মোমিন মেহেদী
দুর্নীতি দমন কমিশন-এর একটি পোস্টার চোখে পড়লো। সেই পোস্টারে উল্লেখ করা হয়েছে- ৭১ সালে বাঙালির চাহিদা ছিলো ‘রাজাকারদের হত্যা’ এবং ১৭ সালে বাঙালির চাহিদা হলো- ‘দুর্নীতি প্রতিরোধ’। ১৯৭১ থেকে বর্তমান অবধি ৪৭ বছরের রাজনৈতিক কর্মকান্ড এতটাই উগ্র আর অন্ধকারের রাস্তায় অগ্রসর হয়েছে যে, জনগন নিজেদের অধিকার নিয়ে একটা দিনও ভালো চলতে পারে নি। মৌলিক অধিকার বঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য নূন্যতম ভাবনাতেও থাকেনি আমাদের দেশের রাজনীতিকগণ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে ক্রমশ সমস্যা জর্জরিত হয়ে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে পাকিস্তান আমাদের অধিকার হরণের রাস্তায় অগ্রসর হতে হতে ১৯৭১ থেকে ক্রমশ এতটাই এগিয়েছে যে, জুলাই মাসের ২৮ তারিখে দুর্নীতির রাজত্বের রাজা নেওয়াজ শরিফ অভিযোগের পরপরই লজ্জায়-অপমানে পদত্যাগ করেছেন।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির মামলায় পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত অযোগ্য ঘোষণার পর পদত্যাগ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। সর্বোচ্চ আদালতের এ সিদ্ধান্তে নওয়াজের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ স্বভাবতই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই আরও একজন সরকার প্রধানের পদত্যাগের ঘটনা পাকিস্তান জুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। নওয়াজ শরিফকে সরানোর নেপথ্যে কে বা কারা- এ প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে। পাকিস্তানের স্বাধীন বিচার বিভাগ কি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই নওয়াজকে অযোগ্য ঘোষণা করল? নাকি এর পেছনে কোনো প্রভাব কাজ করেছে? এ প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে আসছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে। নওয়াজ সমর্থকদের একটি বড় অংশ মনে করে, নওয়াজকে সরানোর নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন জেনারেলরা। কারণ পাকিস্তানে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব চিরায়ত। পাকিস্তানে কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা হোক, এটি কখনোই চায়নি দেশটির সেনাবাহিনী। তাই আগের ১৭ সরকার প্রধানের মতোই মেয়াদ শেষ না করেই পদত্যাগের মতো বিষাদের পরিণতি মেনে নিতে হল নওয়াজকে।
গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্তের পর সুপ্রিমকোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মত এক রায়ে নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করেন। নওয়াজের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারকেও দায়িত্বে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ। এর আগের দুইবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান নওয়াজ। প্রথমবার ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালেও দুর্নীতির দায়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় নওয়াজকে। এবারও মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার মাত্র এক বছর আগে নওয়াজকে সরিয়ে দেয়া হল। বিবিসি লিখেছে, নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল।
তার আগের ১৭ জন প্রধানমন্ত্রীর কেউই তাদের পুরো মেয়াদ কখনও দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তবে আমি মনে করি, নওয়াজ শরিফকে দিয়েই দুর্নীতির চক্র ভাঙার কাজ শুরু করলেন দেশটির উচ্চ আদালত। আবার কারও কারও ধারণা, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে প্রক্রিয়ায় যুগের পর যুগ বেসামরিক প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে, এটা তারই একটি অংশ। দুর্নীতির চক্র ভাঙার বদলে এ রায় আসলে একদল নতুন লোকের রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণের পথ খুলল, যেমনটা অতীতেও হয়েছে। অন্যদিকে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রভাবেই সুপ্রিমকোর্ট নওয়াজের অবৈধ ঘোষণার চিত্রনাট্য লিখেছে। জেনারেলরাই এর নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী দেশ পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি বলে যে, নওয়াজের এ পরিণতির পেছনে দেশটির কিছু সংখ্যক রাজনীতিবিদও জড়িত। এরমধ্যে রয়েছেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান।
