tulippমাহমদুল বাসার

জাতির জনক বঙ্গন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিকী। গত ৮ জুনের ব্রিটেনের আগাম নির্বাচনে টিউলিপ গত বারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন ভোটে বেশি পেয়ে জয়ী হয়েছেন। গত নির্বাচনে তিনি ভোট পেয়েছিলেন ২৩ হাজার ৯৭৭ টি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ১ হাজার ১৩৮ ভোটে পরাজিত করেছিলেন। ওখানে তারেক জিয়ার বিএনপি টিউলিপের বিরোধিতা করেছিলো। টিউলিপ ছায়ামন্ত্রী সভার সদস্যও হয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে তিনি ভোট পেয়েছেন ৩৪ হাজার ৪৬৪ টি। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পেয়েছেন ১৮ হাজার ৯০৪ ভোট। এতে বোঝা যাচ্ছে টিউলিপ ব্রিটেনের নতুন প্রজন্মের ভোটারদের মন জয় করতে পেরেছেন। টিউলিপের বয়স এখন ৩৫ বছর। তার মা ও খালা ১৫ আগস্টের বিপর্যয়ের পর আর বাংলাদেশে ফিরতে পারেন নি। বলতে গেলে টিউলিপ বিদেশেই বড় হয়ে উঠেছেন। শেখ রেহানা ১৫ আগস্টের শোক বুকে বহন করে কীভাবে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা লেখা আছে তার স্বামী ড. শফিক সিদ্দিকীর লেখা ‘তোমাদের দোয়ায় বেঁচে এলাম’ বইতে। ড.সিদ্দিকীও কঠিন অসুখে পড়েছিলেন, বাঁচার কথা ছিলো না। সিঙ্গপুরে তার মাথার অপারেশন হয়েছিলো। এরই মধ্যে বড় হয়ে উঠেছেন টিউলিপ। কত কষ্ট করেছেন তার মা শেখ রেহানা, চাকুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন, তাও লেখা আছে ড. সিদ্দিকীর বইতে। আর ১৫ আগস্টের দিন শেখ হাসিনা-রেহানার কী করুণ দশা হয়েছিলো জার্মানীতে তা লেখা আছে ড. ওয়াজেদের বইতে। দুই বোনকে বুকে আগলে রেখেছিলেন সাবেক স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।

টিউলিপ লন্ডনের মিচামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গবারর্মেন্ট বিষয়ে তার ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি আছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেটার লন্ডন এবং সেভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গে কাজ করেন টিউলিপ। যিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হন। ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালি নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন টিউলিপ। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে স্থানীয় পাটির সদস্যদের ভোটে টিউলিপ হ্যাম্পস্টেট অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে লেবার পার্টির হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার টিকেট পান।
দ্বিতীয় বারের মতো নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর টিউলিপ বলেন, ‘আমি ওয়েস্ট মিনিস্টারে হ্যাম্পস্টেট অ্যান্ড কিলবার্নের হয়ে সরব হ্ব, ওয়েস্ট মিনিস্টারের হয়ে নয়। বাংলাদেশি কমিউনিটির হয়ে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, কনজারভেটিভ যে জনবান্ধবহীন মেনিফিস্ট দিয়েছে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি নিজের নির্বাচনী আসনের জন্য অতীতের মতো কাজ করে যাবেন বলে জানান। ব্রেক্সিট নিয়ে দরকষাকষির দিকেও নজর রাখবেন বলে জানান টিউলিপ।
টিউলিপের মা শেখ রেহানা বলেন, ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন হঠাৎ করে চাপ সৃষ্টি করলেও রাজনৈতিক পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে টিউলিপ এটিকে সামলে বিজয় নিয়ে এসেছে, এ বিজয় সমগ্র বাংলাদেশের।’ (জনকণ্ঠ-১০-৬-১৭)।
টিউলিপের বিজয়ে বিবৃতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার ড, শিরীন সারমিন চৌধুরী।
টিউলিপ প্রথমত বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, দ্বিতীয়ত তিনি সমগ্র বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছেন। যুক্তরাজ্যের নাগরিক হলেও তিনি বাঙালি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে তার শেকড় প্রোথিত। তার বিকশিত হওয়ার পেছনে অবশ্যই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
১৫ আগস্টের কালো রাতে যে পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলো খুনীরা , সেই পরিবারের সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, সায়মা হোসেন পুতুল এবং টিউলিপ সিদ্দিকী। আমেরিকান ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিং ওয়ের কথাটি মনে পড়ে, ‘এ ম্যান ক্যান ডিস্ট্রয়েট বাট নট ডিফিটেড।’

টিউলিপকে নিয়ে একজন বাংলাদেশি-বাঙালি হয়ে নানান প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দিয়েছে। তিনি কি ব্রিটেনের রাজনীতিতে আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবার বাসনা পোষণ করেন? তিনিতো লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের ছায়ামন্ত্রী হয়েছিলেন। হয়তো আবারো ছায়ামন্ত্রী হবেন, হয়তো কেন নিশ্চয়ই হবেন। আমি ধারণা পোষণ করি যে তিনি ব্রিটেনের রাজনীতিতে, লেবার পার্টির শীর্ষ স্থানে পৌঁছে যাবার অধ্যাবসায় চালিয়ে যাবেন। সেই যোগ্যতা তার আছে, সেই পথে চলার প্রেরণাও তার আছে।

