মোমিন মেহেদী
দীর্ঘ ১ মাস ধর্মিয় দায়িত্ব হিসেবে রমজানের রোজা পালনের পর যখন বাংলাদেশ সহ সারা মুসলিম বিশ্বে যখন ঈদ পালিত হবে, তখন চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গু আক্রান্ত থাকবে অসংখ্য মানুষ। সেই অন্ধকারের নেপথ্য নায়ক নগর মেয়র আর রাষ্ট্রিয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে বরাবরের মত এবারও কথা বলবো বলে কলম হাতে নিয়েছি। কেননা, নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে বরাবরই স্বেচ্ছায় অন্ধকারের বিরুদ্ধে এগিয়ে চলেছি আলোর মশাল নিয়ে। আজো তারই ধারাবাহিকতায় তুলে ধরছি চিকুনগুনিয়ার সাতকাহন। যতদূর জানতে পেরেছি- চিকুনগুনিয়ার জন্ম ১৯৫২ সালে আফ্রিকায়। প্রথম তানজানিয়ায় রোগটি শনাক্ত হয়। তবে এখন বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে রোগটি দেখা যায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই রোগের কোনো নির্দিষ্ট প্রতিকার বা প্রতিষেধক নেই। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে, বাংলাদেশের মানুষ সবসময়-ই যেন আঁচ করতো। কেননা, মশার প্রকোপে প্রতিদিন এই দেশে শত শত নয়; হাজার হাজার নয়; লাখ লাখ টাকার মশার কয়েল আর এরোশল বিক্রি হয়। তবু বাংলাদেশে মশার কামড় আর পরিবশেগত সমস্যার জালে বন্দী হচ্ছে নাগরিকজীবন। এই জীবনের রাস্তায় অগ্রসর হতে হতে ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়া। এমন একটা পরিস্থিতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সেই দেশের রাজধানীতে প্রতি ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। হঠাৎ করে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মাঝে এক আতঙ্ক বিরাজ করছে। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের ভিড় বাড়ছে। বর্ষাকালের আগে থেকেই হঠাৎ হঠাৎ অতিবৃষ্টি হওয়ায় যেখানে-সেখানে পানি জমে থাকায় মশা ডিম পাড়ছে। আর এই অতিরিক্ত মশার কারণে হঠাৎ করেই বেড়েছে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের প্রকোপ।
আমাদের অস্বাস্থ্যকর দূর্গন্ধযুক্ত নগরীতে চিকুনগুনিয়া নামে একটি ভাইরাসজনিত রোগ মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস যে মশা বহন করে, সেই এডিসই চিকুনগুনিয়া ভাইরাসও বহন করে। জ্বর মানেই ‘চিকুনগুনিয়া’ নয়। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মাথাব্যথা, সর্দি, বমি বমি ভাব, হাত-পা ও আঙুলের গিঁটে গিঁটে ব্যথা, ফোসকা পড়া ছাড়াও শরীর বেঁকে যেতে পারে। চিকুনগুনিয়া জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এ রোগের চিকিৎসা বাসা-বাড়িতেই সম্ভব। সাধারণত এডিসের কামড়ানোর পাঁচদিন পর থেকে শরীরে লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে। বাংলাদেশে এতে আক্রান্তদের মধ্যে কারো মৃত্যুর ঘটনা নেই তবে যারা আগে থেকেই ডায়াবেটিক ও হৃদরোগসহ নানা ধরণের পুবনো রোগে ভুগছেন তাদের মৃত্যুঝুঁকি থাকছে। এই পরিস্থিতিতে সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য, নাগরিককে কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য নগর দুটির একটিরও মেয়র তাদের আন্তরিকতার পরিচয় দেন নি। বরং নাগরিকের স্বাস্থ্য-খাদ্য-জীবনাচারণসহ সকল ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক কৌশল ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই সুযোগে গড়ে উঠছে অন্যায়ের রাস্তা। যে রাস্তায় অগ্রসর হতে হতে তাদের অবহেলার সুযোগে গড়ে উঠছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সুযোগ-সন্ধানীদের অন্যায় আর অপরাধের রাজত্ব। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত নগরীর অসংখ্য মানুষ যখন নিজেদের রোগ-দু:খ নিয়ে হতাশাগ্রস্থ তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসকের তথ্যানুযায়ী ডেঙ্গু জ্বরের সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার অনেক পার্থক্য রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সাধারণত এত দীর্ঘ সময় ধরে শরীর ব্যথা বা অন্য লক্ষণগুলো থাকে না। যদিও জ্বর ভালো হয়ে গেলে কয়েকদিন দুর্বলতা বা ক্লান্তি লাগতে পারে। চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত হলে কেউ মারা যায় না, তবে যে ব্যক্তি আগে থেকেই বিভিন্না রোগে ভুগছেন তাদের যদি চিকুনগুনিয়া হয় তাহলে তার ঝুঁকিটা থাকছে। এছাড়া এ রোগে দীর্ঘদিনের জন্য অনেকেই স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারেন। এর পাশাপাশি সবসময় মনে রাখতে হবে যে, চিকুনগুনিয়া সন্দেহ হলে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রোগীর রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এন্টিবডি পরীক্ষা করে দেখা হয়। রোগীর আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে শুধু শুধু এ পরীক্ষা করার কোনো দরকার নেই। এতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো লাভ হবে না। চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা মূলত রোগের উপসর্গগুলোকে নিরাময় করা। সে অনুযায়ী ওষুধ দেয়া যায়। এ জ্বরে রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি বা অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা না করে জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। এর সঙ্গে সঙ্গে পানি দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিতে হবে। তীব্র ব্যথার জন্য অন্য ভালো ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে, তবে এসপিরিন না ব্যবহার করাই ভালো। রোগীকে আবার যেন মশা না কামড়ায় এ জন্য তাকে মশারির ভেতরে রাখাই ভালো। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আক্রান্ত রোগীকে মশায় কামড় দিয়ে অন্য কোনো সুস্থ লোককে সেই মশা কামড়ালে ওই ব্যক্তিও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। এছাড়া চিকুনগুনিয়া জ্বরের কোনো প্রতিষেধক নেই, কোনো ভ্যাক্সিন বা টিকাও নেই। তাই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো এডিস মশা প্রতিরোধ।
