রাজু আহমেদ
বাংলাদেশের জন্মের সাথে ভারতের বন্ধুত্ব জড়িয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতির জীবদ্দশায় ভারতের সাথে বাংলাদেশের যতোটা মধুর ও গভীর সম্পর্ক ছিল তার চেয়ে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক বেশি গভীর-মধুর। তবে নানাবিধ কারণে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সাথে ভারত সরকার ও সাধারণ মানুষের বন্ধুত্বের ভাবনায় ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় প্রত্যহ, ভারতের সীমান্তরক্ষীদের নির্বিচার গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিকদের হতাহতের ঘটনাই দূরত্বের মাত্রা নিয়ত তীব্র করছে। অথচ বাংলাদেশী সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে বিগত দশ বছরেও কোন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়েছে এমন সংবাদ গণমাধ্যমে আসেনি। তারপরেও, ভারতের প্রতি রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ের নতজানুভাব দেশপ্রেম তথা এদেশের মানুষের স্বার্থরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রদানের প্র্রশ্নে দায়িত্বশীলদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় বহুগুন দূর্বল, আকৃতিতে ক্ষুদ্র এবং ভৌগলিক ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলসহ বিভিন্ন দিকের বিবেচনায় বাংলাদেশের কতিপয় রথী-মহারথী ভারতমুখী। তবে এই দুর্বলতার সুযোগে যখন ভারতের সরকারি বাহিনী কর্তৃক সীমান্তহত্যা লাঘামহীন চলছে তখন দু’দেশের বন্ধুত্বের মধুরতার কপালে তিলক এঁকে দেয় ! প্রতিবেশীর সাথে ভারতের আচরনের শিষ্টাচারের মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
উৎপত্তিগতভাবেই ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী এবং বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার সিংহভাগ ভারতের সীমান্তের সাথে যুক্ত। প্রতিবেশী হিসেবে বন্ধুত্বপূর্ণ যে সুসম্পর্ক দু’দেশের সীমানায় বিরাজমান থাকা উচিত ছিল তা বারবার বিএসএফ সদস্যদের বাড়াবাড়ির দ্বারা লঙ্গিত হয়েছে। বিএসএফের আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশীদের বর্ষপঞ্জি থেকে এমন কোন পক্ষকাল কিংবা মাস অতিবাহিত হয়না যে সময়টাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিক হতাহত না হয়। আসন্ন ঈদের আগে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী আবারও বাংলাদেশীদের উপহার দিল দু’টো হত্যার সংবাদ। দুর্ভাগ্য এটাই, এখন অবধি নিথর দেহ দু’টোও তাদের স্বজনরা পায়নি বরং তা বিএসএফ সদস্যরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে। এ বন্ধুত্বের ধারাবাহিকতায় চলতে থাকা বন্ধুত্বের বন্ধসূলভ বিনিময় ! এ প্রতিদানের ভার বইতে বইতে বাংলাদেশীদের হৃদয় আজ ভারাক্রান্ত, চোখের পানি শুষ্ক, অসহায় দৃষ্টিও ক্লান্ত ! অথচ বিজিবি কর্তৃক ভারতের দিকে বিগত কয়েক বছরে ছোঁড়া গুলিতে কেউ হতাহত হওয়া তো দূরের কথা বরং অস্ত্র ওদিকে তাক করে বিস্ফোরিত পর্যন্ত হয়নি। লাশের মিছিলে বাংলাদেশীরা এককভাবে দিয়ে যাচ্ছে বন্ধুত্বের খেসারত ! এমন বন্ধুত্বের শ্রী বিশ্ব মানচিত্রের অন্য কোথাও দুর্লভ !
