আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
সাধারণভাবে এ দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের বাড়িতে প্রতিদিন বা প্রায়ই মশার প্রবেশ নিরোধে ওষুধ স্প্রে করে থাকেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতাও আছে বাড়ির ভেতরে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে। সরকারি কর্তৃপক্ষ একটু এগিয়ে এসে হাত বাড়ালে মানুষ আরও সচেতন ও সাবধান হতে পারতেন। অন্যের সহযোগিতা নিজের মধ্যে বিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে।
বাংলাদেশ যে খুব পরিচ্ছন্ন একটা দেশ নয়, তার পরিচয় পাওয়া যায় ভাষাবিজ্ঞানী নোআম চমস্কির বাক্যের ডিপ স্ট্রাকচার আর সারফেস স্ট্রাকচারের মতো চারদিকে পর্যবেক্ষণ দৃষ্টিপাত করলেই। চমস্কি বাক্য বিচারে তার গভীরতল আর বাইরের তলের প্রসঙ্গে যে কথা বলেছেন বাংলাদেশের ভেতর ও বাইরের দু'অবস্থার কথাই এখানে উত্থাপনযোগ্য হলেও এখানে বাইরের অবস্থার দিকেই নজর দিলেই যে চিত্র প্রকাশিত হবে, তা কোনো ক্রমেই আন্দদায়ক নয়।
বর্তমান প্রসঙ্গ মানবদেহে প্রচ- প্রদাহ সৃষ্টিকারী চিকুনগুনিয়া সম্পর্কিত। এই ভয়াবহ ব্যাধির প্রকোপ এর আগে বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়নি। এর আগে কলেরা ও ম্যালেরিয়া একসময় বাংলাদেশের অনেক গ্রামের অস্তিত্ব শেষ করে দিয়েছিল। কলেরার কোনো ওষুধ ছিল না। ম্যালেরিয়া সম্পর্কেও প্রায় সমশ্রেণির উক্তি করা যায়। মশার কামড়েই এই ম্যালেরিয়ার উৎপত্তি। পরবর্তীকালে ডেঙ্গু জ¦রের কথাও এদেশের মানুষ বিস্মৃত হননি; কিন্তু এসব একশ-দুইশ বছর আগের কথা। প্লেগও এমন ব্যাধি ছিল, যা থেকে অব্যাহতি পাওয়া ছিল কঠিন। এসব ব্যাধিকে অপসারণ করে একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে অর্থাৎ দু'হাজার সতেরো সালে মাথায় মুকুট পরে এলো রাজাধিরাজ চিকুনগুনিয়া।
চিকুনগুনিয়া রাজার মতো ঘরে ঘরে প্রবেশ করে প্রজাদের শাস্তি দিতে শুরু করল। তার আবার পছন্দ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, অন্যশহর বা গ্রাম-গঞ্জ নয়। তাহলে কী মনে করতে হবে যে, ঢাকার চেয়ে এদেশের অন্যান্য শহর ও গ্রাম অনেক পরিচ্ছন্ন। চিকুনগুনিয়া সৃষ্টিকারী মশা উপর্যুক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করার কোনো সুযোগ পায়নি।
ঢাকার অসংখ্যা মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছেন। সারাদেহে প্রচ- ব্যথা আর জ¦র। ব্যথা নিবারণের কোনো ওষুধ নেই, একমাত্র গা টিপে খানিকটা স্বস্তি দেয়া ছাড়া। অন্যদিকে, যারা রোগীদের সেবা করতে অগ্রসর হয়েছেন, তারাও এ জ¦রে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু দেহে ব্যথা আর জ¦র নয়, মুখে রুচি নেই বলে খিদে নেই। যে বাড়িতে চিকুনগুনিয়া একবার প্রবেশ করেছে সেখানে কাউকে অব্যাহতি দেয়নি। সাতদিন থেকে ১০দিন বিছানায় শুয়ে কাটাতে হয়েছে। সবচেয়ে অসুবিধার দিক হলো এরোগ প্রতিরোধের জন্য কোনো ওষুধ নেই। চিকিৎসকরা রোগীদের ওষুধ দিয়েছেন জ¦র সারানোর জন্য নাপা বা এ জাতীয় ট্যাবলেট; কিন্তু এই ট্যাবলেটে জ¦রের প্রকোপ যে কমেছে, তা নয়। জ¦র ও ব্যথা সাতদিন পর সেরে গেছে। কানাডায় গাছের মুকুল ঝরার সময় হে ফিভারে অনেকে আক্রান্ত হন। ফার্মেসিতে ওষুধের কথা বললে দোকানের কর্মচারী একটা সেলফে রাখা ওষুধের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, এখান থেকে যে কোনো একটা ওষুধ নিতে পারেন। তবে, আপনি ওষুধ খান আর না খান, সাত দিনের আগে জ¦র সারবে না। চিকুনগুনিয়ার জ¦রও খানিকটা সমপ্রকৃতির। প্রচ- গা গরম আর নাপা খেলে বা না খেলেও সাত দিনের আগে জ¦র ছাড়বে না। ভাইরাল ডিজিজের এটাই রোধহয় বৈশিষ্ট্য।
