সালেহা চৌধুরী
আমার সবচেয়ে অবাক লেগেছিল হুমায়ূন আহমেদের সাদাসিধা জীবনযাপন। বাড়িতে কোনো দামি আসবাব ছিল না। বসার ঘরে একটা দুটি সোফা আর মেঝেতে মাদুর। লোকজন এসে সেই মাদুরে বসত। শোবার জন্য কোনো বিলাসী পালং দেখিনি। শেষবার তিনি আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন তার মেঝের বিছানা। একটা তোশকের ওপর বিছানা পাতা। পাশে শাওন আর বাচ্চাদের শোবার জায়গা। দামি কোনো খাবার টেবিল দেখিনি। শাওন একবার একটা ভালো দেখে কাঠের টেবিল আর চেয়ার কিনে এনেছিল খাওয়ার জন্য। এটুকুই। এমন সাদাসিধা জীবন আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। মনে আছে, যেদিন প্রথম তার বাড়িতে যাই মনে মনে রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর দুই লাইন কবিতা তৈরি করছিলাম তাকে শুনিয়ে দেওয়ার জন্য। কারণ, শুনেছিলাম তিনি বই লিখে কোটি কোটি টাকা অর্জন করেছেন। ভাবছিলাম তাকে শোনাব- 'ইফ' কবিতার সেই লাইন 'ওয়াক উইথ দ্য কিং/ বাট নেভার লুজ দ্য কমন টাচ।' সেটা বলিনি। কারণ তার জীবনযাপনে যে 'কমন টাচ', তা কোনো রাজার কথা মনে করিয়ে দেয় না। মনে করিয়ে দেয় খুব সাধারণ একজন মানুষের কথা। মেঝেতে বসে টুলে লেখা। সেখানেও তেমন বিলাসী কোনো ব্যাপার নেই।
কাছে থেকে দেখা মানুষের ভেতর তিনি সত্যিই একজন অসাধারণ মানুষ।
মুনীর চৌধুরী স্যারকে কাছে থেকে দেখেছিলাম দুই-একবার। আমরা তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাসা করেছি। নিচতলায় থাকেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান স্যার। ডলি আপা ও স্যারের বাড়িতে এলেন মুনীর চৌধুরী। আমি বুঝতে পেরে পড়ি কি মরি নিচে নেমে এলাম। দেখলাম মুনীর স্যার মনিরুজ্জামান স্যারকে বলছেন- এই যে রেললাইনের ওপারে নানা সব দোকান; সেখানে কোথায় কোন খাবার পাওয়া যায়; কোথায় শিঙ্গাড়া, কোথায় জিলাপি, কোথায় খাসির মাংস রান্না, কোথায় পায়া এসব। আমার তো চোখ গোল হয়ে গেছে। তিনি আশপাশের দোকানের এত খবর রাখেন? তিনি হেসে বললেন, কী সালেহা, জায়গাটা ভালোই। কী বল? আর এক মুনীর চৌধুরী আমার সামনে। যিনি জীবনযাপনের এসব খুঁটিনাটি জানেন। আমার প্রথম বই 'যখন নিঃসঙ্গ'তে তাকে ভূমিকা লিখতে পা-ুলিপি দিয়ে এসেছি। যখন যেতে বলেছেন, গেলাম। দেখি মিশুককে কোলে করে তিনি ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারের ফুলার রোডের বাড়ির বারান্দায় এক মাথা থেকে আরেক মাথা করছেন। বললেন-সালেহা, আমি ওটা লিখতে পারিনি। কারণ কাল রাতে মিশুক ঘুমায়নি। ওর পেটের ব্যথা হয়েছিল। লিলি আর আমি সারারাত জেগে ছিলাম। এখন তাই লিলিকে একটু ঘুমাতে দিয়ে আমি ওকে নিয়ে ঘুরছি। পরে দেব। তুমি দু'দিন পরে এসো। তখন আমার ধারণা ছিল, যারা বড় বড় প-িত, অধ্যাপক তারা এভাবে বাচ্চার দেখাশোনা করেন না। তারা কেবল বইপত্র নিয়ে থাকেন। আমার ধারণা যে