এ এম এম শওকত আলী
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে বা বাংলাদেশকে জঙ্গিমুক্ত করার বিষয়টি গত ২ ও ৩ জুলাইয়ে সংবাদমাধ্যমে বহুল আলোচিত বিষয় ছিল। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ কিছু পথভ্রষ্ট তরুণ জঙ্গি ঘটিয়েছিল তার এক বছর পূর্তি উপলক্ষেই এ বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। ২ জুলাইয়ে এক প্রতিবেদকসহ একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটপ্রধানের সুচিন্তিত বক্তব্যও একটি দৈনিকে প্রকাশ করা হয়েছে। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ বা নির্মূলের চলমান কার্যক্রমে প্রতিবেদকসহ নিরাপত্তা বিশ্লেষকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মিল রয়েছে। তা হলো একমাত্র পুলিশি ব্যবস্থাই এর জন্য যথেষ্ট নয়। এ ধরনের অভিমত নতুন কিছু নয়। অতীতে অনেকেই বলেছে যে এ সমস্যা সমাধানের জন্য সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা ও উপজেলায় উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চালু করা হয়। এ প্রচেষ্টার সাফল্য কতটুকু তার কোনো মূল্যায়ন নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মসজিদভিত্তিক কার্যক্রমও শুরু করা হয়। ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়। এ কার্যক্রমের সাফল্য কতটুকু? প্রকাশিত এক সংবাদে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক অভিনব উদ্যোগের নিষ্ফলতার বিষয়ও দৃশ্যমান ছিল। জানা যায় যে ৮১৫৫ নম্বরে রবি ও বাংলালিংক গ্রাহকরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরাসরি আলেমদের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পাবে। প্রতিবেদক এ সুযোগ গ্রহণ করে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তা সুখকর ছিল না। ওই নম্বরে গত ২৯ জুন ফোন করে শিয়া সম্প্রদায় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। উত্তর বা ব্যাখ্যা প্রদানকারী আলেম বলেন, শিয়ারা ‘বিভ্রান্তির’ মধ্যে আছে। সংশ্লিষ্ট আলেম তাঁর নাম প্রকাশে অসম্মতি জানিয়ে বলেন যে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মত দিতে পারেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের সঙ্গে প্রতিবেদক যোগাযোগ করলে তিনি (মহাপরিচালক) বলেন যে এ ধরনের কোনো সেবা ফাউন্ডেশন পরিচালনা করে কি না তা তাঁর জানা নেই। কোনো কর্মকর্তা বলতে পারবেন। প্রতিবেদকের এ অভিজ্ঞতা একাধিক বিষয়ে ইঙ্গিত বহন করে। এক. ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা এ ব্যবস্থায় পাওয়া দুষ্কর। দুই. সংশ্লিষ্ট আলেম নাম প্রকাশ না করায় সম্পূর্ণ বিষয়টি অস্বচ্ছ। তিন. সরকার পরিচালিত ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক নিয়োজিত আলেম তাঁর ব্যক্তিগত মতামত দিতে পারেন না। একমাত্র ইসলামিক ফাউন্ডেশন নয়, সরকারের অন্যান্য সংস্থাও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রতিবেদনে জানা যায় যে এক. ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এক লাখ মুফতি কর্তৃক স্বাক্ষরিত ফতোয়া প্রচার; দুই. জুমার নামাজের আগে জঙ্গিবাদবিরোধী বক্তব্য প্রদান; তিন. তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম, বিজ্ঞাপনচিত্র, ভিডিও ক্লিপ তৈরি ও প্রচার এবং চার. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জেলায় জেলায় সমাবেশ করা। এসব উদ্যোগ বা চেষ্টা স্থায়ীভাবে চলমান কি না সে বিষয়টি জানা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায় যে ২০১৪ সালে জাতিসংঘের কাউন্টার টেররিজম কমিটি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে একাধিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এর মধ্যে রয়েছে ক. দমন-পীড়ন দিয়ে কাজ হবে না; খ. জঙ্গিবাদ উসকে দেয় এমন কর্মকা- থেকে রাষ্ট্রগুলোকে বিরত থাকতে হবে; গ. সংবাদমাধ্যম, সুধীসমাজ, ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রথম বিষয়টি আলোচ্য প্রতিবেদনেও নিরাপত্তা বিশ্লেষকের বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে। এ বিষয়ে বলা যায় যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিরোধমূলক অভিযান অপরিহার্য, তবে একমাত্র বিকল্প নয়। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন জেলায় পুলিশি অভিযান যথেষ্ট সফল হয়েছে। এর ফলে সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বন্ধ করা গেছে। তবে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কমিটির অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মকা-ে কিছু অসম্পূর্ণতা রয়েছে। যেমন জঙ্গিবাদকে উসকে দেয় এমন কোনো রাষ্ট্রীয় কর্মকা-। এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। সাম্প্রতিককালে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানোর পর এ দেশের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন যে এর ফলে উগ্রবাদী মহল উৎসাহিত হবে। এ ছাড়া রয়েছে সরকারবহির্ভূত সংস্থাগুলোর একযোগে কাজ করার বিষয়। একযোগে কাজ করার বিষয়টি দৃশ্যমান নয়। কিছু ক্ষেত্রে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও অজানা কারণে স্তিমিত বা বিলীন হয়ে গেছে। প্রতিবেদকের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উদ্যোগে যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সে উদ্যোগ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগের পর বাস্তবায়িত হয়নি। এ ক্ষেত্রেও বলা যায় যে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ সংক্রান্ত সরকারি নীতি অস্বচ্ছ।
