স্টাফ রিপোর্টার: দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের নদ-নদীর পানি অতিভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বাড়তেই আছে। পানি বৃদ্ধির কারণে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা এবং হবিগঞ্জ-সিলেট এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। ১৭টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৮১ পয়েন্টে। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, আগামি দুই-তিন দিনে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, আজ রোববার থেকে পানি বৃদ্ধির ধারা আগামি ১৬ আগস্ট (বুধবার) পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সর্বশেষ শনিবার সকাল ৯টায় আগের ২৪ ঘণ্টার তথ্য দিয়ে বলছে, ৯০টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি স্টেশনের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে ৮১টির। হ্রাস পেয়েছে ৬টি। বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ১৭টি কেন্দ্রে। ১০০ মি.লি. এর উপরে বৃষ্টিপাত হচ্ছে ১৬টি স্টেশনে। আর ৫০ মি.লি. এর উপরে হয়েছে ৩৮টি কেন্দ্রে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, গত ২৪ ঘণ্টা থেকে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামি ১৫-১৬ আগস্ট পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে। পানি বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন জেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। উত্তরাঞ্চলসহ উজানে অতিভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান সাজ্জাদ হোসেন।
ব্রক্ষ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং সুরমা-কুশিয়ারা নমীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানায় বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র। এ ছাড়া ব্রক্ষ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি আগামি ৭২ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। আর সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি আগামি ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। সকাল ৯টার তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি ২৪ ঘণ্টায় ৭৭ সে.মি., ডালিয়ায় তিস্তা নদীর পানি ২৯ সে.মি., যমুনেশ্বরীর পানি বদরগঞ্জে ১৩২ সে.মি., যমুনায় বাহাদুরবাদঘাটে ৬৩ সে. মি., সিরাজগঞ্জে ৪৭ সে. মি. বৃদ্ধি পেয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে টাঙ্গন নদীর পানি ২৬১ সে. মি., সুরমা নদীর পানি কানাইঘাটে ৫১ সে. মি., সুনাসমগঞ্জে ২৩ সে. মি., কুশিয়ারার পানি শেওলায় ১২ সে. মি., সারিঘাটে সারিগোয়াইন নদীর পানি ৮৪ সে. মি. উপর দেয় প্রবাহিত হচ্ছে। মনু রেলওয়ে ব্রিজে মনু নদীর পানি ৩৬৮ সে. মি., খোয়াই নদীর পানি বাল্লা পয়েন্টে ২২১ সে. মি., হবিগঞ্জে ৪৭০ সে. মি., ধলাই নদীল পানি কমলগঞ্জে ২৭৮ সে. মি., নাকুগাঁওয়ে ভুগাই নদীরি পানি ৩২০ সে. মি., সোমেশ্বরী নদীল পানি দুর্গাপুরে ১০০ সেমি এবং কংস নদীর পানি ১০৫ সে. মি. বৃদ্ধি পেয়েছে। কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৩২ মি.লি., ডালিয়ায় তিস্তা নদীর পানি ২৫ মি. লি., বদরগঞ্জে যমুনেশ্বরী নদীর পানি ৬ মি. লি., বাহাদুরবাদে যমুনা নদীর পানি ৪ সে. মি., সিরাজগঞ্জে ১০ সে. মি., ঠাকুরগাঁওয়ে টাঙ্গন নদীর পানি ৬৫ সে. মি., কানাইঘাটে সুরমা নদীর পানি ৭৮ সে. মি., সুনামগঞ্জে ৭০ সে. মি., শেওলায় কুশিয়ারা নদীর পানি ১২ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সারিঘাটে সারিগোয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ৪৯ সে. মি., মনু রেলওয়ে ব্রিজে মনু নদীর পানি বিপদসীমার ৭ মি. লি., খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ১৩৫ সে. মি., হবিগঞ্জে ১৯৫ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়া কমলগঞ্জে ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ১৩ সে. মি., নাকুয়াগাঁওয়ে ভুগাই নদীর পানি বিপদসীমার ২৩৬ সে. মি., দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ৩৫ সে. মি. এবং জারিয়াজঞ্জাইলে কংষ নদীর পানি বিপদসীমার ১০৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ জানান, সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪-৮৮ মিমি) থেকে অতি ভারী (৮৯ মিমি বা অধিক) বর্ষণ হতে। আর ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধ্বসের সম্ভাবনা রয়েছে। সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমী বায়ুর বর্ধিতাংশের অক্ষ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। আগামী তিন দিনে (৭২ ঘণ্টা) বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধির পাঠানো খবর:
