মোমিন মেহেদী
motamotসুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) এক বছরে বাংলাদেশি সঞ্চয় ১৯ শতাংশ বেড়েছে; এমন সংবাদে দিনে চাঁদ দেখার মত করে চমকে উঠছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। সেই ১৯ শতাংশ বাড়ার পেছনে যে, তাদেরই হাত রয়েছে; তা শুনলে হয়তো তাদের চোখের পাতা থেকে আর তারার আবাস লড়বেই না। গভীরতর রাজনৈতিক প্যাচে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক। বিশেষ করে অথনৈতিক বর্তমানের দিকে তাকালে দেখবো যে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশিদের সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ৮৫ টাকা হিসাবে)। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে যা ছিল ৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেড়েছে ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। সম্প্রতি সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আমি মনে করি রাজনীতিকদেরকে অন্যায় আর অপরাধের রামরাজত্ব তৈরির সুযোগ গড়ে দিয়ে আম জনতাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে দেশ ও দশের। নির্বাচনের আগের রাতে ১০০০ টাকা থেকে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত পেয়ে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে যাকে নির্বাচিত করছে; সে যে, যখন তখন নির্বাচিত হওয়ার পরই সেই ১০০০ থেকে ১০০০০ টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে এবং তা ঐ ভোটারের কাঁধে কাঁঠাল রেখেই; তা কিন্তু খেয়াল করতেই পারছে না জনগন। মাঝখানে তাদেরকে বিক্রি করে, ঠকিয়ে অন্ধকারের চোরাগলিতে তৈরি হয়ে আমাদের লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকা মজুদ করছে সুইস ব্যাংকে। হায়রে বাংলাদেশ, হায়রে স্বাধীনতা, হায়রে রাজনীতি! অন্যায় আর অপরাধের রামরাজত্বই যদি তৈরি হবে; তাহলে আর এত বড় বড় লেকচার কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীরও। আর তাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে তিনি বলেন, দুর্নীতির বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্সে আছি।

প্রধানমন্ত্রী বলছেন, দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স; আর সুইস ব্যাংক বলছে, দেশের টাকা কোন রকম অনুমোতি না নিয়েই যেসব বাংলাদেশি পরিচয় প্রদান করে টাকা জমা রেখেছেন এটি হল তার চিত্র। কিন্তু এর বাইরে যারা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে টাকা রেখেছেন সে হিসাব এখানে নেই। ধারণা করা হচ্ছে, পরিচয় গোপনকৃত টাকা যুক্ত হলে এর পরিমাণ হবে আরও কয়েকগুণ। এ ছাড়া এর বাইরেও বিদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে থাকে। হুন্ডি ছাড়াও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়। এমনকি ভুয়া এলসি খুলে কোনো কিছু আমদানি না করেও পুরো টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার ধারণা যে, জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই এই অপকর্মটির সাথে জড়িত। যদিও পথ দেখিয়েছেন , সাবেক রাজপুত্রখ্যাত তারেক রমহান। যার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়ে আমাদের গর্বিত সেনা বাহিনী প্রমাণ করেছিলো যে, জনগন যাদের দিকে ধাবিত হয়; তারাই বিজয়ী হয়; সেই বার অবশ্যই সেই বিজয়ের মালা গলায় পড়েছিলো বাংলাদেশ সেনা বাহিনী, র‌্যাব ও দুদক। আর এখন ২০১৭ থেকে মন্দা বাজার হওয়ায়, বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি পাচার হচ্ছে। আলোচ্য সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আমানত কমেছে। আমানত রাখার ক্ষেত্রে এ বছরও প্রথম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য।

সুইস ব্যাংকে আমার টাকা কেন চলে যাচ্ছে? একারণে যে, জনগনকে বোকা বানানোর সকল কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে-ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে ব্যাংক লীগ, বীমা লীগ এবং আওয়ামী লীগ। আর এই সকল কারণে এই বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মূলত তিনটি কারণ। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারও বেড়েছে। এছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। বাংলাদেশে শতাধিক কালো শাদা বহনকারী রাজনৈতিক দল রয়েছে; এর মধ্যে শুধু এওকটাই রাজনৈতিক ধারা নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবির চেয়ারম্যান হিনেসবে বলবো-অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিনিয়োগ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তা না হলে হয় তো আরো বড় প্রতিবেদন নিমর্তি হবে। গত ১২ বছরের মধ্যে ২০১৬ সালেই সবচেয়ে বেশি আমানত সুইস ব্যাংকে। আলোচ্য সময়ে আমানতের পরিমাণ ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৫ সালে ৫৫ কোটি ৮ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৪ সালে যা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৩ সালে ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্র্যাংক, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। অপরদিকে ২০১২ সালে ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ ফ্র্যাংক। স্বর্ণালংকার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না। ২০০২ সালে ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০০৪ সালে ৪ কোটি ১০ লাখ, ২০০৫ সালে ৯ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৬ সালে ১২ কোটি ৪০ লাখ, ২০০৭ সালে ২৪ কোটি ৩০ লাখ, ২০০৮ সালে ১০ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৯ সালে ১৪ কোটি ৯০ লাখ এবং ২০১০ সালে ২৩ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক রয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে আলোচ্য সময়ে বিশ্বের সব দেশের আমানত কমেছে। ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকে বিদেশিদের মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। এ হিসাবে মোট আমানত কমেছে ৫ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। ২০১৩ সালে ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি, ২০১২ সালে ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। এছাড়াও ২০১১ সালে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি, ২০১০ সালে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি এবং ২০০৯ সালে ছিল ১ হাজার ৩৩ হাজার কোটি ফ্র্যাংক।