সুপ্রিমকোর্টের রায়ে নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণায় পাকিস্তানে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। সুপ্রিমকোর্টের ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে তা শুরু হল। ইমরানের সমালোচনাও হচ্ছে। পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মির অবশ্য এক টুইটারে লিখেছেন, এ রায় পিটিআইয়ের জন্য নতুন শুরু। তবে তাদের খুব বেশি উদযাপন করা ঠিক নয়। কারণ শিগগিরই আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন দফতর ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অনেক সময় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির পক্ষ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোনো ব্যাখ্যা কিংবা বক্তব্যও দেয়া হয় না।
পাকিস্তানে নিকৃষ্টতম দুর্নীতির রাস্তায় অগ্রসর রাষ্ট্রপ্রধান যখন নীতিহীনতার কারনে অযোগ্য হওয়ার পর পদত্যাগ করেছে, তণ মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৪৭ বছরে রাজনীতিকে পূঁজি করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিণত হয়েছে ৩৩ লক্ষ রাজনীতিক-আমলা। সারাদেশে এ অবস্থায় দুর্নীতিবাজদের ধরতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হটলাইন চালু খারাপ কিছু নয়, তবে মনে রাখতে হবে শুধু চুনোপুঁটিদের ধরলে হবে না। সমাজের বড় বড় রাঘববোয়ালদের শক্ত ভাবে ধরতে হবে বলেই ‘নতুনধারার অঙ্গীকার দুর্নীতি থাকবে না আর’ শ্লোগানকে লালন করে এগিয়ে চলা রাজনৈতিক আন্দোলন নতুনধারার রাজনৈতিক দল নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবির নেতাকর্মীরা মনে করে। এখানে এই বিশ্বাসে স্বাধীনতার স্বপক্ষের লক্ষ লক্ষ রাজনীতিক এগিয়ে চললেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্য হলো- দুর্নীতি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। যাদের ক্ষমতা আছে তারাই দুর্নীতি করে। পরোক্ষভাবে আমরা সবাই দুর্নীতিতে জড়িত। মুহিত বলেন, খুব তাড়াতাড়ি এ দুর্নীতি শুধরে ফেলা সম্ভব নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মী হিসেবে মনে করি- ‘যাদের হাতে ক্ষমতা তারাই দুর্নীতি করে’- শুধু এমন বক্তব্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজ কারা তা স্পষ্ট করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থাও নিতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়। এসব টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে যায়। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এছাড়া সরকারি বড় বড় প্রকল্পগুলোতে বড় দুর্নীতি তো আছেই।
সবচেয়ে আলোচিত যে বিষয়, সেটি হলো- যারা ক্ষমতাবান, তারা দুর্নীতিবাজ এটা অত্যন্ত একটা সরল সমীকরণ। সবক্ষেত্রে এটি সত্য নয়। সমাজে অনেক ক্ষমতাবান লোক আছেন, এমনকি মন্ত্রী পর্যায়েও অনেক আছেন, যারা দুর্নীতি করেন না। তাই ঢালাওভাবে সবাইকে দুর্নীতিবাজ বলা ঠিক হয়নি। এতে করে বড় দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া দুর্নীতি বন্ধ হোক, এটা তিনি (অর্থমন্ত্রী) নিজেও চান না। না হলে অর্থমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তিনি কোনো পদক্ষেপ নিলেন না কেন? তিনিও তো একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা মন্ত্রী। তার মানে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্নীতিবাজদের প্রতি সহনশীল। এটাও কিন্তু এক ধরনের দুর্নীতি। এ সমীকরণে তিনি নিজেও একজন দুর্নীতিবাজ হয়ে যাচ্ছেন। তাই গণহারে সবাইকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দেয়ার বক্তব্য সমর্থন করি না। কারণ এ সমাজে বেশিরভাগ মানুষ সৎ। কিছু মানুষ অসৎ আছে। বাস্তবতা হল, দুর্নীতির কথা বললেও দুর্নীতি প্রতিহতের কোনো অঙ্গীকার নেই। এমন পরিস্থিতিতে সরাসরি বলতে চাই যে, এ বক্তব্যের মাধ্যমে পুরো দেশকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করলেন অর্থমন্ত্রী। অথচ তিনি এখনও বহুল আলোচিত সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি ও বেসিক ব্যাংকে লুটপাটকারীদের পুরোপুরি বিচারের আওতায় আনতে পারেননি। তাদের বিরুদ্ধে জোরালা কোনো বক্তব্য বা অবস্থানও নেই তার। উল্টো সবাইকে গণহারে দুর্নীতিবাজ বলছেন। এতে সুনির্দিষ্ট এবং নানাভাবে প্রমাণিত শীর্ষ দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে যাবে। দুর্নীতি দমনে দেশে নতুন আইনের প্রয়োজন নেই। কারণ এগুলো এক ধরনের ‘আইওয়াশ’। দেশে প্রচলিত আইনের বাস্তবায়ন হয় না। পুরনো সব আইন কার্যকর করা হোক। তাহলে দুর্নীতিসহ সব অপকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে যে, জনগন কিন্তু জানে- আমাদের রক্ষকরাই ভক্ষক। তাই সরকার যদি মেরুদন্ড শক্ত করে না দাঁড়ায় তাহলে সবই কথার কথা বলে প্রতীয়মাণ হবে। বাস্তবে কিছুই হবে না। আর তা দুর্নীতি দমনের নামে এক ধরনের তামাশা বলে বিবেচিত হবে। বর্তমানে আর্থিক খাতে বেশি লুটপাট হচ্ছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্তরা এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি এবং উপদেষ্টা, জাতীয় শিক্ষাধারা
Â
< Prev | Next > |
---|