আর কে চৌধুরী
বঙ্গবন্ধু বাঙালির প্রেরণা। যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হয়েছিলেন, সেই ধানম-ির ৩২ নাম্বারের বাড়িটি জাতির অন্যতম তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির সমগ্র অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছেন। বাংলাদেশের মানুষ ১৫ আগস্ট পালন করছে অশেষ যন্ত্রণা ও বেদনাবোঁধে ভারাক্রান্ত হয়ে, লজ্জায় অধোবদন হয়ে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেশকে ভালোবাসতেন অকৃত্রিমভাবে, দেশের মানুষও তাকে দিয়েছে হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা। তাই খুনি ঘাতকচক্র ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সব চক্রান্ত, চেষ্টা, অপতৎপরতা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এ দেশের মানুষের হৃদয়জুড়ে তার অবস্থান।আর কে চৌধুরী আজ রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট। মহাশোকের দিন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণের দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্যের হাতে সপরিবারে প্রাণ হারান সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতি হারিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এবার পালিত হবে বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস। বঙ্গবন্ধুর সময়ে আমি ছিলাম ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ।
নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম কেমন চলছে? কীভাবে করলে ভালো হবে? কোথায় কী সমস্যা আছে? সেসব বিষয় নিয়ে আমরা (তৎকালীন নগর সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, সহ-সভাপতি ফজলুল করিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রহিম, কোষাধ্যক্ষ আমি আর কে চৌধুরী) নিয়মিত সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতাম। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নাম্বারের বাড়িতে তার সঙ্গে বসি। আলোচনা হয় দীর্ঘসময় ধরে। পূর্বের ন্যায় বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সেদিনও ছিল খুব প্রাণচাঞ্চল্যতা। বঙ্গবন্ধু কখনই ভাবেননি তার করা স্বাধীন বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ঘাতকরা তার ঘনিষ্ঠজনদের ওপর নির্যাতন চালায়। আমাকে হত্যা করার জন্য কয়েকবার আমার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমাকে ৬ মাস আতœগোপনে থাকতে হয়। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যদি লিখতে হয় তবে সর্বপ্রথম লিখতে হবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতা, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পুরোধা এবং বাংলাদেশের জাতির জনক। জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব নামে বেশি পরিচিত এবং তার উপাধি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু। আগস্ট মানেই জাতির বেদনা বিধুর শোকের মাস, এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের নাম।
স্বাধীন বাংলাদেশে এ মাসে নেমে আসে বাঙালি জাতির ওপর এক কালো থাবা। বাঙালির ইতিহাসে কলঙ্কিত এক অধ্যায় সূচিত হয়েছে আগস্ট মাসেই। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাঙালি জাতি পিতৃহত্যার বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হলেও আমাদের প্রতিটি শিরা উপশিরা ও ধমনীতে ঘাতকদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার উদ্রেক করে এ মাস। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক। সেরা মুক্তি সংগ্রামী, সেরা রাষ্ট্রনায়ক। জননন্দিত নেতা হিসেবে তার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও দায়বোঁধ তাকে মহীরূহে পরিণত করেছিল। ব্যক্তি শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। ১৫ আগস্টের ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা পরিবর্তনের যে কালো অধ্যায়ের সূচনা করে তার পরিণতিতে বারবার বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যে সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের বিভেদ নীতিকে বাংলাদেশের মানুষ কবর দিয়েছিল, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলে ১৫ আগস্টের পর থেকে। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে তারা কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। বাংলাদেশের মানুষ খুনিচক্র এবং তাদের দোসরদেও সে ষড়যন্ত্র সফল হতে দেয়নি। ১৯৯৬ সালে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয় দেশবাসীর প্রত্যাশার পরিপূরক হিসেবে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং খুনিদের পাঁচজনের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ৪০ বছর আগে প্রাণ হারিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির এজেন্টদের হাতে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং স্বাধীনতার চেতনাকে মুছে ফেলার অপচেষ্টায় এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে অপরিণামদর্শী ঘাতকরা। অকৃতজ্ঞ ঘাতকরা ১৫ আগস্ট কালরাতে শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, ঘৃণ্য নরপশুরা একে একে হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালকে। জঘন্যতম এই হত্যাকা- থেকে বাঁচতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদূর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি, কর্নেল জামিলসহ ১৬ জন সদস্য ও আÍীয়স্বজনকে। এই শোকের মাসেই বাঙালির স্বাধীনতার স্থপতির বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল স্বাধীন শ্যামল বাংলার মাটি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, ত্যাগ, দূরদর্শিতা এবং অকুতোভয় আপোসহীন নেতৃত্বে দেশ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল। বাঙালি জাতি পেয়েছিল হাজার বছরের আকাক্সিক্ষত প্রিয় স্বাধীনতা, স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন মানচিত্র। বজ্রকণ্ঠে তিনি ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে রক্তনদী পেরিয়ে অর্জিত হয়েছিল মহার্ঘ স্বাধীনতা। আজ ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নির্মম ও কলঙ্কজনক অধ্যায়ের দিন। পচাত্তরের এই দিনে যা ঘটেছিল তা মানবেতিহাসের ঘৃণ্যতম অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সর্বোপরি গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি এ ঘটনা ছিল ভয়ঙ্কর কুঠারাঘাত। বঙ্গবন্ধু বাঙালির প্রেরণা। যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হয়েছিলেন, সেই ধানম-ির ৩২ নাম্বারের বাড়িটি জাতির অন্যতম তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির সমগ্র অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছেন। বাংলাদেশের মানুষ ১৫ আগস্ট পালন করছে অশেষ যন্ত্রণা ও বেদনাবোঁধে ভারাক্রান্ত হয়ে, লজ্জায় অধোবদন হয়ে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেশকে ভালোবাসতেন অকৃত্রিমভাবে, দেশের মানুষও তাকে দিয়েছে হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা। তাই খুনি ঘাতকচক্র ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সব চক্রান্ত, চেষ্টা, অপতৎপরতা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এ দেশের মানুষের হৃদয়জুড়ে তার অবস্থান।
আর কে চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ
(সংকলিত)
< Prev | Next > |
---|