-মাহমুদুল বাসার
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেও বলেছেন, ‘আমরা বি এন পির মতো অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়বো না।’
ছাত্রজীবনে ওবায়দুল কাদের মেধাবী ছাত্রই ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। সাংবাদিক ও কলাম লেখক ছিলেন। তাই তিনি খুব অল্প কথায় বি এন পির সাম্প্রতিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে, ২০১৪-১৫ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বি এন পি সরকার সম্পর্কে ক্রমাগত অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে চলেছে।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অকল্পনীয় বিডিআর বিদ্রোহ ঘটেছিলো এবং প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝুঁকি নিয়ে, সূক্ষ্মমাত্রার কৌশল ব্যবহার করে অপ্রত্যাশিত বিদ্রোহটি দমন করেছিলেন। স্বদেশ রায় তার কলামে দেখিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও আওয়ামী পরিবার থেকে আসা তরুণ সৈনিকদের টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছিলো ওই বিদ্রোহে। তার পরও বি এন পি এ ব্যাপারে সরকারকে যে পরিভাষায় দোষারোপ করেছিলো, তা ছিলো অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো।
অত্যন্ত সুকৌশলে শেখ হাসিনার সরকার ২০১৩ সালের মে মাসে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকে বিতাড়িত করেছিলো। না হলে সরকারের পতন হয়ে যেতো। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক-কলাম লেখক পীর হাবিবুর রহমান খুব যুৎসই একটা কথা বলেছেন, ‘হেফাযত সরকারকে হুমকি দিয়ে এমন এক স্তরে চলে গিয়েছিলো যে, সরকারের পতন আসন্ন হয়ে উঠেছিলো ওই রাতে অর্থাৎ ২০১৩ সালের ৫ মে রাতে, অনেকেই হেফাজত ইসলামে সামিল হওয়ার জন্য টুপি আসকান কিনেছিলো।’ সরকারের কুশলী পদক্ষেপের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। এ ব্যাপারেও অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছিলো বি এন পি। বলেছিলো, ‘সরকার গণহত্যা করেছে।’ খালেদা জিয়া ঢাকা শহরের জণগনকে নিদের্শ দিয়েছিলেন হেফাজতের ১৩ দফার পক্ষে মাঠে নামার জন্য। সাদেক হোসেন খোকা নেমেছিলেন দা-বটি খোন্তা-কুড়াল নিয়ে। তাতে কোনো কাজ হয়নি। একের পর এক ব্যর্থতা বি এন পির অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি করেছে।
২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে ঘটেছিলো সাড়া জাগানো লগি বৈঠার বিপ্লব। এই বিপ্লব সফল না হলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের রাজনীতির পতন ঘটতো। বায়তুল মোর্কারম মসজিদে অবস্থান নিয়ে স্বাধীনতার শত্রু পক্ষ হুকুম দিচ্ছিলো, ‘গুলি ছোঁড়ো, বৃষ্টির মত গুলি ছোঁড়ো।’ তারপরও বি এন পি এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে যে ভাষায় দোষারোপ করে, তা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার পর্যায়ে পড়ে।’
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গে আসা যাক। আমরা যারা আমজনতা, তারা লক্ষ্য করছি বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের একটা ঠান্টা মতানৈক্যের সংঘর্ষ চলছেই। সম্প্রতি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেছে উচ্চতর আদালত। তাতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে রাখা হয়নি। এ ব্যাপারে সরকার ও সরকারি দল সর্তক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ যে স্বাধীন, এই রায়ই তার প্রমাণ।’ ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর দলের ওয়ার্র্কিং কমিটির সভায় এবং সংসদ অধিবেশনে আলোচনা হবে। তার পর মন্তব্য করতে হবে।’ আর বি এন পির পক্ষ থেকে এ রায়কে সরকারের পরাজয় হিসেবে ধরে নিয়ে মিষ্টি বিলিয়েছেন আদালত চত্বরে। এটাও ওই অন্ধকারে ঢি ছোঁড়ার মতোই। সংসদের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় বি এনপির উল্লাসিত হওয়ার হেতু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যে সব বিজ্ঞ আইনজীবী বিচার বিভাগের ক্ষমতা সংরক্ষণ করার জন্য সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে অভিমত দিয়েছেন, তারা বি এন পিকে মিষ্টি বিতরণের জন্য অভিমতটি দেনটি; দিয়েছেন বিচার বিভাগের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রাখার স্বার্থে। বি এন পি ক্ষমতায় যেতে পারলে এই রায় তাদেরও মানতে হবে। ব্যাপারটা মিষ্টি বিতরণের কোনো ব্যাপার ছিলো না।
