continentalস্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ রেলওয়ের পণ্য পরিবহন না বেড়ে বরং কমছে। অথচ রেলের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছর যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত রেল পরিবহন সংস্থাটির পরিচালন ব্যয় ৪২১ কোটি বেড়েছে, সেখানে সংস্থাটির পণ্য পরিবহন কমেছে ৬৮ হাজার টন। মূলত রেলের তুলনায় সড়কপথে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাদারিত্বের অভাব, অনিয়ম-দুর্নীতি, জনবল সংকটসহ বিভিন্ন কারণে কমছে রেলে পণ্য পরিবহন।

বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৪ লাখ ৮৬ হাজার ৫৪০ টন পণ্য পরিবহন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যদিও আগের অর্থবছর (২০১৪-১৫) পণ্য পরিবহনের পরিমাণ ছিল ২৫ লাখ ৫৫ হাজার টন। ওই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে রেলে পণ্য পরিবহন কমেছে ৬৮ হাজার ৪৬০ টন। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছর রেলওয়ের পরিচালন ব্যয় হয় ২ হাজার ২২৯ কোটি ২২ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছর (২০১৪-১৫) ছিল ১ হাজার ৮০৮ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রেলওয়ের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪২১ কোটি টাকা বা ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সড়কপথে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীরা বেশি আগ্রহী হওয়াই রেলপথে পণ্য পরিবহন কমে যাচ্ছে। কারণ ব্যবসায়ীরা সড়কপথে পণ্য নিজেদের পছন্দমতো স্থানে নিতে পারেন, কিন্তু রেলপথে তা সম্ভব নয়। পাশাপাশি পণ্য খালাসে সময়ক্ষেপণও রেলপথের প্রতি ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহী করে তুলছে। মূলত রেলের তুলনায় সড়কপথে ব্যবসায়ীরা দ্রুত পণ্য পরিবহন ও প্রয়োজনীয় গন্তব্যে পণ্য নিতে পারছে বলেই সড়কে তাদের আগ্রহ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে রেলে পণ্য পরিবহন হ্রাস ঠেকাতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সঠিক উদ্যোগ নেয়া জরুরি। রেলের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় গন্তব্যে পণ্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব নয়, তবে বিভিন্ন বন্দর থেকে বড় বড় শহরগুলোয় দ্রুত পরিবহনের ব্যবস্থা করে ব্যবসায়ীদের রেলপথে পণ্য পরিবহনে আকৃষ্ট করা সম্ভব। পাশাপাশি পণ্য পরিবহন বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও নিতে হবে।

সূত্র জানায়, বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলে সবচেয়ে বেশি পরিবহন করা হয়েছে জ্বালানি তেল, যা মোট পণ্যের ৩৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ওই বাবদ রেলের আয় হয়েছে ৫৬ কোটি ১৪ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। তেলের পর রেলপথে সবচেয়ে বেশি পরিবহন হয়েছে মার্বেল ও পাথর, যা মোট পরিবহন করা পণ্যের ২৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর তা থেকে রেলের আয় হয়েছে ২৬ কোটি ৬৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা। তাছাড়া ওই অর্থবছরে রেলে মোট পণ্য পরিবহনের ২৪ দশমিক ২৪ শতাংশই ছিল কনটেইনার। সেখান থেকে ৭৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকা আয় করেছে রেলওয়ে, যা সংস্থাটির মোট আয়ের ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বাকি ১৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ পরিবহন হয়েছে সার, গম/খাদ্যশস্য, চিনি ও রেলের বিভিন্ন সরঞ্জাম। সবমিলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পণ্য পরিবহন বাবদ রেলওয়ের মোট আয় ছিল ১৭৬ কোটি ৬৮ লাখ ১০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে ২০১৫-১৬ অর্থবছর বিবিধ খাতে রেলওয়ের পরিচালন ব্যয় সবচেয়ে বেড়েছে। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ওই অর্থবছর ১৫৭ কোটি ৪৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা বাড়িয়ে খাতটিতে মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪৯৩ কোটি ১৬ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। তাছাড়া মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ১২৪ কোটি ১৩ লাখ, সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ৭৯ কোটি ১০ লাখ, বেতন বাবদ ৩২ কোটি ৬৩ লাখ এবং কর্মী ও জ্বালানিবহির্ভূত পরিচালন ব্যয় বেড়েছে ২৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। সবচেয়ে কম ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে জ্বালানি তেল খাতে। ওই খাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছর বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালন ব্যয় আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বেড়ে ৩৬১ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, বিগত ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে রেলে প্রায় ৩৪ ধরনের পণ্য পরিবহন হতো, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এসে মাত্র ১০টিতে ঠেকেছে। মূলত স্বাধীনতার পর থেকেই খাতটি অবহেলার শিকার। যার বোঝা এখন টানতে হচ্ছে। তবে শিগগিরই রেলের অবস্থা পাল্টে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। কারণ পৃথক মন্ত্রণালয় হওয়ার পর থেকেই রেলে বিনিয়োগ বাড়ছে। গত ৭ বছরে রেলের উন্নয়নে ৭৬ হাজার ২৯৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬৩টি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও ৭টি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পসহ মোট ৫৩টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান ছিল। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে বেশক’টি রুটে রেলের গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় কমে আসবে। তখন বাড়বে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। যদিও রেলওয়েতে পরিকল্পনা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাদারিত্বের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। রেলওয়েকে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বলা হলেও সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে পেশাদারিত্বের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অথজ রেলের উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের প্রথমে চিন্তা করা জরুরি, জনগণকে ঠিক কী ধরনের সেবা দেয়া যায়। একই সাথে তা লাভজনক হবে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। সেক্ষেত্রে রেলে দক্ষ জনবলের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখা ও রেলসেবার মান উন্নয়নে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সেগুলো না করলে যত বিনিয়োগই করা হোক না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না।

এদিকে রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইঞ্জিন স্বল্পতাও রেলপথে পণ্য পরিবহন কমার জন্য দায়ি। বর্তমানে যেসব ইঞ্জিন চালানো হচ্ছে, সেগুলো প্রায় ৬০ বছরের পুরনো। ওসবের আয়ুষ্কাল ২০-২৫ বছর আগেই শেষ হয়েছে। তাছাড়া অর্ডার অনুযায়ী পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা সম্ভব না হওয়াও তার জন্য দায়ী।

অন্যদিকে রেলে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন জানান, স্বাধীনতার পর নানাভাবে রেলকে বঞ্চিত করা হয়েছে। একের পর এক স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জনবল ছাঁটাই করা হয়েছে। কমেছে মাল ও যাত্রীবাহী কোচের সংখ্যাও। এ অবস্থায় নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রেলসেবার মান একদিনেই বাড়ানো সম্ভব নয়। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। বাংলাদেশ রেলওয়ে সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে।

সাম্প্রতিক