অবশ্য কোনো সরকারই এ পর্যন্ত এসংক্রান্ত নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি। ২০০৭ সালপূর্ববর্তী সময়ে যে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতাসীন ছিল সে সরকারের বিরুদ্ধে জঙ্গিদের মদদদাতা হিসেবে প্রতিপক্ষ দল চিহ্নিত করে। সাধারণ মানুষ এ ধরনের অভিযোগের কিছু প্রমাণও ওই সময় পেয়েছিল। যেমন ওই সময়ের ক্ষমতাসীন জোটের এক মন্ত্রী বলেছিলেন, জাগ্রত মুসলিম জনতার কোনো অস্তিত্ব নেই; যা পরবর্তী পর্যায়ে অসত্য মন্তব্য বলে প্রমাণিত হয়। এর ফলে বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দলের দূরত্বও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। হলি আর্টিজানের নারকীয় হত্যাকা-ের বর্ষপূর্তিতে ক্ষমতাসীন দলের এক মন্ত্রী ও অন্য নেতারা পুষ্পস্তবক প্রদান করেন। তাঁদের প্রতিপক্ষ দলের নেতারাও পৃথকভাবে পুষ্পস্তবক প্রদান করেন। সব রাজনৈতিক দল যদি সম্মিলিতভাবে এ কাজ করত, তাহলে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের ঐকমত্যের বিষয়টি দৃশ্যমান হওয়া সম্ভব ছিল। এ ক্ষেত্রেই জঙ্গিবাদবিরোধী চেষ্টার শূন্যতা রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। জঙ্গিবাদ দমনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচেষ্টা বহুলাংশে সফল। তবে এ নিয়ে আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নেই। কয়েক বছর আগে জেএমবি নিষ্ক্রিয় বা নির্মূল হয়েছে বলে একটা ধারণা ছিল। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তা প্রমাণ করে। হলি আর্টিজানসহ কিছু ঘটনার পর বলা হচ্ছে, নব্য জেএমবির উত্থান হয়েছে। এ ছাড়া ৬ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘জঙ্গিদের মূল উৎপাটন করতে পারিনি। ’ অর্থাৎ তারা কিছুটা নিষ্ক্রিয় হলেও কখন আবার সক্রিয় হবে তা বলা মুশকিল। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাক্ষাৎকারে এ কথাও বলেছেন যে জঙ্গিরা এখন নেতৃত্বশূন্য। ৬ জুলাই প্রকাশিত মন্তব্যে তাঁর এই উক্তির সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী সংবাদ তিন দিন আগে অর্থাৎ ৩ জুলাই প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এক. তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর এখন নেতা কামরুল ওরফে আসাদ এবং দুই. নিরাপত্তা বাহিনীর এক সাবেক সদস্য এখন নব্য জেএমবির সামরিকপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন। অর্থাৎ এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে যে বিষয়টি দৃশ্যমান তা হলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে একের পর এক জঙ্গিনেতা নিহত হলেও অন্যরা নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক উক্তির সঙ্গে গত ৩ জুলাইয়ে অন্য একটি প্রকাশিত সংবাদে পুলিশের আইজি যে কথা বলেছেন তার মিল রয়েছে। পুলিশপ্রধানের দাবি হলো, জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যায়নি, তবে তাদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা হয়েছে। তাঁর অন্য উক্তি ছিল, নেটওয়ার্ক ধ্বংস হওয়ার ফলে জঙ্গিরা আর সক্রিয় হতে পারবে না। পুনরাবৃত্তি করে বলা যায়, এ ধরনের উক্তিতে আত্মসন্তুষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়; যা বহুলাংশে অনুমাননির্ভর। জেএমবি সংগঠনের নেতা বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমান নিহত হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে নব্য জেএমবির উত্থান ও নারকীয় কর্মকা- শুরু হয়েছিল। পর পর কয়েকটি সফল অভিযানের পর তাদের কর্মকা- কিছুটা নিষ্ক্রিয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় না যে তারা আবার সক্রিয় হবে না বা হতে পারবে না। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট যেসব মন্তব্য বক্তব্য দিয়েছেন, তা থেকে দুটি বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এক. দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও সামগ্রিক পরিকল্পনা এবং দুই. গোয়েন্দা বাহিনীর অধিকতর অনুসন্ধানী দক্ষতা।
প্রথমটির ক্ষেত্রে বলা যায় যে এ পরিকল্পনা বর্তমানে নেই অথবা সচলভাবে দৃশ্যমান নয়। দুইয়ের ক্ষেত্রে বলা যায় যে অনুসন্ধান সম্পর্কিত দক্ষতা আগের চেয়ে অনেকাংশে বৃদ্ধি পেলেও অধিকতর বৃদ্ধির অবকাশ রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় জীবিত জঙ্গিদের ধরার পর দ্রুত মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে যে আটক জঙ্গিরা অনেকেই জামিনে মুক্তি পাচ্ছে, যা মামলা পরিচালনায় অদক্ষতার পরিচয় বহন করে। চলমান জঙ্গিবিরোধী প্রচেষ্টায় যেসব অপূর্ণতা বা শূন্যতা রয়েছে, তা দূর করা প্রয়োজন।
< Prev | Next > |
---|