একেবারে ভুল- সেটা তার জীবনযাপনের ভেতর দিয়ে জেনেছি। কোথায় কোন খাবার পাওয়া যায় আর স্ত্রীকে ঘুমাতে গিয়ে বাচ্চা কোলে ঘুরে বেড়ানো। অসাধারণ মুনীর চৌধুরী। সাইকেল থেকে গাড়ি কেনেন। সাইকেলের বাস্কেটে থাকত নানা বই। দু'দিন পরে যেতেই আমার সামনে মুনীর অপটিমায় ফটফট করে বই নিয়ে কিছু লিখে দিলেন। পড়তে বললেন। বললেন, আরও কিছু লিখতে হবে? বললাম- না স্যার। এতেই হবে। মুনীর অপটিমা নামের বাংলা টাইপরাইটার তারই অবদান।
আমার মনে পড়ছে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী স্যারের কথা। একবার যখন স্যার ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়াচ্ছিলেন, একজন মেয়ে ফিট হয়ে যায়। মেয়েটির স্বামী এলে তিনি ভয়ে ভয়ে বলেন- বিশ্বাস করুন, ফিট হওয়ার মতো আমি কোনো ভয়ানক গল্প পড়ছিলাম না। তিনি স্যারকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলেন, তার স্ত্রীর বাচ্চা হবে। গরমে এমন আগেও হয়েছে। স্যার বাড়ি করবেন বলে তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীকে দিয়ে প্ল্যান করিয়ে নেওয়ার সময় বললেন- একটা এক্সট্রা ঘর লাগবে যে? কিসের জন্য?- গোসা ঘর। আমরা খুব হেসেছিলাম। তার সেই 'সন্ধ্যারাগ' নামের বাড়িটি আর নেই। সেখানে এখন বহুতল ভবন; যেমন হয় এখন। অনেকবার গেছি সন্ধ্যারাগে। কত গল্প! ছেলের জন্য লাল গাড়ি কিনেছিলেন। বলেন- ও লাল রঙ ভালোবাসে। মনে আছে আরও নানা কথা। কাছে থেকে দেখা, স্যার অপূর্ব একজন অতিথিপরায়ণ মানুষ ছিলেন।
ডক্টর আহমেদ শরীফ বা শরীফ স্যারও তেমনই অতিথিপরায়ণ ছিলেন। গেলেই বলতে- কী খাবে? গরম, না ঠা-া? একবার রফিক স্যারকে এমন প্রশ্ন করলে স্যার বলেছিলেন- স্যার, ঠা-া খেয়ে তারপর গরম খাব। প্রবল হাসি। একটা মজার গল্প আমি না করে পারছি না। তার এক ছাত্রী ছিলেন ডলি ইসলাম। ও এখন লন্ডনে থাকে। ওর কাছ থেকে শোনা গল্প। একদিন টিউটোরিয়াল ক্লাসে স্যার একটু বাইরে গেছেন। ওরা তখন হৈ হৈ করে গল্প করছে। নানা গল্প। ডলি বলে, আমি জীবনেও বাংলার ছেলেদের বিয়ে করব না। কারণ বাংলায় পাস করা ছেলেদের বউ না খেয়ে থাকে। গল্পটা যে স্যার বাইরে থেকে শুনছেন, ও জানে না। একদিন ডলি স্যারের বাড়িতে গেছেন। স্যার বললেন- এবার বাড়ির ভেতরে গিয়ে তোমার ভাবিকে বল, তিনি কতদিন না খেয়ে থাকেন? পুরো ব্যাপার বুঝতে পেরে বেচারি ডলি যে কী করবে বুঝতে পারে না। স্যার আমার গল্পগ্রন্থ 'যখন নিঃসঙ্গ' প্রকাশ হওয়ার পরে প্রশ্ন করেছিলেন- কী সালেহা, কেমন লাগছে? প্রথম বই প্রকাশ হলো। প্রথম সন্তানের জন্মের মতো? তিনি বলেছিলেন তার কোন কোন গল্প ভালো লেগেছে। ভেবে পাই না, এত বড় একজন প-িত কী করে আমার মতো অখ্যাত একজনের গল্প এত মনোযোগে পড়তে পারেন! এখনও চোখ ছলছল হয় যখন তাদের কথা ভাবি। ভাবি, এখন যারা পড়ছে তারা কোনোদিন জানবে না এসব অসাধারণ মানুষকে।