চিকুনগুনিয়া মানুষকে কী অবস্থায় ফেলে দেয় তা ডাক্তারের কাছে গেলেই বোঝা যায়। লাইন দিয়ে রোগী দাঁড়িয়ে আছেন। অনেক মায়ের কোলে দুগ্ধপোষ্য বাচ্চা সেও একই ব্যাধিতে আক্রান্ত। বেশিরভাগ রোগীর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। হাত দিয়ে ধরে ওঠাতে হয়। অনেকেই পায়ের হাঁটুর ব্যথা কমানোর জন্য জ¦র ছাড়ার পর ফিজিওথেরাপি নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক মহিলার গায়ের চামড়াও উঠেছে। সবদিক থেকেই এই রোগ কোনো অংশেই ম্যালেরিয়া, কলেরার চেয়ে কম যন্ত্রণাদায়ক নয়।
চিকুনগুনিয়া কেন এত মারাত্মক আকারে ঢাকার মানুষকে আক্রমণ করার সুযোগ পেয়েছে। প্রায় সবারই ধারণা ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে মশকবিরোধী কোনো ওষুধ ড্রেন বা অন্যান্য স্থানে দেওয়া হয়নি। নগরকে পরিচ্ছন্ন ও মশকমুক্ত রাখার জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবার মশা না জন্মানোর জন্য ওষুধ স্প্রে করলে এমন মহামারী রূপে চিকুনগুনিয়া দেখা দিত না। ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকা করপোরেশনের মেয়রদের যে দায়িত্ব তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় না। নগর পরিচ্ছন্ন রাখার প্রয়োজনে কিছুদিন আগে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তার ওপর সুদৃশ্য স্ট্যান্ডে বালতি ঝুলিলে রাখা হয়। দুঃখের বিষয় এই বালতি আবর্জনায় ভর্তি হওয়ার পরও পরিষ্কার করতে কখনো দেখা যায়নি। বালতিতে আবর্জনার ওপর বৃষ্টির পানি পড়ে তা আরো অপরিচ্ছন্ন করে তুলেছে। রাস্তা-ঘাটের গর্তেও পানি জমে মশার বসবাসের সুবিধা করে দেয়। তার ওপর ঢাকার প্রতিটি কাঁচা বাজার যেভাবে অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে তাতে মশার ডিমপাড়া আর অবস্থানের নিরাপদ সুযোগ করে দেয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একসময় ছিল যখন প্রতি সপ্তাহে ভেষজ প্রতি বাড়ির নর্দমায় মশার ওষুধ ছিটিয়ে দিত। তাকে কোনো কিছু বলতে হতো না, নিজেই নিজের কাজ শেষ করে বাড়ি থেকে চলে যেত। অতীতের সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। শোনা যায় করপোরেশনে মশার ওষুধ চুরি করে সেখানে অর্ধেক পানি মেশানো হয়।
ঢাকা শহরবাসীর কাছে একটি দিক চিকুনগুনিয়া প্রবাহের মতো ছড়িয়ে পড়ার সময় আঘাত করেছে। ঢাকার প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য সিটি করপোরেশনকে ভেঙে উত্তর দক্ষিণ এই দু'ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। কিন্তু রাজধানীর লোকের এই বিভাজন কোনো সুবিধা বা সেবা ভালোভাবে পেয়েছেন বলে মনে করার উপায় নেই। চিকুনগুনিয়া বৃষ্টির মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা দুই পরপোরেশনের