সম্প্রতি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে সুইচ ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা জমেছে রেকর্ড পরিমাণ। এটা দেশ থেকে টাকা পাচারের পর্যায় পড়ে। এ ব্যাপারেও বি এন পির নিত্য দিনের ভাষ্যকার রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের লোকজনেরই টাকা জমেছে সুইচ ব্যাংকে।’ রিজভী নামধাম কিছুই বলেন নি-সরকারি দলের কারা কত টাকা সুইচ ব্যাংকে পাচার করেছেন। বলেছেন অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। এটা ওই অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়াই। আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের কথাটা মনে হয় মিথ্যে নয়। তিনি বলেছেন, ‘বি এন পির রাজনীতি মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ সুইচ ব্যাংকের টাকা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক কথা বলেছেন। এ অর্থ পাচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংব সুইজারল্যান্ডের ব্যাংককে বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছে। সেটা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সুইচ ব্যাংক উত্তর দেয় নি। বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও সুইজার ল্যান্ডের ব্যাংককে চিঠি দেয়ার উদ্যোগে গ্রহণ করেছে। যারাই অর্থ পাচার করেছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যেই হোক।’
অন্যায়কে জেনেশুনে প্রশ্রয় দেবার বান্দা শেখ হাসিনার নন, এর অনেক প্রমাণ আছে। হ্যাকিং করে আন্তর্জাতিক জালিয়াতরা বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছিলো, এ ব্যাপারেও বিএনপি সরকারকে দোষারোপ করেছিলো অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে। কোনো প্রমাণ দিয়ে কথা বলেননি বিএনপির নেতারা। রিজার্ভের টাকার একটা অংশ উদ্ধার করেছে সরকার।
এব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন ড. আতিউর রহমান। কোনো ইগোর পরিচয় দেননি এ ব্যাপারে। পদ্মা সেতুতে নাকি দুর্নীতি হয়েছিলো, বলেছিলেন বিশ^ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এটি ছিলো বিএনপির লবিষ্টদের শেখানো কথা। অনেক বড় গলায় চিৎকার পেড়েছিলেন বিএনপির নেতারা। শেখ হাসিনাকে এই সুযোগে বদনাম দিয়ে কাৎ করে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন তারা। সেটাও ছিলো অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া। যেহেতু বির্তক উঠেছে সে জন্য প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রীত্ব থেকে সরিয়ে দেন। দীর্ঘদিন বিএনপির লোকজন সৈয়দ আবুল হোসেনর মতো একজন গুণী মানুষকে ‘আবুল’ বলে উপহাস করেছেন। অথচ শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আদালত রায় দিয়েছে, পদ্মাসেতুতে কোনো দুর্নীতি হয় নি।
এবার আসি কবি, কলাম লেখক ফলহাদ মজহারের কথায়। বি এন পির নিত্যদিনের ভাষ্যকার রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, ‘কোরবানীর ঈদের জন্য নাটক-সিনেমা তৈরি করছে সরকার। যার পরিচালক ও প্রযোজক সরকার নিজেই। ফরহাদ মজহারকে অপরহরণ করার পর যখন দেখেছে দেশের মানুষ জেগে উঠেছে তখনই আবার ছেড়ে দিয়েছে।’ (জনকন্ঠ-৫/৭/১৭)। রিজভীর কথায় হাসবো না কাঁদবো তাই ভাবছি। স্বয়ং ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘আমাকে কারা অপহরণ করেছে তাদের আমি চিনতে পারিনি। তবে তাদের কথাবার্তায় বুঝতে পারি এ সরকারকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে হেয় করতে চায় এমন একটি গোষ্ঠী আমাকে অপরহণ করেছিলো।’ (জনকণ্ঠ-৫/৭/১৭)।
আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘এটি বালখিল্য ছাড়া কিছু নয়। কোনো কিছু ঘটার পর পরই সরকারকে অভিযুক্ত করা বিএনপির পুরোনো অভ্যাস। এটার তদন্ত হচ্ছে। ঘটনাটি রহস্যজনক। তদন্তকালীন আমরা কিছু বলতে চাই না। তদন্তের মাধ্যমেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।’(ঐ)।
আসল ঘটনা বেরিয়ে আসুক আমরা তা চাই। এ ব্যাপারেও রিজভী সাহেব অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছেন। ফরহাদ মজহারকে সরকারের অপহরণ করার প্রয়োজন পড়েছে, এদেশের মানুষ তা মনে করে না।’ প্রকাশ্য দিবালোকেই সরকার তার প্রয়োজনে সাংবাদিক শফিক রেহমানকে আটক করেছিলো, কিছুদিন পর আবার ছেড়েও দিয়েছে। ফরহাদ মজহারের বেলায়ও তাই হতে পারতো। কিন্তু তার বেলায় ঘটলো রহস্যজনক ঘটনা। ফরহাদ মজহারের চেয়েও অনেক বড় লেখক বদরুদ্দীন উমর। তিনি আজীবন আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচক। শেখ হসিনার সরকার বদরুদ্দীন উমরের লেখা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর ফরহাদ মজহারকে অপরহণ করার প্রয়োজন পড়লে? জনগণের মধ্যে ফরহাদ মজহারের এমন কোনো প্রভাব নেই যে, জনগণ তার জন্য গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দিয়েছে। ফরহাদ মজহার হচ্ছেন দিকভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট, লক্ষ্যভ্রষ্ট লেখক। একজন কলাম লেখক তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘কুমড়া পঁচে গেলে আর্বজনা হয় আর জাসদ পঁচে গেলে ইনকিলাবি হয়।’ বাম থেকে ডানে যাওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে আছে। পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে মুরগি সাপ্লাই দেয়া বামপন্থীও এদেশে আছে। তারা কেউ কেউ পাকিস্তানের পেটের মধ্যে ঢুকে গেছেন।
মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক, গবেষক।
< Prev | Next > |
---|