motamottএ.কে.এম শামছুল হক রেনু

৭৪ সালের জরুরী আইন, ৭৫ ও ৮২ সালের সামরিক আইন, ২০০২ সালের অপারেশন ক্লিনহার্ট ও ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের সময় জিআর (খয়রাতি), টিআর (টেস্ট রিলিফ), কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য), কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) আত্মসাৎকারীদের কী অবস্থা হয়েছিল তা কারো না জানার কথা নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এত কিছুর পরও অনেকেই এই দুর্বিষহ প্রবণতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়নি বলে আজো টিআর, জিআর, কাবিখা, কাবিটা ও কর্ম সৃজন প্রকল্পের আত্মসাৎকৃত ভূয়া প্রজেক্টের প্রকাশিত সংবাদ দেখে অনেকেরই অবাক হতে হয়।

এরই মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলার একটি উপজেলার অধিবাসী নাম ঠিকানা প্রকাশ না করে সুশীল সমাজের দাবীদার জনৈক ব্যক্তি চিঠির মাধ্যমে জিআর, টিআর, কাবিখা, কাবিটা ও কর্মসৃজন প্রকল্পের অনিয়ম ও আত্মসাতের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন এই সমস্ত প্রজেক্টের নামে জনৈক পিআইও (প্রজেক্ট বাস্তবায়ন কর্মকর্তা) এমনই শক্তিশালী বলয়ের লোক বলে তার কোন ভয়ভীতি আছে বলে কিছুই মনে হয় না। পিআইও সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউএনও থেকে শুরু করে ডি.আর.আর.ও, এডিসি, জেলা প্রশাসক সহ দূর্নীতি দমন কমিশন কে (দুদক) মোটেই আমলে নেয়নি। এই সুযোগে একটা চিহ্নিত দূর্নীতিবাজ চক্র (সিন্ডিকেট) পিআইওর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে জিআর, টিআর, হালুয়ার মতো গলধঃ করণ করতে এবং যা করার তা করতে যেমনি কুন্ঠাবোধ করছেনা, তেমনি বাদ প্রতিবাদ কোন কিছু আমলেই নিচ্ছেনা। চিঠিতে আরো বলা হয়, সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্য নাকি, পিআইওর কাছের লোক এবং উক্ত সংসদ সদস্যের কারণেই নাকি উক্ত পিআইও ন্যাক্কারজনক পিচ্ছিল (দূর্নীতি) পথ বেছে নিতে এলাকার জনগণ ও প্রশাসনকে তোয়াক্কা না করেই ধরাকে সরা মনে করে নির্বিবাদে তা করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিরাট ফিরিস্থসহ ডাকযোগে চিঠিটি প্রেরণ করলেও চিঠি প্রেরকের নাম ঠিকানা না থাকার কারণে এ সমস্ত দূর্নীতির সাথে দায়ী ও জড়িতদের নাম পদবী দেয়ার ইচ্ছা থাকাস্বত্বেও সম্ভব হয়নি। তবে পত্র প্রেরক তার নাম উল্লেখ না করার পেছনে বারংবার তার বিভিন্ন সমস্যা ও অজুহাতের কথাও তুলে ধরেছেন। যা খাটো করে দেখার সুযোগ পরাহত। ইতিহাস বড়ই নির্মম ও নিষ্টুর। ইতিহাস কাহাকেও ক্ষমা করেনা। একদিন আগে হোক, পরে হোক ইতিহাস সবকিছু কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নিতে পিছপা হয়নি। যার উদাহরণের অন্ত নেই। ঞযধঃ হড়নড়ফু ঃধশবং ষবংংড়হ ভৎড়স যরংঃড়ৎু রং রঃংবষভ ধ ষবংংড়হ ড়ভ যরংঃড়ৎু অর্থাৎ কেউ যে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, সেটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
চলমান পাতা/২
পাতা: ২

