মোমিন মেহেদী
motamotমৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, চলতি বছর কোরবানি ঈদে এক কোটি ১৫ লাখ গবাদিপশুর চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে সারা দেশে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার পশু। এ হিসাবে চাহিদার তুলনায় ৫৭ হাজার গবাদিপশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। এরপর ভারত, নেপাল ও মিয়ানমার থেকে আসছে পশু। সবকিছু মিলে এ বছর কোরবানির পশুর দাম ক্রেতাদের নাগালেই থাকবে। আমি মনে করি, গরু আমদানিতে খরচ বেড়েছে। কারণ পথে পথে চাঁদাবাজি হচ্ছে। দাম কমাতে হলে চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারকে কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থনীতি কোনো পণ্য দাম বৃদ্ধি ও কমার সরল সমীকরণ হল চাহিদা ও সরবরাহ। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কমে। আর এ বছরের কোরবানিতে চাহিদা ও সরবরাহের মোটামুটি ভারসাম্য রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের কোরবানির উল্লেখযোগ্য অংশই আসে ভারত থেকে।

প্রতি বছর দেশটি থেকে ২২-২৫ লাখ গরু আসে। কিন্তু দেশটির পত্রিকা দ্যা হিন্দু বীজনেস লাইনের এক সংবাদে সম্প্রতি বলা হয়েছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের কড়াকড়ির কারণে এ বছর দেশটি থেকে বাংলাদেশে গরু আসার পরিমাণ কমেছে। এ বছর দেশটি ৫০০ হাজার কোটি রুপি রাজস্ব হারাবে। তবে নতুন করে নেপাল ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গরু আসছে। অন্যদিকে এ বছরের ঈদকে নির্বাচনী ঈদ বলা হচ্ছে। কারণ আগামী বছর দেশে জাতীয় নির্বাচন। আর এ নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কোরবানি দেয়ার হার এমনিতেই বেড়ে যায়। কোনো কোনো প্রার্থী ৫০টি পর্যন্ত গরু কোরবানি দেয়। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের নেতারাও এমপি মন্ত্রীদের সন্তুষ্ট করতে তাদের নামে কোরবানি দেয়। ফলে এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা বাড়বে। কিন্তু বিপত্তি অন্য জায়গায়। বর্তমানে দেশের ২৭টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত। এসব এলাকার মধ্যবিত্তদের কোরবানি দেয়ার হার এ বছর কমবে। এ ছাড়া স্বাভাবিক নিয়মে এসব এলাকার নিন্মবিত্তরা তাদের গবাদিপশু বিক্রি দেয়। এতেও বাজারে সরবরাহ বাড়বে।

রাজধানীর কোরবানির পশুরহাটগুলোতে উঠতে শুরু করেছে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ও উট। কিন্তু বিক্রি শুরু হয়নি এখনও। কিছু ক্রেতা এলেও তারা দেখছেন, দাম শুনছেন, তারপর ঘোরাঘুরি করে চলে যাচ্ছেন। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে পশুর দাম একটু বেশিই হাঁকা হচ্ছে। ফলে ক্রেতারাও অপেক্ষা করছেন দাম কমার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোরবানির ব্যাপক চাহিদা মেটাতে এবার দেশেই সরকারি-বেসরকারিভাবে উৎপাদন হয়েছে পর্যাপ্ত পশু, যা চাহিদার তুলনায় বেশি। কিন্তু এর বাইরে নানাভাবে ভারত থেকে অবাধে আসছে গরু। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হওয়ায় দেশি খামারি ও ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। অন্যদিকে যারা কোরবানি দেবেন দাম কিছুটা কম পাওয়ার আশায় রয়েছেন স্বস্থিতে। ঢাকার সবচেয়ে বড় গাবতলী পশুরহাটসহ কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।

বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার বক্তব্য হলো- খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হোক সেটি যেমন চাই না, তেমনই তারা উচ্চ মুনাফা করুন সেটিও কাম্য নয়। আমরা চাই কোবরানির বাজারে যেন একটা ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে। একেবারে পানির দামে পশু বিক্রি হলে দেশীয় উৎপাদন নিরুৎসাহিত হবে। এতে দেশের ক্ষতি সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এ জন্য পশুর হাটে দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারিভাবে বিশেষ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকা উচিত।

