মাহমুদুল বাসার
motamotনামটা ধর্মনিরপেক্ষ। বাংলা সাহিত্যেও এমন একটা নাম আছে, ‘যবন হরিদাস’। ‘রামরহিম’ নামটাও তেমনি। শেষ পর্যন্ত বাবাজী ফেঁসে গেলেন। তিনি নিজ শিষ্যাকে ধর্ষণ করেছেন। তিনি আবার স্বঘোষিত ধর্মগুরু। ১৯৬৭ সালের ১৫ আগস্ট রাজস্থানের গঙ্গানগর জেলার গুরুসর মোদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ভারতের বিতর্কিত ধর্মগুরু গুরুমিত রামরহিম সিং। সংক্ষেপে রামরহিম নামেই পরিচিত। তিনি ‘রকগুরু’ নামেও পরিচিত। ১৫ বছর আগে তার বিরুদ্ধে দুই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। গত শুক্রবার হরিয়ানার পঞ্চকুলার সিবিআই আদালত ৫০ বছর বয়সী এই ধর্মগুরুকে দোষী সাব্যস্ত করে। অর্থাৎ ধর্মগুরু এখন ধর্ষণগুরুতে উন্নীত হয়েছেন।

নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে দাবি করা রামরহিমের কয়েক লাখ ভক্ত রয়েছে। ১৫ বছর আাগে নিজ আশ্রমেই দু’জন নারী ভক্তকে ধর্ষণ করার অভিযোগ রয়েছে এই স্বঘোষিত ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে। রামরহিমের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাম এবং তার আশ্রমের নাম অনুসারেই ‘ডেরা সাচ্চা সৌদা’ রাখা হয়। হরিয়ানার সিরসা শহর তার হাইটেক ও সুরম্য আশ্রম রয়েছে।

নিজেকে পরিচয দেন তিনি একাধারে ধর্মপ্রচারক, সমাজসংস্কারক, গায়ক, নায়ক ও পরিচালক হিসেবে। শিখ, হিন্দু, মুসলিম সহ অন্যান্য ধর্মের মিশ্রনে তৈরি করেছেন তিনি তার আশ্রম। নাম দিয়েছেন ‘ডেরা সাচ্চা সৌদা’। তার নিজস্ব কমান্ডো বাহিনী আছে। এই ধর্মগুরুর সঙ্গে বর্তমান বিজেপি সরকারের বেশ কিছু নেতা-মন্ত্রীও আছেন। রামরহিম সিং নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করতেন সন্ন্যাসিনীদের। তার ডেরা সাচ্চা সৌদা থেকে ২০০২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর দফতরে পাঠানো এমনই এক বেনামা চিঠিতে এ কথা জানা যায়। এক সাধ্বী ওই চিঠিটি লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, রামরহিম সিং তাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেছেন। অন্য সাধ্বীদেরও একই ভাবে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন রামরহিম।

ব্যক্তি জীবনে রামরহিম তিন মেয়ে এক ছেলের জনক। ভারতে যে ৩৬ জন ব্যক্তি জেড ক্যাটাগরির সুরক্ষা পান, রামরহিম তাদের মধ্যে অন্যতম। সারা বিশে^ নাকি রামরহিমের ৬ কোটি ভক্ত আছে। তবে বিতর্ক সব সময় রামরহিমকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সব সময় তাকে ঘিরে রাখে সশস্ত্র নিজস্ব রক্ষিবাহিনী। তিনি অনেক বিতর্কের জন্মদাতা বলেই তার ঘেরাটোপের প্রয়োজন হয়। তার আশ্রমে বসে নিয়মিত পপকনসার্ট। তিনি নিজেই সেখানে গান করেন। ১৯৯৮ সালে বেগু গ্রামের এক শিশু ডেরার জীপে চাপা পড়ে মারা যায়। এতে গ্রামবাসীর সঙ্গে ডেরার বিরোধ শুরু হয়। সেই খবর প্রকাশ করায় গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর ক্ষেপে যান তিনি। তার অন্ধভক্তরা এক ধর্ষিতা সাধ্বীর ভাই রনজিৎকে হত্যা করে।

২০০২ সালে সান্ধ্য দৈনিক ‘পুরাসচ’ পত্রিকার সম্পাদক রামচন্দ্র ছত্রপতিকে তার বাড়ির স্ামনে গুলি করা হয়। সাংবাদিকরা বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিতে থাকেন। এক মাস পরে, দিল্লির একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় ছত্রপতির। আবারো-পাঞ্জাব-হরিয়ানার হাইকোর্ট সাংবাদিক ছত্রপতি ও রনজিৎ সিং হত্যার মামলা দু’টি একত্র করে সিবিআইকে তদন্ত করার নির্দেশ দেন।