অনেকেই বলে থাকে গম যেমন পুষ্টিকর খাদ্য তেমনি গম পঁচা গন্ধ জীবজন্তু ও মানুষ পঁচার মতো দুর্গন্ধযুক্ত। তাই যারা জিআর, টিআর, কাবিখা ও কাবিটার প্রজেক্টের গম, চাউল হজম করে থাকে তাদের নাড়ি ভূড়ি যেমনি মজবুত তাদের (ঝধভবঃু মঁধৎফ) সেফটি গার্ড ও প্রভাবপত্তিও নাকি তাকে খুবই মজবুত ও বুলেট প্রুফের মতো আচ্ছাদনে পরিবেষ্টিত। এ শ্র্রেনীটা ক্ষমতার আঁচড়ে আচ্ছাদিত থাকে বলে দুর্নীতি দমন বিভাগের ১৯৪৭ সালের ২ নং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা, দন্ডবিধির ৪০৯ ও ৪২০ ধারাকে আমলেই নেয়নি। (প্রতারণামূলকভাবে আত্মাসাৎ) ৭৪, ৭৫, ৮২, ২০০২ ও ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের একদিন আগেও এ শ্রেণীটা ভাবতে পারেনি দেশে এ ব্যাপরে আইন রয়েছে। যদিও সে সময়ে আইন ও বিচার ব্যবস্থার হাত থেকে অনেক দুর্নীতিবাজরা রেহাই পায়নি। অনেকেই নিজেকে বাঁচানোর জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে ট্রুথ কমিশনের মাধ্যমে যেমনি সরকারী কোষাগারে কোটি কোটি টাকা জমা দেয়, তেমনি অনেকেই আদালতে আত্মসম্পর্ণ করে থাকে। জনশ্রুতি আছে এক সময় নাকি শেখ মুজিবুর রহমান আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বিদেশ থেকে আমি দেশের মানুষের জন্য ভিক্ষা করে সাহায্য আনি, আর চাটার দলে তা চাইট্যা খায়। তাদের কোন দল নেই, দর্শন নেই, আদর্শ নেই। ওদের পরিচয় ওরা যেমনি মানুষের রক্ত চুষক তেমনি লুটে পুটে খাওয়া দুর্নীতিবাজ। তেমনিভাবে জিয়াউর রহমানও বলতেন দুর্নীতিবাজদের কোন রাজনীতি বা দর্শন নেই। দুর্নীতির কারণে শ্বাস প্রশ্বাসের রোগীর মতো (জবংঢ়রৎধঃরড়হ) সমস্যা নিয়েই তাদের বেঁচে থাকতে হয়। এসব কথার তাৎপর্য মূল্যায়ন জাতীয় জীবনে আজো চিরস্মরণীয় ও অম্লান হয়ে থাকার মতো উপাত্ত হিসেবে মনে করার মতো দিক দর্শন বলা চলে। তাতে শিক্ষা লাভ ও আত্মসুদ্ধির অমূল্য উপদেশ রয়েছে বলে সুশীলজনরা বলে থাকে। যদিও চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী।

সাবেক সেনাপ্রধান, সাবেক তত্ত্বাবধায়কের উপদেষ্টা ও দুদক চেয়ারম্যান লেঃ জেঃ (অব:) হাসান মশহুদ চৌধুরী এক সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে “এখনই সময়” শ্লোগান দিয়ে দেশব্যাপী চষে বেড়িয়েছেন। বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান ইকাবল মাহমুদও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথেষ্ট সোচ্চার বলে অনেকেই মনে করে থাকে। তবে দুর্নীতি দমনে দুদক চেয়ারম্যানের আশে পাশে আছে তাদের মধ্যে অনেকের ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য অনেকেই মন্তব্যও করে থাকে। যদিও ইতোমধ্যে দূর্নীতিবাজ ও দুদকের অনেকের বিরুদ্ধে সময়োপযোগী ও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে দুদক যথেষ্ট সুনামের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

২৪ জুলাই দৈনিক প্রতিদিন প্রথম পাতায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে প্রকাশিত টিআর, কাবিখা, কারা নেয়, কী করে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জিআর (রিলিফ) বরাদ্দ নিয়ে লুটপাট শিরোনামে একটি নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন অনেকেরই দৃষ্টিতে এসেছে। জানা যায়, সিলেটের বিশ্বানথ উপজেলার খাজাঞ্চি ইউনিয়নের ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৩০টি টিআর, কাবিখা, কাবিটা প্রকল্পে ৩০ লাখ ৯৩ হাজার, ৭৭৬ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু এখানে অনেক প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা তোলা হয়েছে। বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলায় ২০১৬-২০১৭ বছরের গ্রামীন অবকাঠামো রক্ষনাবেক্ষন প্রকল্পের কাজ না করে ৩০ লক্ষ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। শুধু এ দুটো ঘটনাই নয়, জানা যায় গ্রামীন দরিদ্র ও দুদর্শাগ্রস্থ মানুষের দুর্দশা লাঘবে টিআর, কাবিখা কর্মসূচীতে বরাদ্দের বেশীর ভাগই চলে যায় প্রভাবশালীদের পেটে। সর্বত্র প্রশ্নের পর প্রশ্ন টিআর, কাবিখা, কারা নেয়? কী করে? কারা লুটেপুটে খায়। জানা যায় বরাদ্দকৃত গম, চাউল ও অর্থের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের কোন কাজ হয় না। অনেক সময় নাকি শত ভাগই লাপাত্তা হয়ে যায়। উপজেলা পর্যায়ে গড়ে উঠেছে লুটেপুটে খা সিন্ডিকেট। ওরা বিভিন্ন এমপির ভূয়া ডিও দিয়েও কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নাকি হাতিয়ে নিতে কুন্ঠাবোধ করেনি।

