স্টাফ রিপোর্টার: উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ৪৫ উপজেলায় কয়েক লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি। বাড়ি-ঘর ডুবে যাওয়ায় অনেকে নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছেন। পানি ওঠায় বন্ধ রাখা হয়েছে কয়েকশ বিদ্যালয়। এর মধ্যে আরও কয়েকদিন ভারি বর্ষণের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর; ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে।সিলেট, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ জেলা বর্তমানে বন্যা কবলিত। উত্তরের পানি মধ্যাঞ্চলে নেমে এলে আরও নতুন জেলা প্লাবিত হতে পারে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের নয়টি নদীর পানি ১৭টি পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছিল। এসব নদীর মোট ৫৫টি পয়েন্টে পানি বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত ছিল। প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ-
জামালপুর: জেলার সব নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার রায় জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইসহ জেলার সব নদীর পানি বেড়েছে। গতকাল বুধবার সকালে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই পয়েন্টে গত মঙ্গলবার যমুনার পানি ছিল বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপরে। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১৬ সেন্টিমিটার। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও সদরের আরো ১৫টি ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। সব মিলিয়ে জেলার ছয়টি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নের দেড় লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ১৩৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। টানা বন্যায় পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। দুর্গত অনেক মানুষের ঘরে খাবার নেই। তার ওপর গবাদিপশুর খাবার জোটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত কয়েক দিনে ৯০ টন চাল, তিন হাজার ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার ও দেড় লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তবে এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল বলে অভিযোগ দুর্গতদের। এদিকে, বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিতে শুরু করেছে পানিবাহিত নানা রোগ। জামালপুরের সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, বন্যাকবলিত এলাকায় ৭৭টি মেডিকেল টিম কাজ শুরু করেছে।
গাইবান্ধা: এ অঞ্চলে বাড়ছে যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের পানি। যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদীর পানি ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে জেলার চারটি উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পানির চাপে হুমকির মুখে পড়েছে গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধ ও সাঘাটা সড়ক। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ এখন দুর্ভোগে রয়েছে। নলকূপ ডুবে যাওয়ায় অনেক দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে চুলা জ¦ালাতে না পেরে অনেক পরিবার খাওয়া নিয়ে সংকটে পড়েছে। অধিকাংশ এলাকায় ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগও শোনা গেছে। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, পানির কারণে পায়খানা-নলকূপসহ সব কিছু ডুবে গেছে। বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না তাঁরা। হাঁস-মুরগি মাচায় তুলে রাখা হয়েছে।
ফুলছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল গফুর, ফজলুপুরের ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীন, উড়িয়ার ইউপি চেয়ারম্যান মাহতাব উদ্দীন ও এরে-াবাড়ির ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান জানান, তাদের উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নই পানিয়ে তলিয়ে গেছে। উপজেলার মোট ৬৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহাবুবুর রহমান বলেন, একটা পয়েন্টে একটু সমস্যা ছিল, সেটা আমরা এরইমধ্যে মাটি এবং জিও ব্যাগ দিয়ে সমাধান করেছি। এখানে সড়ক বিভাগ আমাদের সহযোগিতা করেছে। এখন পানি আর সেখানে ওভার-ফ্লো করছে না। মাহাবুবুর রহমান বলেন, আমাদের বর্তমানে খুব দুর্বল একটি পয়েন্ট হাট ভরতখালির হাইস্কুলের কাছে। সেই স্কুলের কাছে সড়কটা একুট নিচু, সেখানে কীভাবে প্রটেকশন দেওয়া যায় সেটা আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। এ ছাড়া আরো সড়কের বিভিন্ন দুর্বল এলাকা চিহ্নিত করে সেগুলোকে স্থায়ীভাবে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং তিস্তা নদীতে ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের অধিকাংশ গেট খুলে দেওয়ায় সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি বেড়েই চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ১৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ এলাকায় বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয়ের ডাটা এন্টি অপারেটর আবুল কালাম আজাদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ছাড়াও কাজীপুর, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে সিরাজগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। যমুনার করাল গ্রাসে অনেকে বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। যমুনার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগও বাড়ছে। পানিবন্দি মানুষ অসহায় জীবনযাপন করছেন। বন্যাকবলিতদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের সংকট। বন্যাকবলিত এলাকায় সরকার থেকে যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। যমুনা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে।
গত সাত দিনে কাজীপুর, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যাকবলিত মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে বিভিন্ন বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলার মিল্ক ভিটার খামারিরা গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। সিরাজগঞ্জ ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়নের ১৯৪টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৪ হাজার ৮১৬ পরিবার ও ৬১ হাজার ১৮৬ জন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের মধ্যে ৮৪ টন চাল ও তিন লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। শাহজাদপুর কৈজুরী ইউপির হাটপাচিল গ্রামের বুলবুলি বেগম, সোলেমান ও সাইদুল বলেন, সকালে বসতবাড়ি ঠিকই ছিল। কিন্তু রাতে যমুনার ভাঙনে অধিকাংশ চলে যায়। ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে ছেলেমেয়েকে নিয়ে যা পেরেছি, তা সরিয়ে নিয়েছি।
একই গ্রামের জলিল ও হানিফ বলেন, নদীতীরে বসতভিটা যেভাবে ভাঙছে, কখন যে সবকিছু নদী গ্রাস করে নেয়, এমন আতঙ্কে সব সময় থাকতে হচ্ছে। ইউপি সদস্য আবদুল লতিফ জানান, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে পাঁচ শতাধিক বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, পাউবো খোঁজ নিতেও আসেনি।
শাহজাদপুরের কৈজুরী ইউপি চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম জানান, ভাঙনের বিষয়টি পাউবো ও জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু তারা শুধু আশ্বাসই দিয়েছে। কাজের কাজ কিছুই করছে না। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুর রহিম জানান, বন্যাকবলিত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ মজুদ রয়েছে। এরইমধ্যে বন্যাকবলিত পরিবারের মাঝে ৮৪ টন চাল ও তিন লাখ ৩৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি বাড়ায় জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। এজন্য পাউবো সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দিকা জানান, বন্যাকবলিতদের মধ্যে এরইমধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বন্যাকবলিত পাঁচটি উপজেলায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি চিড়া, এক কেজি লবণ, এক কেজি চিনি, ডাল, দিয়াশলাই, মোমবাতি, মুড়িসহ দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপজেলাওয়ারি দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সার্বক্ষণিক বন্যা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছেন। বন্যায় যাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয় এবং বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।
< Prev | Next > |
---|