২০০৭ সালে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় যে, এমন পোশাক পরেছেন তিনি যে গুলো দশম শিখ ধর্মগুরু সিংয়ের পোশাকের মতো। শিখ সম্প্রদায়ের লোকেরা এ জন্য বিক্ষোভ করেন ও তার কুশপুতুল দাহ করেন। দু’টি হত্যা ও ধর্ষণের মামলার তদন্ত করে সিবিআই যখন রামরহিমকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন তখন বচাররক তাকে আদালতে হাজিরার নির্দেশ দেন ২০০৭ সালের ৩১ আগস্টের মধ্যে। ওই বিশেষ আদালতের বিচারককে হুমকি, চিঠি দেয়া হয়। ২০১০ সালে ডেরার সাবেক সন্ন্যাসী রাম কুমার বিষ্ণোই হাইকোর্টের কাছে অভিযোগ করে জানান, আশ্রমের সাবেক ম্যানেজার ফকির চাঁদকে গুম-খুন করা হয়েছে। হংসরাজ চৌহান নামের এক ব্যক্তি ২০১২ সালে হাইকোর্টে মামলা করেন, রামরহিমের নির্দেশে আশ্রমের ৪০০ সাধুকে নপুংসক করেন।

ওই বেনামা চিঠিতে শিউরে ওঠার মতো অভিযোগ উঠে এসেছে ধর্মগুরু রামরহিমের বিরুদ্ধে। ওই চিঠিতে অভিযোগকারী সাধ্বী লিখেছিলেন, ‘আমি পাঞ্জাব থেকে এসেছি। আমি একজন ¯œাতক। সিরজা (হরিয়ানা)র ডেরা সাচ্চা সৌদায় গত ৫ বছর ধরে সাধ্বী হিসেবে সেবা করছি। আমার মতো কয়েকশো মেয়ে প্রতিদিন ১৮ ঘন্টা সেবা করে চলেছেন। কিন্তু এখানে আমরা যৌন নির্যাতনের শিকার। ডেরায় মেয়েদের ধর্ষণ করেন ডেরা মহারাজ।