এভাবে বাংলাদেশকে খাদের কিণারে কেন নিয়ে যায় আওয়ামী লীগ; আর সেই সুযোগে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। চীন প্রথম অবস্থানে। এগুলো সবই হয়েছে টাকা পাচারের মাধ্যমে। নিয়মানুযায়ী কোনো নাগরিকের বিদেশে টাকা নিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। তবে বিদেশে যারা আয় করেন তাদের সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে বাংলাদেশের আইনে কোনো সমস্যা নেই। আর তিনি আয়করের আওতায় এবং প্রবাসী কোটায় কোনো সুবিধা নিয়ে থাকলে বিদেশে সম্পদ থাকার তথ্যও তার আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করতে হবে। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো নাগরিক বিদেশে টাকা রাখলে তা দেশ থেকে পাচার বলে গণ্য হবে। এখন পর্যন্ত কাউকে বিদেশে টাকা জমা রাখার অনুমোদন দেয়া হয়নি। কোনো প্রবাসীও সরকারকে জানাননি যে তিনি সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছেন। ফলে সুইস ব্যাংকে জমা পুরো টাকাটাই দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে বলে গণ্য হবে। এর আগেও আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপেও বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা উঠে এসেছে। দীর্ঘ সময় ধরে ধনীদের অর্থ গোপনে জমা রাখার জন্য খ্যাত সুইজারল্যান্ড। ৮০ লাখ মানুষের এ দেশটিতে ব্যাংক আছে ২৬৬টি। বিশ্বের বড় বড় ধনী অর্থ পাচার করে দেশটিতে জমা রাখে। ব্যাংকগুলোও কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে। আগে সুইস ব্যাংকে জমা টাকার কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো না। এমন কী আমানতকারীর নাম-ঠিকানাও গোপন রাখা হতো। একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে টাকা জমা রাখা হতো। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী টাকা পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর করা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক চাপে সুইস ব্যাংক জমা টাকার তথ্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ওই সময় থেকে বিভিন্ন দেশের জমা টাকার তথ্য প্রকাশ করছে। ওই প্রতিবেদনে কোন দেশের কত টাকা জমা আছে, সে তথ্য তারা প্রকাশ করছে। কিন্তু আমানতকারীদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করছে না। এ কারণে পাচারকারীদের ঠেকানো যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় অন্যায় হলো দেশ ও মানুষের ক্ষতি করা। এই কাজটি যারা রাজনীতির নামে দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছেন; তাদের মনে রাখতে হবে যে, অর্থনীতির স্বাভাবিক অনুসারে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্যহীনতায় পুঁজি পাচার হয়। এ হিসেবে দেখা গেছে, দেশে সঞ্চয় বাড়ছে; কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ছে না। ওই টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নানাভাবে টাকা পাচার হচ্ছে। পণ্য আমদানির নামে ঋণপত্রের মাধ্যমে। কম দামে কম পণ্য এনে দেনা শোধ করা হচ্ছে বেশি দাম ও বেশি পণ্য দেখিয়ে। রফতানি পণ্যের একটি অংশের মূল্য দেশে আসছে না। ওই টাকাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। নগদ ডলার বা স্বর্ণের মাধ্যমেও দেশ থেকে টাকা চলে যাচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসা ব্যয়, বিদেশ ভ্রমণ, লেখাপড়ার খরচ- এসব মাধ্যমেও টাকা পাচার হচ্ছে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমেও টাকা পাচার হচ্ছে। আর সেই পাচার হওয়া অর্থ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের মোট জাতীয় বাজেটের দেড়গুণ। প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছরই এই পাচারের হার বাড়ছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়াতে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। কিন্তু কেন? উত্তর চাই, উত্তর জানা না থাকলে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে তাদের একাউন্ট চাই, বাংলাদেশের মাটিতে তাদের বিনিয়োগ চাই; গড়তেই চাই বাংলাদেশ, সুখে রাখতেই চাই আলোর পথযাত্রী হিসেবে বরাবর-সবসময়...

মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি এবং উপদেষ্টা, জাতীয় শিক্ষাধারা

সাম্প্রতিক