সীমান্ত হত্যার সংখ্যার ধারাবাহিকতায় ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত হত্যা একপেশে ভারতের ধারা ক্রমশ লাঘামহীন হচ্ছে। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে জঘণ্য ও কুখ্যাত সীমান্ত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোর মধ্যকার সনেরো লাইন। বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি মানুষ এ লাইন অতিক্রম করার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। তবে এদের বেশিরভাগ যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা মেক্সিকোর নাগরিক নয় বরং মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে পাড়ি দেওয়া অভিবাসী। অন্যান্য দেশের মধ্যকার সীমান্ত লাইনগুলোর মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের র্যাডক্লিফ, আফগানিস্তান-পাকিস্তানের ডুরান্ড, রাশিয়া-ফিনল্যান্ডের ম্যানারহেম, লেবানন-ইসরাইল ব্লু, সিরিয়া-ই¯্রাইলের পার্পল, যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ৪৯ ডিগ্রি অক্ষরেখা, উত্তর ও দক্ষিন কোরিয়ার মধ্যকার ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা প্রভৃতি সীমান্ত লাইনগুলোতে মঝে বিবাদমান দেশগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয় বটে কিন্তু তাতে এককভাবে কোন দেশের নাগরিক হতাহত হয়না বরং কোন দেশের দু’জন হতাহত হলে অন্য দেশের অন্তত একজন কিংবা একাধিক হতাহত হয়। হত্যার সমীকরণেও সেখানে সাম্যতা আছে ! অথচ বাংলাদেশের সাথে ভারতের সীমান্ত সংঘর্ষ একেবারেই ভিন্নরূপের বর্ণনা দেয়। এখানে একচেটিয়াভাবে হত্যা করা হচ্ছে হচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিকদের। আমরা নীরিহ মানুষকে হত্যা সমর্থন করিনা হোক সে বাংলাদেশের, ভারতের কিংবা অন্যকোন দেশের। আমরা শুধু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সমাধান চাই। অথচ আমাদের দেশের কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা ও বিজিবির সদস্যদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, ভারতীয় বাংলাদেশ সীমান্ত যাই করুক, ওদিকে গুলি ছোঁড়া তো দূরের কথা ফাঁকা আওয়াজ করার অনুমতিও বোধহয় নাই। কাজেই বর্ষপঞ্জি পাড়ি দেয়ার ফাঁক-ফোঁকড়ে দু’চারটে ফেলানীর নিথর দেহে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে দেয়া বন্ধুত্বের উপহার ! মনে রাখতে হবে, শক্তের ধর্মই এমন, এ কেবল দুর্বলকে পিষে যায়। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, অত্যাচারীর সামনে যে যত দুর্বলতা দেখাবে তার প্রতি অত্যাচারের স্টীম রোলার তত বেশিবার চালানো হবে । ভারতের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তারা এ নীতিই অনুসরণ করছে।
ভারতীয়রা আজ আমাদের বন্ধুত্বের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও প্রকৃতির পাঠ দিচ্ছে ! আমাদের দাবী ও ন্যায্য অধিকারের কোনটাই পূরনে তাদের সম্মতিটুকুও আদায় করা যাচ্ছে না। অথচ তাদের দাবীর সবগুলোই এখান থেকে হাসিমুখে দিল্লীতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। আমরা তিস্তা-গঙ্গার ন্যায্য পানি পাচ্ছি না অথচ আমাদের ক্ষতি হবে জেনেও তারা বিভিন্ন সময় পানির প্লাবন ছেড়ে আমাদের ফসল নষ্ট করে দিচ্ছে, মাসের পর মাস বন্যার ¯্রােত বইছে এদেশের জেলায় জেলায়। তাদের ক্রিয়ায় কখনো কখনো নদী আর স্থলভূমিতে পার্থক্য করা যাচ্ছে না। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যে তিস্তা ও গঙ্গার পানিতে আমাদের ন্যায্য অধিকার তা অবৈধভাবে আটকে রাখায় আমাদের দেশের সমগ্র উত্তরাঞ্চল রবি মওসূমে বিরাণ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে বছরের পর বছর। সেসব অঞ্চলের দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষগুলো পেয়েছে মঙ্গাপীড়িত এলাকার অধিবাসীর উপমা। এসব কিছুই ভারতের বন্ধুত্বের বিনিময় ! কালের যাত্রায় ক্ষতিটুকু সব আমরা গ্রহন করছি আর ভালোটুকু পৌঁছে দিচ্ছি কথিত বন্ধুদের থলে।
বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক্ষ সীমান্ত হত্যা বন্ধের আশ্বাস বহুবার এসেছে অথচ বন্ধের বিপরীতে সীমান্ত হত্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এই যদি হয় বন্ধুপ্রতীম দেশের আচরণ তবে শত্রুদের আচরণের অভিধা কেমন হবে ? যারা তিরস্কার করে বলেছিল, ভারত যাদের বন্ধু তাদের আর শত্রুর দরকার পড়েনা। আজ সে উক্তিতে নিহিত সত্য দেশবাসী খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করছে। নয়তো ভারতের দ্বারা এভাবে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ চির শত্রুতাভাবাপন্ন কোন দেশের বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হওয়ার যৌক্তিক ভিত্তি থাকতে পারেনা। অথচ ভারতীয় বাহিনী দ্বারা নারকীয় এমন হত্যাযঞ্জের ঘটনার বারবার পূনরাবৃত্তি হচ্ছে, সকালে-বিকালে হচ্ছে। প্রিয় রাষ্ট্র, তোমার নীরিহ সন্তানদেরকে এভাবে যারা হত্যা করছে তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থার সামর্থ্য তোমার না থাকলেও অন্তত এসব অনাচার-অবিচার বন্ধে জোড়ালো প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানোর শক্তিটুকু তো স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্ত্বা হিসেবে তোমার অবশিষ্ট থাকা আবশ্যক।
রাজু আহমেদ। কলামিষ্ট।
Next > |
---|