সাধ্বী হওয়ার দুই বছর পর একদিন রাত ১০ টার দিকে এক মহিলা ভক্ত আমার ঘরে এসে জানান, মহারাজ আমাকে ডেকেছেন। মহারাজ স্বয়ং ডেকেছেন শুনে খুব উচ্ছ্বসিত হই। সাধ্বী হওয়ার পর তার সঙ্গে সেটাই তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। সিঁড়ি বেয়ে ঘরে ঢুকে দেখি তার হাতে একটা রিমোট এবং টিভিতে তিনি অশ্লীল ভিডিও দেখছেন। বিছানায় তার বালিশের পাশে পিস্তল রাখা ছিলো। এ সব দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই। এরপর মহারাজ টিভিটা বন্ধ করে দেন। আমাকে ঠিক তার পাশে বসান। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন, আমাকে তিনি হৃদয়ের গভীর ভালোবাসেন। আমার সঙ্গে সর্ম্প করতে চান। তিনি বলেন, তার শিষ্যা হওয়ার সময়ই আমার সব সম্পদ, শরীর এবং আত্মা তার কাছে উৎসর্গ করেছি এবং তিনি তা গ্রহণও করেছেন। আমি বাধা দিলে তিনি বলেন, আমি ঈশ^র, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি তাকে বলি, ঈশ^র কখনো এরকম করেন না। আমাকে বাধা দিয়ে তিনি বলেন, শ্রীকৃষ্ণও ঈশ^র। তার ৩৬০ জন গোপী ছিলেন। যাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ প্রেমলীলা করতেন। আমাকেও সবাই ঈশ্¦র মানে। এতে এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, আমি তোমাকে এখনই এই পিস্তল দিয়ে খুন করতে পারি। তোমার লাশ এখানেই পুঁতে রাখবো। তোমার পরিবারের প্রতিটা সদস্য আমার অন্ধভক্ত। তারা কখনোই আমার বিপক্ষে যাবে না। সরকারের উপরেও আমার যথেষ্ঠ প্রভাব রয়েছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রের অনেক মন্ত্রীও আমার কাছে আসেন। সুতরাং তারাও আমার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে না। আমি তোমার পরিবারের সদস্যদের চাকরি কেড়ে নেব এবং তাদের সেবাদার দিয়ে খুন করাবো। তুমি খুব ভালো করেই জানো, ডেরা ম্যানেজার ফকির চাঁদকেও আমি খুন করিয়েছি। এখনো সেই খুনের কিনার হয়নি। ডেরার দৈনিক আয় ১ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে আমরা নেতা, পুলিশ কিনতে পারি।
ঠিক এর পরই মহারাজ আমাকে ধর্ষণ করেন। গত তিন বছর ধরেই মহারাজ এভাবে আমাকে ধর্ষণ করছেন। আমি জানতে পেরেছি, আমার মতো যতজন সাধ্বীকে তলব করেছেন, তাদের সকলকেই ধর্ষণ করেছেন। (ইত্তেফাকা-২৮-৮-১৭)।
অবাক হবার মতো ব্যাপার হলো, এমন একজন ধর্মগুরুর ছদ্মবেশে ধর্ষণগুরুর লাখ লাখ ভক্ত। তারা তাদের গুরুবারার গ্রেফতারের বিরুদ্ধে লোমহর্ষক তা-ব চালিয়েছে। তাদের তা-বে ৪০ জন মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে, শত শত আহত হয়েছে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার উন্মত্ত ভক্তকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বলাই বাহুল্য, বিজেপি সরকার এই গুরু বাবাজীর ভক্তদের ভোট কাজে লাগিয়েছে। গো-রক্ষকদের ভোটও কাজে লাগিয়েছে। এখন ভারতে ধর্মান্ধতা ও ধর্মের বিকৃতি এমন এক স্তরে উঠেছে যে তা সামাল দিতে পারছেন না মোদিজী। তাই কথায় কথায় মহাত্মা গান্ধীর দোহাই পাড়ছেন। ভগবান বুদ্ধকেও স্মরণ করছেন। অথচ মোদিজী স্বয়ং রামরহিমের ভক্ত। ২০১৪ সালে সরকার গঠন করার পর তিনি যখন স্বচ্ছ ভারতের ডাক দেন তখন সেই ডাকে সাড়া দিতেই প্রকাশ্যে প্রণাম জানান রামরহিম সিংকে নরেন্দ্র মোদি। এরপর বিজেপির সব নেতারা ছুটে যান রামরহিমের ডেরাতে। তার ভক্ত কুলকে ভোটব্যাংক বানান। কংগ্রেসকে পরাজিত করেন রামরহিমের ভক্তদের ভোট দিয়ে। তার যৌন কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর আদালত রামরহিমের সাজা ঘোষণা করে। এর ফলে রামরহিমের ভক্তরা তা-ব চালায়। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি সরকার সমালোচনার মুখে পড়ে। ভোটের লোভে এমন ধর্ষণগুরুর কোনো বিচার হচ্ছে না সরকারের প্রশ্রয়ে, এ ধরনের অভিযোগ প্রকাশ্যেই উঠেছে। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী কঠোর ভাষা প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছেন। বলেছেন, ‘হরিয়ানার সহিংসতায় জড়িতদের ছাড় দেয়া হবে না। ধর্মের নামে সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়।’ গত ২৯ আগস্ট এই ধর্মগুরু রামরহিম সিংয়ের ২০ বছর সশ্রম কারাদ- ঘোষণা করেছে আদালত।

ধর্ম ব্যবসা, ধর্ম নিয়ে ভ-ামী, ধর্মকে বিকৃত করে স্বীয় লালসা চরিতার্থতা সম্পর্কে অনেক আগে থেকে প্রগতিশীল গবেষকরা, কথাশিল্পীরা সাবধান করে আসছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক ছোটগল্পে বলেছেন, সাধু এবং অসাধুর মধ্যে পার্থক্য এই যে সাধুরা কপট আর অসাধুরা অকপট।’ চিরন্তন সত্য কথা এটি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘অহিংসা’ উপন্যাসে রামরহিমের মতোই একজন ভ- সাধুর চরিত্র অংকান করেছেন। তার নাম সাধু সদানন্দ। রামরহিমের যেমন বিশাল জায়গা জুড়ে আস্তানা, তেমনি সাধুসদানন্দেরও কয়েকশত বিঘা জমি নিয়ে আশ্রম। রামরহিম যেমন যৌনপিপাসু, সাধুসদানন্দও তাই। অন্যদিকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ভ-পীরের মাজারে যে ফেরেববাজী হয় তার চিত্র এঁকেছেন আবুল মনসুর আহমদ তার ‘হুজুর কেবলা’ গল্পে এবং সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ তার ‘লালসালু’ উপন্যাসে।

মূলত পৃথিবীতে ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিলো মানুষের কল্যাণের জন্যইা। প্রকৃত ধার্মিকদের দ্বারা মানুষের উপকার হয়েছে। রামরহিমের মতো ভ-েরা ধর্মের বিকৃতি ঘটিয়েছে নিজেদের স্বার্থে।

মাহমুদুল বাসার
কলামলেখক, গবেষক

সাম্প্রতিক