এডিস মশা প্রতিরোধের জন্য নগর ভবন দুটি থেকে কোন ব্যবস্থা তো নেই-ই। বরং আছে ডাস্টবিন, আছে ময়লা পানি জমে থাকার মধ্য দিয়ে মশা জন্মের জন্য নিবেদিত কারখানা। জনগনকে সচেতন করার জন্য কোটি কোটি টাকা নষ্ট করে বিজ্ঞাপন প্রদান করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই দপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে তারা যে তথ্য দিয়েছে; তা হলো- ঢাকা শহরের ২৩টি এলাকাকে চিকুনগুনিয়ার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়। এলাকাগুলো হচ্ছে- ধানমন্ডি ৩২, ধানমন্ডি ৯/এ, উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর, মধ্যবাড্ডা, গুলশান-১, লালমাটিয়া, পল্লবী, মগবাজার, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, রামপুরা, তেজগাঁও, বনানী, নয়াটোলা, কুড়িল, পীরেরবাগ, রায়েরবাজার, শ্যামলী, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর, মণিপুরি পাড়া, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, মিরপুর-১ ও কড়াইল বস্তি। গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর এ ২৩টি এলাকায় চিকুনগুনিয়ার বাহক মশার ঘণত্ব বেশি। তাই এসব এলাকায় মশক নিধন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এই আহবান পর্যন্তই শেষ নয়; আমরা চাই সরাসরি পদক্ষেপ; চাই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে চিকনগুনিয়া বা ডেঙ্গু তৈরির জন্য এডিশ মশা থাকবে না; থাকবে না অন্ধকার। এই অন্ধকার থাকবে না বলেই বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, নব্বইয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অন্তত সিটি কর্পোরেশনে মশক নিধন কর্মসূচি জোরদার করা প্রয়োজন, প্রয়োজন চিকুনগুনিয়া থেকে সবাইকে সচেতনতা তৈরির জন্য কাজ করা।
যতদূর সম্ভব মনে রাখতে হবে, যেন বাড়ির কোথাও পানি জমে না থাকে। এডিস মশার উৎপত্তি হতে পারে এমন কোন স্থানে পানি জমা না হওয়ার বিষয়ে আমাদেরকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। তাই বাড়ির ভেতরে, বাড়ির ছাদে যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে জনগণকে খেয়াল রাখার বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে আতঙ্ক না ছড়িয়ে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে।
সারাবিশ্বে গত ৫০ বছরে চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এটি একটি বাহকবাহিত রোগ। প্রতি বছর বিশ্বে বাহকবাহিত রোগে এক কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়। গত বছর ভারতে প্রায় ১২ লাখ মানুষ এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ৯২ শতাংশের জ্বর ও ৮২ শতাংশের ক্ষেত্রে গিঁটে ব্যথার লক্ষণ সুস্পষ্ট। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার মশা নিধনের দায়িত্ব মশক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। কিন্তু এই দপ্তরের ব্যর্থতার পর এ কাজ চলছে যৌথভাবে। অধিদপ্তরের মোট জনবলের সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু জনবল যুক্ত করে যৌথভাবেই নগরীর মশা নিধনের কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। তবে রাজধানীতে সিটি কর্পোরেশনের ময়লা পরিষ্কারে উদাসীনতা ও মশক নিধন কর্মসূচি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই রোগের বাহক মশার বিস্তার বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে রাজধানীর মশা নিধনে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সফলতা দেখাতে পারেনি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন সোয়া ২৩ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সাড়ে ১১ কোটি টাকাসহ মোট ৩৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখে। অথচ এ পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে রাজধানীর মশা নিধনে সফলতা দেখাতে পারেনি কোনো সিটি কর্পোরেশনই। এই ব্যর্থতার কারণে সারাদেশে সাধারণ মানুষের ঈদ-উৎসব কান্নায় আর হতাশায় রুপ নিয়েছে। এর পেছনের কাহিনী হলো- স্বার্থন্বেষী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি মালিকদের কাছে ওষুধ বিক্রি করে দিচ্ছেন মশক কর্মীরা। আবার অনেকেই টাকা নিয়ে বিত্তশালীদের বাড়িতে স্প্রে করছেন। মশা উৎপাদনের স্থানগুলোর আশপাশে ছিটানো হচ্ছে না ওষুধ। এতে দিন দিন বাড়ছে মশার উৎপাত আর মশাবাহিত নানা রোগ। বর্তমানে রাজধানীতে মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া রোগ বিস্তার হয়েছে সিটি কর্পোরেশেনের ব্যর্থতার কারণে। এই ব্যর্থতার হাত থেকে মুক্তি পেতে নগর পিতাদ্বয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে এখনই। প্রয়োজনে ঈদের আনন্দকে মাটি করে দেয়ার মত অবিরত অন্যায় আর অপরাধ করে চলা লোভি-অদক্ষ-অযোগ্য এই সকল আমলা-কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ঈদের দিন থেকেই শুরু করতে হবে প্রতিরোধ আন্দোলন, দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান, অনশন কর্মসূচী...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি এবং উপদেষ্টা, জাতীয় শিক্ষাধারা
< Prev | Next > |
---|