তিনি জাতির পিতার নাতনি, প্রধানমন্ত্রীর ভগ্নি, এমনি বড় মাপের দুটি পরিচয় তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে; কিন্তু তার পরও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারটা তার নিজেরই গড়তে হয়েছে। তার বাবাও একজন উঁচু মাপের বিদ্বান। তার মা শেখ রেহানার মধ্যে আছে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পরিশীলিত রুচি। একটি রুচিশীল পৃথিবীতে, ইউরোপের কালচার্ড পরিবেশে বড় হয়েছেন টিউলিপ। ইউরোপের মুক্তচিন্তার দ্বারাই তিনি প্রভাবিত হয়েছেন, তাইতো লেবার পার্টির সদস্য হয়েছেন। রক্ষণশীলদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কনজারভেটিভরা চায় ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দিতে। এতে বর্ণবাদ ও ধর্মবিদ্বেষ মাথা চাড়া দিয়েছে যুক্তরাজ্যে। এই সংকীর্ণতার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে লেবার পার্টি এবং টিউলিপও। লেবার পার্টির মধ্যেও ব্রেক্সিট পন্থী আছেন, আবার কনজারভেটিভদের মধ্যেও বেক্সিট বিরোধী আছেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন তার কলামে, ‘ব্রেক্সিট প্রশ্নে কনজারভেটিভ এবং লেবার দুই দলই বিভক্ত। বলতে গেলে গোটা ব্রিটিশ ন্যাশনই বিভক্ত।’ (সমকাল-১০/৬/১৭)। এই ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া ইউরোপ আমেরিকায় বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়েছে, উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে, তার খবর আমরা পত্রিকায় পেয়েছি। এই অবস্থার মধ্যে টিউলিপ যেমন লেবার পার্টির রাজনীতি করছেন তেমনি ব্রেক্সিট বিরোধী ভূমিকা নিয়েছেন। এবারের নির্বাচনী প্রচারণার সময় লেবার নেতা জেরেমি করবিন একটা মারাত্মক কথা বলেছেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলামে পেয়েছি, ‘ব্রিটেনে সম্প্রতি দু’টি বড় বড় সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার পর জেরেমি করবিন সাহসের সঙ্গে বলেন, ‘এই সন্ত্রাসের কারণ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র নীতিতেই নিহিত। অপর দেশে হামলা চালালে নিজের দেশেও পাল্টা হামলা ডেকে আনা হয়।’
এর চেয়ে সত্য কথা আর হতে পারে না। করবিন আরো বলেছেন, ‘আমি আমেরিকার সঙ্গে সমঝোতা করবো কিন্তু আমেরিকার হুকুমের দাস হবো না।’ এই কথা দু’টো যুক্তরাজ্যের তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করেছে। টিউলিপ যে লেবার পার্টির আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত তাতে সন্দেহ কী? তিনি একটি ধর্ম নিরপেক্ষ পরিবারের সন্তান। তিনি বর্ণবাদকে উস্কে দেবার জন্য ব্রেক্সিট পন্থী হতে পারেন না। ব্রেক্সিট প্রশ্নেই টিউলিপ ছায়ামন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেছিলেন। সে বিষয়ে লন্ডনের একটি পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিলেন। কলামটি বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক অনুবাদ করে ছাপিয়েছিলো। সেখানে টিউলিপ বলেছেন, ‘কেন পদত্যাগ করেছিলেন। বলেছেন তিনি, ‘ওয়েস্ট মিনিস্টারে আমি হ্যাম্পস্ট্যান্ড অ্যান্ড কিলবার্নের প্রতিনিধিত্ব করি মাত্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়লে আমার আসনের নাগরিকরা বিপুল অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। আমি এ সত্য কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না।
আমার আসনের বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনও ব্রেক্সিটের পর তাদের আবাসিক অধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা পাননি। তাহলে কী ভাবে আমি এর পক্ষে ভোট দেব? আমাদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও বিশাল প্রশ্ন রয়ে গেছে। ব্রেক্সিটের প্রক্রিয়া শুরু হলে দেশের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী উদ্যোগও উপেক্ষিত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে লন্ডন আসনের একজন এমপি হিসেবে এর পক্ষে ভোটের সুযোগ কি আমার আদৌ আছে?’
এটা দলীয় উপলব্ধি নয়, টিউলিপের নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধি। তার মুল্যবোধ বর্ণবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী। ব্রিটেনের রাজনীতিতে তিনি আরো এগিয়ে যেতে পারবেন বলে আমাদের ধারনা।

মাহমুদুল বাসার
কলামলেখক, গবেষক।

সাম্প্রতিক