নীলিমা আপা বা নীলিমা ইব্রাহিম আমাদের 'মেঘদূত' পড়াতেন। একদিন মেঘদূতের ক্লাসে একজন ছেলে সটান দাঁড়িয়ে বলল- আপা, আপনার বাড়িতে একদিন আমাদের ডাকেন না কেন? আমরা সবাই চা খেতে যাব। আপা হেসে বললেন- আপার বাড়িতে চা খাবে? ঠিক আছে। একদিন তোমরা সবাই দিনক্ষণ ঠিক করে চলে এসো। শুধু আসার আগে আমাকে একটু বলো। আপা চিরকালই আপা। সেদিন চায়ের আসর খুব ভালো জমেছিল। একটু দূরে নিঃশব্দে বসে থাকতেন ডক্টর ইব্রাহিম। আপা পরিচয় করিয়ে দিতেন- তিনি ডক্টর ইব্রাহিম। গৃহস্বামী। কতবার গিয়েছি আপার ওখানে! যতবার গেছি, আপা সাদরে বসতে বলেছেন, খাইয়েছেন, কথা বলেছেন। যেসব স্মৃতি বড় নিবিড় হয়ে মনে পড়ে। ক্লাস বা ইউনিভার্সিটির বাইরে তারা যে কতটা সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
এখানে যখন এভরিহিল কলেজে এডুকেশনে একটা ইন-সার্ভিস ডিপ্লোমা ক্লাস করতে গিয়েছিলাম, দেখেছি ব্রিটেনে কলেজ আর ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক। স্যার সিগারেট খাবেন (এখন আর সবার সামনে সিগারেট খাওয়া যায় না। লুকিয়ে খেতে হয়। আইনত প্রকাশ্যে এ কাজ বন্ধ), তিনি সিগারেট বা ম্যাচ যে চায় তাকে ছুুড়ে দেন। আমাদের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ঠিক এমন ছিল না। কিন্তু যা ছিল তা ভাবতেও এখন অবাক লাগে। কী অসাধারণ সহজ ও সুন্দর ছিল সেসব দিন! মুনীর চৌধুরী স্যারকে আমরা প্রায় পাঞ্জাবির খুঁট ধরে টেনে নিয়ে যেতাম ক্লাসে। এমনটি কখনও দেখা যাবে না। যারা কোনোদিন তার ক্লাস করেননি, তারা আমার কথা বুঝবেন না। আমরা কেন? পেছনে এসে বসতেন অন্য ক্লাসের ছাত্র ও শিক্ষক। অসাধারণ কথক ছিলেন। তেমনি ছিলেন সমুদ্র-হৃদয়ের গৃহী ও গুণী। কতদিন মনে হয়েছে, রাজাকার আমাকে ধরে না নিয়ে স্যারকে ধরে নিলেন কেন? স্যারের ব্যাপারে আমরা হয়তো সবাই একলব্য।
আনিসুজ্জামান আমাদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন, তখন এবং পরবর্তীকালে। আমি আগে বলেছি- স্যারের ব্যক্তিত্ব আমাদের ভয় পাওয়ায় না, তবে আমাদের কারও সাধ্য হবে না তাকে অশ্রদ্ধা করবার। আজও তিনি আমাদের প্রিয় স্যার। এখনও তাকে নানা সুখ-দুঃখের কথা বলি। আমরা যখন প্রথম বছরে; স্যারের বিয়ে হয়ে যায়। আমারও। ডক্টর রফিকুল ইসলাম ছিলেন আমাদের সুহৃদ। আজও স্যারকে তাই মনে করি। মনে পড়ছে এই শিক্ষকদের। সবাই অসাধারণ। কাছে থেকে দেখা হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করি। তিনিও একজন শিক্ষক। শিক্ষা ও সাহিত্য নিয়ে আমাকে যা যা বলেছিলেন, মনে আছে। তার সেই নিজের দেওয়া স্কুল? মোটা অঙ্ক চলে যায় একা একটা স্কুল সামলাতে। সেটা তিনি করেছেন মৃত্যু পর্যন্ত। প্রার্থনা করি, যারা আছেন ঈশ্বর তাদের ভালো রাখুন। যারা চলে গেছেনম ঈশ্বর তাদের বুকের ভেতর ঠাঁই দেন।
ব্রিটেন প্রবাসী, কথাসাহিত্যিক
< Prev | Next > |
---|