motamottমাহমুদুল বাসার
ফুটপাতে ফুলের গল্প

পরাধীন দেশের আদালত ন্যায় বিচার কায়েম করতে পারে না, এমন দৃষ্টান্ত পেয়েছি দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকে, মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকে, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে এবং তাঁর ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে। পরাধীন দেশে কোনো বিচার ব্যবস্থা থাকে না বলেই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেছেন,‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।’

পাকিস্তানি শাসকরা কৃষক নেত্রী ইলামিত্রের ওপর যে অত্যাচার করেছিলো, তাঁর মতো সংগ্রামী নারীর গুপ্ত অঙ্গের ভেতর সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো, পাকিস্তানের আদালত তার জন্য কিছুই করে নি বা করতে পারে নি। রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি চালিয়ে রাজবন্দীদের নির্বিচারে হত্যা করেছিলো পাকিস্তানি পুলিশ,তাতে পাকিস্তানি আদালতের কিছুই করণীয় ছিলো না। পরাধীন দেশের আদালত পরাধীনই হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে কায়েম হয়েছিলো এক ধরনের পাকিস্তান মডেলের সরকার, এ জন্য জেল খানায় জাতীয় চার নেতাকে বর্বরোচিত ভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত ১৫ আগস্ট ও জেল হত্যার কোনো বিচার হয় নি। এতবড় বর্বর ঘটনায় আদালতের আইন নিজস্ব গতিতে চলে নি।

দেশ স্বাধীন করেছেন রাজনীতিবিদরা। প্রথাবিরোধী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘স্বাধীনতা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন শেখ মুজিব, আমরা তা মেনে নিয়েছিলাম।’ বলা দরকার যে, বাংলাদেশ সংসদীয় রাজনীতির ধারায় স্বাধীন হয়েছে। ইয়াহিয়া এবং ভূট্টো ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেয় নি বলেই আমাদের যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হয়েছে। জাতীয় সংসদ জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দিয়ে থাকে জাতীয় সংসদ। জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বই দেশের সার্বভৌমত্ব। ১৯৭১ সালে ভারতের পার্লামেন্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলো। আর পাকিস্তানকে যুদ্ধ ঘোষণার উস্কানি দিয়েছিলো সেনাবাহিনী। এই সেদিনও পাকিস্তানের আদালত সেনাবাহিনীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। বিচার বিভাগকে জাতীয় সংসদ স্বাধীনতা না দিলে তার কিছু করার থাকে না। পরাধীন দেশে জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব যেমন থাকে না, তেমনি বিচার বিভাগেরও স¦াধীনতা থাকে না। ইংরেজ অধিকৃত ভারতে কোনো ইংরেজ অপরাধীর বিচার হতো না, আদালত শাস্তি দিতে পারতো না। পাকিস্তানের বেলায়ও একই কথা খাটে। গণ অভ্যুত্থান না হলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে বঙ্গন্ধু সহ ২৪ জন বাঙালির ফাঁসি হয়ে যেতো। অথচ কাদিয়ানি হত্যার নায়ক মওলানা মওদুদীর কোনো বিচার করেনি পাক আদালত। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে কুখ্যাত ইনডেমনিটি এ্যাক্ট বাতিল করেছেন। নাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতো না।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশের আদালত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অধীন। বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা দেয়া হয় দেশে ন্যায় বিচার কায়েম হওয়ার স্বার্থে, যেন কোনো সরকার বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করে ন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করতে না পারে। এটা একটি স্বাধীন দেশের বৈশিষ্ট্য যেমন তেমন একটি গণতান্ত্রিক সরকারেরও বৈশিষ্ট্য। ফ্যাসিবাদী সরকার, সামরিক সরকার কখনো আদালতের বিচার বিভাগের স¦াধীনতা দেয় না।

