মো. জাহাঙ্গীর আলম খান
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমুদ্র বন্দরগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমানে দেশে তিনটি সমুদ্র বন্দর রয়েছে। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অনেকটাই এ বন্দরগুলোর গতিশীলতা ও কার্যক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল।
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশ এই বন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরের গতিময়তা ধরে রাখতে বন্দরের সর্বস্তরে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে, সংস্কার করা হয়েছে পুরোনো বন্দর আইনের। বর্তমান সরকারের আমলে সূচনা হয়েছে বন্দর অটোমেশন অর্থাৎ ডিজিটাল পদ্ধতিতে কন্টেইনার ট্র্যাকিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ঈঞগঝ)। বন্দরকে গতিশীল করার জন্য সরকারের গ্রহণ করা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের মধ্যে ভেসেল ট্র্যাকিং ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ঠঞগওঝ)-এর মাধ্যমে কর্ণফুলী চ্যানেলে জাহাজের চলাচল ও সার্বক্ষণিক তদারকি নিশ্চিত করা, বন্দরের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে নতুন ইয়ার্ড নির্মাণ অন্যতম।
বন্দরে যাতায়াতকারী ট্রাক/ট্রেইলার স্ক্যানিং করার জন্য ‘টু স্টেজ গেইট’ স্থাপন করা হয়েছে। দুটি বিশেষায়িত জাহাজ ‘অয়েলি ওয়েস্ট ক্লিনার ভেসেল’ এবং ‘সলিড ওয়েস্ট ক্লিনার ভেসেল’ সংগ্রহ করা হয়েছে। বন্দরের জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স শীপ, কন্টেইনার স্ক্যানিং করার জন্য ‘মোবাইল স্ক্যানিং ভেহিকেল’ এবং ক্রেন পরিচালনায় দক্ষ চালক প্রশিক্ষণের জন্য ‘সিমুলেটর’ ক্রয় করা হয়েছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন (৪৫০০ মে. টন) ‘টাগবোট’ নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের প্রথম ‘কার শেড’ চট্টগ্রাম বন্দরে চালু করা হয়েছে। এ শেডে এক সাথে ৯০০ গাড়ি রাখা যাবে। বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের গ্রহণ করা এসকল দূরদর্শী পদক্ষেপের ফলস্বরূপ মাত্র আট বছরে ২২ ধাপ উন্নীত হয়ে বিশ্বের ১০০টি প্রধান বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দররের অবস্থান বর্তমানে ৭৬তম। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক বন্দরগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত, যার কনটেইনার হ্যান্ডলিং-এর হার ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬ সালে ২.৩ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে।
বর্তমান সরকার কেবল বন্দর নয়, বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্টদের উন্নয়নেও কাজ করে যাচ্ছে। বন্দরে কর্মরত শ্রমিকদের ২০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধিসহ গ্রাচ্যুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, কল্যাণ ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন করা হয়েছে এই সরকারের আমলেই। গৃহীত সরকারি পদক্ষেপের কারণে বন্দরের প্রবৃদ্ধি প্রতি বছরে প্রায় ১৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই হারে প্রবৃদ্ধি হতে থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরকে প্রায় ৩০ লক্ষ কনটেইনার হ্যান্ডেল করতে হবে। তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে, গ্রহণ করা হয়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত। এই টার্মিনাল নির্মিত হলে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান সময় কমে আসবে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের এক সুবর্ণ রেখাচিত্র হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। ২০০৮ সালে এর রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার কোটি টাকা আর বর্তমানে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। বন্দর উন্নয়নের পাশাপাশি সরকার নৌ-বাণিজ্যের সাথে জড়িত মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যেও হাতে নিয়েছে বিভিন্ন পরিকল্পনা। বাংলাদেশের নাবিকদের আধুনিক ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে মেরিন একাডেমির আধুনিকায়ন হচ্ছে, বাড়ানো হচ্ছে এর সুযোগ-সুবিধা। এ ছাড়াও নতুন চারটি মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠার কাজ চলমান রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সাথে গ্রহণ করা হয়েছে মোংলা বন্দর উন্নয়নের কার্যক্রম। দেশের দ্বিতীয় প্রধান এই সমুদ্র বন্দর লোকসান করতে করতে এক সময় গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। বর্তমান সরকারের গ্রহণ করা বেশ কিছু পদক্ষেপ এই বন্দরকে আবার সচল করে তুলছে। এর মধ্যে রয়েছে বন্দরের প্রশাসনিক সংস্কার, কর্মপদ্ধতির আধুনিকায়ন এবং নতুন প্রযুক্তির প্রচলন। এই সব পদক্ষেপে মোংলা বন্দরে ফিরে এসেছে প্রাণ, লোকসানের বদলে সূচনা হয়েছে লাভের।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোংলা বন্দরের আর্থিক লাভ হয় প্রায় ৬০ কোটি টাকা। আর ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বন্দর মোট লাভ করেছে ৯৬ কোটি টাকা। এই বন্দরকে আগামীতে আরো গতিশীল করতে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। মোংলার বিভিন্ন চ্যানেলে নাব্যতা বজায় রাখার জন্য সরকার দুটি ড্রেজার কিনেছে, যা এদেশে প্রথম। মোংলা বন্দরের পশুর নদীর নাব্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হয়েছে। বন্দরের জন্য পাইলট বোট, টাগ বোট ক্রয় করা হয়েছে। মালামাল হ্যান্ডলিং এর জন্য দু’টি স্ট্রাডেল ক্যারিয়ারসহ বিভিন্ন ধরণের ১২টি ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়।
