্যতম কারণ, ধর্মে তার অবিচল নিষ্ঠা ছিল এবং দ্বিতীয়টি মহর্ষি স্বহস্তে রবীন্দ্রনাথের নৈতিক মেরুদ-টি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।’ (গুরুদেব ও শান্তি নিকেতন, বিশ্ব ভারতী, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র- ২০১৩)।
একথা শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তার সুদৃঢ় মনোবল আওয়ামীলীগকে টিকিয়ে রেখেছে। বঙ্গবন্ধু স্বহস্তে শেখ হাসিনার নৈতিক মেরুদ- গড়ে দিয়েছেন। যারা আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনাকে ভূঈঁফোড় ভেবে ইসিকে পরামর্শ দিতে গেছেন, তারাই সন্দেহ বিষে জর্জরিত যে শেখ হাসিনা কারসাজি করে ক্ষমতায় টিকে থাকবেন। সামনের নির্বাচনেই এই সব সুশীলদের অমূলক ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। এই আশা আমরা করি।
Â
< Prev | Next > |
---|