১৯৭১ সালে প্রথম দিকে বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী বেলুচিস্তানের কসাই জেনারেল টিক্কাখানকে গভর্নর হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করাননি। তখন বঙ্গবন্ধুর কথায় দেশ চলে। কিন্তু ক্র্যাকডাউনের পর বিচারপতি সিদ্দিকী ঠিকই টিক্কাখানকে শপথ পড়িয়েছিলেন। তা হলে বুঝুন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে গঠিত জাতীয় সংসদ কর্তৃক। মুজিব নগরে কোনো আদালত ছিলো না। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আদালত স্বাধীনতা ঘোষণা করে নি, স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্যই আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চাই, ন্যায় বিচার চাই। কিন্ত সংসদকে কনডেম করে কেন?
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সংসদের ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন। তিনিই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেছিলেন। তিনি সংসদকে রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করেছিলেন। সংসদের ৫ম সংশোধনী বাতিলের মধ্যে দিয়ে জিয়ার প্রায় সমগ্র সিদ্ধান্ত এবং তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনও অবৈধ হয়।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ রাজনীতি মুক্ত নয়। প্রতিবছর আদালতের আইনজীবীরা দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন করে থাকেন। দেশের আদালত প্রাঙ্গণে যে ভাবে দলকেন্দ্রিক রাজনীতির চর্চা হয়, শ্লোগান হয়, সংঘর্ষ হয়, তা দেখে আমরা হতাশ না হয়ে পারি না। যাঁরা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেয়ার পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তাঁরা রাজনীতির উর্ধে নন। এ কারণেই এই রায়ের পর আওয়ামীলীগ হতাশ হয়েছে, বিএনপি খুশি হয়েছে। বিএনপির নেতারা সরকারের পদত্যাগ দাবি করছেন ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়াতে। জাতীয় সংসদ বনাম আদালতের মতপার্থক্য আমাদের ভাবিত করে তুলেছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর প্রথমে সংসদ উত্তপ্ত হয় তারপর মন্ত্রীসভা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দেশের জনগণ এতে বিব্রত হচ্ছে। প্রধান বিচার পতি জাতীয় সংসদকে ‘ইমম্যাচিউর’ বলেছেন। এতে দেশের প্রকৃত মালিক যে জনগণ তারা খুশি হননি। বাংলা ভাষার একজন বড় লেখক মোহিত লাল মজুমদার বলেছেন, ‘সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর।’ দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচার পতির একটু মেপেই কথা বলা উচিত। তাঁদের কথার দ্বারা জনগণ প্রভাবিত হয়। প্রধান বিচার পতি নিযুক্ত হন রাষ্ট্রপতি দ্বারা, রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন সংসদের দ্বারা। সেই সংসদকে ‘ইমম্যাচিউর’ বললে নিজের গায়ে এসে পড়বে। জাতীয় সংসদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, আদালত রাষ্ট্রের অংশ। যে সংসদে সংবিধান প্রণীত হয়েছে, সেই সংবিধান মেনে আদালতের কার্যক্রম চালাতে হয়। ১৯৭১ সালে একটি গান রচিত হয়েছিলো, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা।’ এ গানের তাৎপর্য অনেক। জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। তাই সকল ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু জাতীয় সংসদ। সংসদের সার্বভৌমত্ব না থাকলে আদালতেরও স্বাধীনতা থাকে না।

আদালতের রায়ের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেতুমন্ত্রী, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রশংসনীয় সংযমী বক্তব্য রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘অনেকের আপত্তি সত্বেও অনেক শখ করে প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিয়েছিলাম।’ (জনকণ্ঠ-৮/৮/১৭)। তারপর বলেছেন, ‘আপনারা আপনাদের মত দেবেন। এই রায়ের বিষয় নিয়ে আপনারা জনগণের কাছে যাবেন। তাদের সেন্টিমেন্ট পর্যবেক্ষণ করে কথা বলবেন। ’(ঐ)।
নিশ্চয়ই মাপা কথা। এ কথায় অসহিষ্ণুতা নেই। আর প্রধান বিচার পতির সংসদ সম্পর্কিত মন্তব্য সম্পর্কে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি তার রায়ে বলেছেন, সংসদ ইমম্যাচিউর। এটাতো তাহলে প্রধান বিচারপতির নিজের উপরই পড়ে। কারণ, এই সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন রাষ্ট্রপতি। আর রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন প্রধান বিচারপতি। তাহলে প্রধান বিচারপতি কি এর উর্ধে?’ (জনকণ্ঠ-৮/৮/১৭)।
মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় ফাঁক নেই। পাকিস্তানের জঙ্গীলাট আইয়ুব খান একবার মহিয়সী কবি বেগম সুফিয়া কামালের সামনে বলেছিলেন, ‘বাঙালিরা হায়েন।’ সঙ্গে সঙ্গে কবি সুফিয়া কামাল প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি তা হলে হায়েনদের রাষ্ট্রপতি?’ আইয়ুব এর কোনো উত্তর দিতে পারেন নি। কথাটি বর্তমান প্রেক্ষিতে মনে পড়লো।

মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক ও গবেষক

সাম্প্রতিক