তা না হলে এখন যেমন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছোট বড় ও মাঝারি আকারের দেশীয় গরু, মহিষ ও ছাগল বিক্রির জন্য হাটে আনা হয়েছে। এ ছাড়া দুম্বা, উট, ভেড়া ও ছাগলের জন্য আলাদাভাবে ছাউনি দিয়ে স্থায়ী পাকা মেঝের ব্যবস্থা রয়েছে। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু হাটে শুক্রবার পর্যন্ত ব্যাপক পশু কেনা-বেচার দৃশ্য চাখে পড়েনি। ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের মধ্যে যারা হাটে আসছেন, তারা পশু দেখে ও দামদর করে চলে যাচ্ছেন। হাটে বড় অকারের ৮-১২ মণ মাংসের গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে ২-৫ লাখ টাকা, মাঝারি ৪-সাড়ে ৪ মণ গরুর দাম ১-২ লাখ টাকা, আর ছোট অকারের ২-৩ মণ মাংসের গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে ৭০-৮০ হাজার টাকা। সাধারণত হাটে ঈদের ৭ দিন আগ থেকে গবাদিপশু আসতে শুরু করে। ৩-৪ দিন আগে এর সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। আর ঠিক তখন থেকেই বেচাকেনা শুরু হয়। তবে এ বছর আগে থেকেই গরু এসেছে হাটে। সীমান্ত দিয়ে গত বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি গরু আসছে, যা দুই-এক দিনের মধ্যে হাটে উঠবে। পশুর দাম নিয়ে এ বছর তারা দোটানায় রয়েছেন। আগে যেখানে আগেভাগেই দাম বাড়া-কমার বিষয়টি আন্দাজ করা যেত। এবার সেটিও করা যাচ্ছে না। কুষ্টিয়া থেকে গাবতলী হাটে গরু বিক্রি করতে আসা মো. রাজন বলেন, এ বছর গরুর দাম অনেক কম হবে মনে হচ্ছে। বর্ডার দিয়ে অনেক গরু দেশে প্রবেশ করেছে। যা হাটে আসার অপেক্ষায় আছে। আর এ গরু হাটে এলেই পানির দরে গরু বিক্রি করতে হবে। এটা করে আমাদের মতো দেশীয় খামারিদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। প্রায় একই মন্তব্য করেন, গরু ব্যবসায়ী মো. জামিলসহ অনেকেই।

একটু খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, পৃথিবীর কোন দেশে গরু খাওয়ার এই প্রবণতা অন্তত পবিত্র ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে নেই। অথচ বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হওয়া স্বত্বেও গরু খাওয়ার রাস্তা তৈরি করে প্রতিনিয়ত। কেননা, গরু খেকো হেক হিসেবে বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে তৈরি-ই করেছে বন্ধুদেশ ভারতে। তার প্রমাণ পাওয়া যাবে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের দিকে তাকালে। ¯্রােতের মতো আসছে ভারতীয় গরু। বৈধ-অবৈধ দুইভাবেই গরু আসছে বাংলাদেশে। যখন তাদের পানিতে ভাসছে বাংলাদেশ; তখন তাদের গরুতে ভাসছে বাংলাদেশ। অথচ দেশে কোরবানির গবাদিপশুর কমতি নেই তারপরও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকেও দেদার আসছে পশু। সব মিলিয়ে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি। কিন্তু এ বছর বাড়তি যোগ হয়েছে সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ জন্য শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই ভোটার তুষ্টির জন্য বাড়তি কোরবানির চাহিদা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবেন তারা একাধিক গরু কোবানি, ক্ষেত্র বিশেষে ১০-২০টিও দিচ্ছেন। তবে বন্যায় আক্রান্ত বিভিন্ন অঞ্চলে সঙ্গতকারণেই কোরবানির হার কমবে। সব মিলিয়ে এ বছর পশুর হাটে ব্যাপক গবাদিপশুর সরবরাহ ঘটবে। আর এই গরুকে কেন্দ্র করে রাজনীতির নামে অপরাজনীতির রাস্তায় অগ্রসর হতে হতে পথে পথে চলবে চাঁদাবাজি, বিভিন্ন হাত ঘুরে মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন খরচ, হাটের খরচসহ সব মিলিয়ে গতবছরের চেয়ে দাম এবার বেশি হবে। আল্লাহকে নয়; এবার ভোটার তুষ্টির কোরবানির কারণেও পশুর চাহিদা বাড়বে।

দেশে স্বাধীনতার চেতনা ব্যবসায়ী আর উগ্র ধর্মান্ধতার মাঝামাঝি যারা আছে, তারা মহা বিপদের মধ্যে দিন যাপন করে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না; কথা ছিলো- দেশ স্বাধীন হবে; সমান্তরাল চলবে বড়লোক আর গরিবের জীবন চাকা। যে যেভাবেই বলি না ইসলামও এই সমান্তরাল বিষয়টিকে সামনে রেখে ১৪ শত বছর ধরে এগিয়ে চলছে।

হযরত মুহাম্মদ সা. কিন্তু কখনোই খাওয়ার জন্য কোরবানী দেননি বা উৎসাহিতও করেন নি; তাহলে কেন নোংরা চিন্তা থেকে, কেবল খাওয়ার চিন্তা থেকে কোরবানী নামক খেলা?
আসুন সবাই প্রকৃতভাবে বিশ্বব্রম্মান্ডের প্রতিপালকের খুশির জন্য কোরবানী করি, গরু, উট বা খাসি খারওয়ার জন্য যেন না হয় আমাদের পবিত্রতম কোরবানী। তাহলে কমে যাবে বাংলাদেশের অন্যায় আর অপরাধের প্রাথমিক স্তর। পবিত্র ঈদুল আযহা থেকেই শুরু কোন হুজুগ টাইপের ইসলামকে না বলা, পীর-মুরিদী ব্যবসাকে না বলা এবং ধর্মের নাম বিক্রি করে ‘ইসলামীয়া/সিদ্দিকীয়া/ মক্কা-মদীনা’ নাম না রেখে আল্লাহকে ভালোবেসে সত্যিকারের ভালোবাসা থেকে এগিয়ে চলায় অব্যহত থাকি প্রতি মূহুর্ত...

মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি এবং উপদেষ্টা, জাতীয় শিক্ষাধারা

সাম্প্রতিক