মেয়র সোচ্চার হয়ে এই রোগ দমনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেননি। অন্তত এই সময়ে প্রত্যেক এলাকায় মশার ওষুধ ছিটালে মানুষ মনে শান্তি বা স্বস্তি পেতেন। তাছাড়া, চিকুনগুনিয়া সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্য মানুষকে ঘন ঘন উপদেশ দেওয়া যেত চিভি চ্যানেলের মাধ্যমে। এদেশের মানুষ যেভাবে টিভি দেখেন, তাতে রোগ সম্পর্কে তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হতো।
সাধারণভাবে এ দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের বাড়িতে প্রতিদিন বা প্রায়ই মশার প্রবেশ নিরোধে ওষুধ স্প্রে করে থাকেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতাও আছে বাড়ির ভেতরে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে। সরকারি কর্তৃপক্ষ একটু এগিয়ে এসে হাত বাড়ালে মানুষ আরও সচেতন ও সাবধান হতে পারতেন। অন্যের সহযোগিতা নিজের মধ্যে বিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে।
চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ ব্যাপক হারে ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লেও দেশের কোনো অংশ থেকে এই ব্যাধির সংক্রামণ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে, অপ্রত্যক্ষভাবে চিকুনগুনিয়া অত্যন্ত নিম্ন হারে ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা গেছে ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের জন্য। যেসব মানুষ ঈদের ছুটির সময় ঢাকা ছেড়ে নিজেদের অঞ্চলে উৎসব করতে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই রোগ বহন করে নিয়ে যাওয়ায় নিজেদের বাড়ির দু'একজন আক্রান্ত হয়েছেন। তবে, ওই আক্রান্ত রোগির সংখ্যা তেমন ব্যাপক নয়। এ কারণে, ঢাকার বাইরের মানুষ চিকুনগুনিয়া থেকে খানিকটা স্বস্তিতে আছেন।
ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বর্তমানে অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। সে জন্য মানুষ খানিকটা স্বস্তিতে আছেন। তাছাড়া, চিকুনগুনিয়ায় একবার আক্রান্ত হলে আবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বেল মানুষের মনোবল খানিকটা বৃদ্ধি করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষের বিপদ যে সম্পূর্ণ কেটেছে বলে মনে করার কারণ নাও থাকতে পারে। কারণ, এখনো বর্ষাকাল শেষ হয়নি। আষাঢ় শেষ হওয়ার পথে থাকলেও এখনো শ্রাবণ আসেনি। এইসঙ্গে দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে বন্যার শুরু হয়েছে। বন্যার পানি নামার পর এলাকা খানিকটা দুষিত হয়ে পড়ে। সে জন্য এই সময়ে রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার মানুষের ও স্বাস্থ্য দফতরের। চিকুনগুনিয়া বিদায় নেবার পর মানুষের আর এক মশক শত্রু তাকিয়ে থাকতে পারে ডেঙ্গু ছড়ানোর প্রত্যাশায়। সে জন্যে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কর্পোরেশনের বিশেষ ভূমিকার প্রয়োজন। তখন সময় আসবে প্রতিটি অঞ্চলে মশার ওষুধ ছিটানো এবং পানিযুক্ত তরল পদার্থ নয়, খাঁটি তরল পদার্থ, যা মশাবধে সহায়তা করতে সক্ষম।
ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
< Prev | Next > |
---|