-২-
বন্দরে জাহাজ নিরাপদে আগমন-নির্গমনের সুবিধার্থে ‘জ্যাফট’ পয়েন্টে লাইট টাওয়ার পুনঃনির্মাণ করা হয়। দিবা রাত্রি নির্বিঘেœ জাহাজ আগমন ও নির্গমনের জন্য ৬২টি বিভিন্ন ধরনের লাইটেড বয়াসহ বিভিন্ন নেভিগেশনাল যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়। আমদানিকৃত গাড়ি রাখার জন্য সংযোগ সড়কসহ ২টি ইয়ার্ড নির্মাণ এবং ৮০ কিলোওয়াট উৎপাদনোক্ষম সৌর প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। ‘রুজভেল্ট’ জেটিতে দু’টি পন্টুন, দু’টি গ্যাংওয়ে, ছয়টি মুরিং বয়া স্থাপন করা হয়েছে। তিন টন ক্ষমতা সম্পন্ন পাঁচটি ফর্কলিফট ট্রাক সংগ্রহ করা হয়েছে। শুরু হয়েছে মোংলার সাথে সরাসরি রেল যোগযোগ স্থাপনের কাজ। ঢাকার সাথে নদীপথে মোংলার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের জন্য নতুন দুটি স্টিমার নির্মাণ করা হচ্ছে, যেগুলো চলাচল শুরু করবে ২০১৮ সাল থেকে। এই বন্দরের উন্নয়নে সংযুক্ত হচ্ছে পদ্মা সেতু, মোংলা-খুলনা রেল লাইন, খান জাহান আলী বিমানবন্দর ও রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ। এই সমস্ত প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হলে মোংলা বন্দর আরো গতিশীল হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি ও আমদানি বাণিজ্য ক্রমশ বাড়তে থাকায় বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় একটি সমুদ্র বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯ নভেম্বর, ২০১৩ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় পায়রা বন্দরের উদ্বোধন করেন। সরকার এই বন্দরের দ্রুত উন্নয়নের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বন্দরে বসানো হয়েছে পন্টুন এবং ক্রেন। পন্টুন ওপরে উঠানোর কাজে সংযুক্ত করা হয়েছে গ্যাংওয়ে। এছাড়া নেভিগেশন ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং-এর জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তুতি চলছে। বন্দরটিতে কনটেইনার, বাল্ক কনটেইনার, সাধারণ কার্গো হ্যান্ডলিং-এর পাশাপাশি এলএনজি ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের জন্য টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। ১৬ একর জায়গায় বেশকিছু অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। একটি ফেয়ারওয়ে বয়া, ৩০ সেট চ্যানেল বয়া, দু’টি রিভার মুরিং বয়া নদীর জন্য ১২ সেট বয়া সংগ্রহ ও স্থাপনের কাজ শেষ করে সীমিত পরিসরে বন্দরের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
বহিঃনোঙ্গরে বাণিজ্যিক জাহাজ এনে বাল্ক পণ্য হ্যান্ডলিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পায়রা সমুদ্র বন্দর হতে পটুয়াখালী জাতীয় সড়কের পথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য রজপাড়া পায়রা সমুদ্র বন্দর ৫.৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৪ লেনের একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মূল বন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণের লক্ষ্যে ৬,০০০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। পায়রা সমুদ্র বন্দরের মূল চ্যানেলে ক্যাপিটাল ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং এর জন্য বেলজিয়ামভিত্তিক ড্রেজিং কোম্পানি ‘জান ডি নুল’ এর সাথে এম ও ইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে।
২০২৩ সালের মধ্যে পায়রা বন্দর একটি গভীর সমুদ্র বন্দর হিসেবে পুরোদমে কাজ শুরু করবে যার স্পর্শে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠবে অজ¯্র শিল্প কারখানা। সরকার দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে বন্দর সমূহের পাশাপাশি ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতির প্রতিও গুরুত্ব প্রদান করছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০) অনুযায়ী ব্লু-ইকোনমির ধারণাকে কাজে লাগিয়ে গভীর সমুদ্র ও উপকূলে অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা এবং সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ করা হবে। এর মধ্যে দিয়ে দেশের অর্থনীতি হবে আরো গতিশীল, সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান এবং এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
< Prev | Next > |
---|