গাইবান্ধার টিআর, কাবিখা, কাবিটা, প্রকল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সৌরবিদ্যুৎ (সোলার প্যানেল) গ্রামীন জনপদের উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে ভূয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ। জানা যায়, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নূরন্নবী সরকার, এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী সহ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ২৩ লক্ষ, ৫ হাজার, ২৮৯ টাকা ৮ পয়সা। এদিকে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে এমপির বিশেষ বরাদ্দের আত্মসাতের মামলায় অন্যান্যদের মধ্যে আসামী রয়েছে পিআইও (চৎড়লবপঃ রসঢ়ষবসবহঃরড়হ ড়ভভরপবৎ) নূরুন্নবী সরকার। জুন ক্লোজিংয়ের টিআর, কাবিখা, কাবিটার আত্মসাতের ব্যপারে লালমনিরহাটে ১০ কোটি টাকার আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ৩টি সংসদীয় আসনে সংসদ সদস্যদের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে টিআর কর্মসূচীর আওতায় ২ কোটি, ৩০ লক্ষ, ৫৫ হাজার, ৩৩৮ টাকার বিপরীতে প্রকল্প ধরা হয় ৩৭২ টি। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কাজের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৭০ ভাগ। তাছাড়া ধর্মীয় অনুষ্টানের নামে জি.আর (খয়রাতি) নিয়েও রয়েছে তোগলকি আত্মসাতের কর্মকান্ড। যা দৈনিক প্রতিদিনে ২৪
চলমান পাতা/৩
পাতা: ৩

জুলাই প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায়, ওয়াজ মাহফিল ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নামে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জি.আর (রিলিফ) বরাদ্দ হয়ে থাকে। মাগুরা জেলাতেই এ সমস্ত অনুষ্ঠানে ১ হাজার ৭৭৬ টি ওয়াজ মাহফিল ও হিন্দুদের নামযজ্ঞ অনুষ্ঠানের জন্য ২৪ কোটি টাকার জিআর (রিলিফ) বরাদ্দ হয়েছে। যার ৯৫ ভাগই ভূয়া বলে জানা গেছে। বিশেষ বরাদ্দের জন্য এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানের প্যাডে আবেদন করা হয়ে থাকে। কিছু ব্যক্তি ও প্রভাবশালী নেতার কারণে নাকি এ সমস্ত প্রজেক্টের কাজ মুখ তোবড়ে পড়ে রয়েছে। তাই জিআর, টিআর, কাবিখার ভোক্তভোগীরা আক্ষেপের সূরে বলছে, ওসব দেদারছে খাবি তো খা কুছ নেহি পরোয়া। অনেকে বলছে, বাপ দাদার মালের মতো জিআর, টিআর, লুটেপুটে হালুয়াছে খাবিতো খা কুছ নেহি পরোয়া ইত্যাদি।

৪ আগস্ট দৈনিক যুগান্তরের শেষ পৃষ্ঠায় লক্ষ্য করলে দেখা যায় সুনামগঞ্জের হাওরে দুর্নীতি নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতি, ত্রাণ সচিব, পাউবোর ১৫ কর্মকর্তা, ৪৬ ঠিকাদার ও ৭৮ জন পিআইসি সদস্যকে আসামী করে ১৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করলে বিচারক মামলাটি আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলেও পাউবোর বাঁধ ভেঙ্গে বিরাট এলাকা জলমগ্ন হওয়াতে বোরো ফসরের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সর্বশেষ জানা যায়, সুনামগঞ্জের হাওরের দুর্নীতি মামলা থেকে ত্রাণ সচিবের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

তাতে দেখা যায়, এত কিছু করে অনেক সময় পার পাওয়া যায় না বলেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সামরিক, বেসামরিক সরকারের সময় শুধু জিআর, টিআর, কাবিখা, কাবিটা ও কর্ম সৃজন প্রকল্পের আত্মসাৎকারীরাই কেন, দুর্র্নীতি সাম্রাজ্যের অনেক প্রভাবশালীরা আইন ও বিচারের কাছ থেকে রেহাই পায়নি। নিবন্ধে উল্লেখিত চিঠি লেখকের নাম না জানা পিআইও, দৈনিক প্রতিদিনের কলামে উল্লেখিত পিআইও, অন্যান্য ও সমাজের যে কেহই রাষ্ট্রীয় গরিবের হক ও উন্নয়নের সম্পদ লোপাটের সাথে জড়িতদের এ ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হবেনা, তা কেহ বিশ্বাস করে না। দেশ সংবিধান, আইন, বিচার, নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। যারা আইনের তোয়াক্কা না করে উপজেলা জেলার প্রশাসনকে যারা আমলেই নেয় না, তাদের পরিণতি দেশের মানুষ কখনও ভালো দেখেনি। রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ নিজস্ব গতিতে চলে বলেই দুর্নীতিবাজদের চেহেরা সিসি ক্যামেরার মতো কারো চোখকে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকে না। তাই কথায় বলে পাপী কখনও দুনিয়া থেকে শাস্তি ছাড়া বিদায় হয়না। সময়, সুযোগ ও প্রেক্ষাপট কারো জন্যই এক জায়গায় স্থির থাকে না বলে দুনিয়ার অনেকেই কৃতকর্মের পরিণতি থেকে নিজেকে অবমুক্ত রাখতে সচেষ্ট হয়নি।


এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট

সাম্প্রতিক