মাহফুজুর রহমান
একসময় পাট-চা-চামড়া রপ্তানি করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ইতিহাস ভুলে আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি তৈরি পোশাক রপ্তানি আর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর। ১৯৯০-৯১ সালেও এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের পরিমাণ ততটা উল্লেখযোগ্য ছিল না। এ বছর রেমিট্যান্স থেকে বাংলাদেশ পায় ৭৬৩.৯১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু তখন থেকে দেশের অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স প্রায় প্রতিবছরই বেড়েছে। শুধু ২০০০-০১ ও ২০১৩-১৪ সালে আগের বছরের তুলনায় সামান্য কম রেমিট্যান্স এলেও তা শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়ে বেড়ে ২০১৪-১৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৩১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশের এই অন্তর্মুখী রেমিট্যান্সপ্রবাহ বিশ্বের বহু দেশের জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি যখন মন্দার মুখে পড়ে ভঙ্গুর অবস্থার সৃষ্টি হয় তখনো বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকে। বিষয়টি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ দেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে বা জানতে এসেছেন। অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স আজ অর্থনীতির শক্ত খুঁটিতে পরিণত হয়েছে।
দুই বছর আগে হঠাৎ করেই এই অন্তর্মুখী রেমিট্যান্সের ফল্গুধারা নিম্নমুখী হতে শুরু করে। ২০১৫-১৬ সালে রেমিট্যান্স আসে ১৪ হাজার ৯৩১.১৮ মিলিয়ন ডলার, যা ছিল আগের বছরের তুলনায় শতকরা আড়াই ভাগ কম। এ পর্যায়ে কেউই এই কমে যাওয়াকে তেমন একটা গায়ে মাখেনি।
অন্তর্মুখী রেমিট্যান্সের কমতি দেখে অর্থ খাতের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়ার কথা। কিন্তু খোলা চোখে এই নড়াচড়া তেমন একটা চোখে পড়ছে না। এর আগে প্রবাসীদের কাছ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আহরণের জন্য দেশে-বিদেশে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রবাসীদের জন্য দেশের আর্থিক খাতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে আছে বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা বিভিন্ন রকম বন্ড। এসব বন্ড প্রবাসে থেকেই বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা ও ভাঙানো যেত। বিভিন্ন স্থানে প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রায় ডিআইটির কাছ থেকে প্লট কিনতে পারত। বাংলাদেশ ব্যাংক অতন্দ্র প্রহরীর মতো বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরকদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি নজরদারি করত। সর্বোপরি প্রবাসীদের জন্য সৃষ্টি করা এসব সুযোগের সংবাদ বিভিন্ন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রদানের মাধ্যমে প্রচার করা হতো। আবার প্রবাসীদের এসব তথ্য জানানোর জন্য বিদেশে বেশ কয়েক বার টিম পাঠানো হয়েছে। এসব টিম মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি মরুভূমির মধ্যেও শ্রমিক ক্যাম্পে গিয়ে অনুষ্ঠান করে তাদের তথ্য জানিয়েছে। তা ছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলবহির্ভূত, অর্থাৎ হুন্ডিতে টাকা পাঠালে সেই টাকা যে বৈদেশিক মুদ্রার পরিবর্তে অস্ত্র বা মাদক আকারে দেশে প্রবেশ করতে পারেÑএসব তথ্য তাদের জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবাসীদের তথ্যসংবলিত একটি তথ্যভা-ার গড়ে তোলা হয়েছিল, যাতে আর্থিক খাতের যেকোনো সুযোগ-সুবিধার সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে ই-মেইলের মাধ্যমে প্রবাসীদের দেওয়া যায়। তখন দেশে ক্রমান্বয়ে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়েছে। এই ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স দেখে অনেকেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলেছে, দেশে অন্তর্মুখী রেমিট্যান্সের পরিমাণ ও রিজার্ভ চাহিদার তুলনায় বেশি হয়ে গেছে। এগুলো কমানো দরকার। ডিজিটাল হুন্ডি বর্তমান সময়ের রেমিট্যান্সের নিম্নমুখিতার অন্যতম প্রধান কারণ। মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা প্রেরণ করাকেই ডিজিটাল হুন্ডি বলা হয়। বর্তমানে এই পদ্ধতিটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যেসব দেশ থেকে প্রধানত বাংলাদেশে এ ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা আসে সেগুলোর প্রায় সব কটিতেই বাংলাদেশি প্রবাসীদের আবাসস্থলের কাছে ছোট ছোট দোকানে সাইনবোর্ড লাগানো থাকে, ‘এখানে বিকাশ করা হয়’। এসব দোকানে বৈদেশিক মুদ্রা জমা দিলে দোকান মালিকের পার্টনারকে টাকা পাঠানোর নির্দেশটি জানিয়ে দেওয়া হয়। পার্টনার বাংলাদেশে বসে সঙ্গে সঙ্গে টাকা প্রাপকের মোবাইল ফোন নম্বরটিতে পাঠিয়ে দেন। ফলে প্রবাসী কর্তৃক প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশেই থেকে যায়। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশগুলোতে এ প্রক্রিয়া চালু হয়েছে এবং দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। আন্তর্জাতিকভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ফিন্যানশিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) ৪০টি সুপারিশের (যা বিশ্বের সব দেশই প্রতিপালনে বাধ্য) ৩২ নম্বর সুপারিশে বলা হয়েছে, ক্যাশ কুরিয়ার বা অল্টারনেটিভ রেমিট্যান্স সিস্টেম কোনো দেশে বৈধ বলে গণ্য হবে না। বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের (এপিজি) সদস্য। সেই সূত্র ধরে বিএফআইইউ সদস্য অন্য দেশগুলোর কাছে এই ডিজিটাল হুন্ডি বন্ধ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানাতে পারে। দু-একবার এ বিষয়ে ইউনিটটি বিভিন্ন দেশে চিঠি লিখেছে এবং সেই সূত্র ধরে সৌদি আরবসহ আরো দু-একটি দেশে ‘বিকাশ করা হয়’ সাইনবোর্ডওয়ালাদের ধরাও হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশপক্ষের উদ্যোগ অনেকটা দায়সারা গোছের।
বাংলাদেশে বসেও মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এজেন্টদের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টি ধরা পড়তে পারে। কোনো একজন এজেন্ট প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে টাকা প্রেরণ করছেন কি না এ ধরনের তথ্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে এগুলো বের করে আনা সম্ভব হতে পারে। মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস পরিচালনাকারীদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিবিড়ভাবে তাঁদের মনিটর করা হচ্ছে না। এর ফলেও ডিজিটাল হুন্ডি কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
যারা বিদেশে থেকে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠায়, তাদের জন্য সরকার আরো বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবতে পারে। প্রবাসীদের প্রধান স্বপ্ন হচ্ছে দেশে এক টুকরা জমি কেনা বা একটি বাড়ি নির্মাণ করা। এ ক্ষেত্রে রাজউক প্লট বিতরণের সময় প্রবাসীদের অগ্রাধিকার দিতে পারে। আবার সরকার শুধু প্রবাসীদের জন্যই ফ্ল্যাট বানিয়ে তাদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রায় বিক্রি করতে পারে। বিদেশ থেকে যারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, তাদের বাড়ি নির্মাণ করার জন্য বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদহারে ঋণ বিতরণ করতে পারে। প্রবাসীরা যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠায় সেসব ব্যাংকও সহজ শর্তে ঋণ বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। প্রবাসীরা দেশে প্রত্যাবর্তনকালে বিমানবন্দরে পৃথক চ্যানেল ব্যবহার করে দেশে প্রবেশের সুযোগ দাবি করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। ফিলিপাইনে এ ধরনের সুযোগ অনেক দিন থেকেই রয়েছে। সরকার এ বিষয়ও ভেবে দেখতে পারে।
সব শেষে বলা যায় যে রেমিট্যান্স পতনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অদূর ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে এবং সরকারের উন্নয়ন রূপকল্প থেমে যেতে পারে। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে এবং জোরেশোরেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : সাবেক জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ব্যাংক
< Prev | Next > |
---|