নীলফামারী: ভারি বর্ষণের ফলে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের দিনাজপুর প্রধান সেচ ক্যানেলের ডানতীর বাঁধের দুইটি স্থানে ১০০ ফুট বিধ্বস্ত হয়েছে। গতকাল শনিবার সকালে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার দুন্দিবাড়ি-স্লুইচ গেটের অদুরে কাঠাঁলী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এতে ওই সব এলাকার কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। নীলফামারী পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বে থাকা ডালিয়া পানি উন্নয়নের বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজার রহমান জানান, চারদিনের টানা ভারি বর্ষণের ফলে পানির চাপে দিনাজপুর সেচ ক্যানেলের জলঢাকায় দুইটি স্থানের ডানতীর বাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছে। বৃষ্টি থাকায় এই মুহুর্তে বিধ্বস্ত স্থান দুইটি মেরামত করা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে দুন্দিবাড়ি স্লুইচ গেট বন্ধ করে দেওয়ায় নতুন করে ওই ক্যানেলে পানি প্রবেশ করতে পারছেনা। এতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। চারদিনের অবিরাম বর্ষণের কারণে নীলফামারী জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় রাস্তাঘাট, বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করছে। এ ছাড়া জেলার প্রতিটি ছোটবড় লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে।
কুড়িগ্রাম: টানা বর্ষণ আর উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, তিস্তাসহ সবক’টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আবারো বন্যা শুরু হয়েছে। ২৫ দিনের ব্যবধানে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এর অববাহিকার নিম্নাঞ্চলগুলো দ্বিতীয় দফায় বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। গতকাল শনিবার সকাল ৬টায় ধরলার পানি ১২ ঘণ্টায় ৩৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য নদ-নদীর পানিও বাড়ছে সমান তালে। গত পাঁচ দিন ধরে অবিরাম বর্ষণে দুর্ভোগ বেড়েছে নদ-নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চলের মানুষজনের। তার ওপর ধরলা অববাহিকায় বন্যা দেখা দেয়ায় নতুন করে দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। ধরলা অববাহিকায় হঠাৎ করেই বন্যা দেখা দেয়ায় নিম্নাঞ্চলের অনেক পরিবারের ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। প্লাবিত এলাকাগুলোর কাঁচা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় নৌকা ও কলাগাছের ভেলায় প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হচ্ছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম জানান, গত ১২ ঘণ্টায় ধরলা নদীর সেতু পয়েন্টে পানি ৩৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ সময়ে ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার, তিস্তায় কাউনিয়া পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
হবিগঞ্জ: টানা বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল এবং ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে হবিগঞ্জের খোয়ই নদীর পানি দ্রুত গতিতে বেড়েই চলেছে। গতকাল শনিবার দুপুরে খোয়াই নদীর পানি ১১.৪০ মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপদসীমার ২০০ সেন্টিমিটার উপরে। হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী এমএল সৈকত জানান, বর্তমান পানি বাড়ার গতি স্থির রয়েছে। এদিকে গত শুক্রবার রাতে হবিগঞ্জের নবাগত জেলা প্রশাসক মনীষ চাকমা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. সফিউল আলম, এডিসি জেনারেল এমরান হোসেন ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম আজাহারুল ইসলাম খোয়াই নদীর তেতৈয়া বাঁধ পরিদর্শন করেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মনীষ চাকমা জানান, খোয়াই নদীর পানি দ্রুত গতিতে বাড়ছে। বাঁধ পরিদর্শন করে দুর্বল স্থান মেরামতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও: কয়েকদিনের টানা বর্ষণে ঠাকুরগাঁওয়ের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে রাস্তা-ঘাট ও রেললাইন ডুবে গেছে। ফলে ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে রেল রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।এদিকে, বানভাসি লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ পযর্ন্ত ১৫৩ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে ১৫০ হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে শহরের নিশ্চিন্তপুর, ডিসিবস্তি, হঠাৎবস্তি, কলেজপাড়া, রোড খালপাড়া, শান্তিনগর। বাড়িতে পানি ওঠায় এসব এলাকার মানুষ শহরের রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমি ও ঠাকুরগাঁও রোড যুব সংসদে আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে কয়েক শতাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে তাদের উদ্ধার কাজ চলছে। অপরদিকে, ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রেললাইনের নয়নবিরুজ এলাকায় ৫০২/১ থেকে ৫০৪/৫ এলাকা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার রেলপথ ডুবে যাওয়ায় ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঠাকুরগাঁও রেল স্টেশন মাস্টার মনসুর আলী জানান, রেলপথ ডুবে যাওয়ায় দ্রুতযান শাটল সকাল ৭.৫৫ মিনিটে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে এবং কাঞ্চন এক্সপ্রেস সকাল ১০.৩০ মিনিটে পঞ্চগড় অভিমুখে ছেড়ে আসার কথা থাকলেও তা আসতে পারেনি।
সিরাজগঞ্জ: যমুনা নদীর পানি দ্বিতীয় দফায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার হার্ড পয়েন্টে পানির ২০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার পাঁচ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দ্বিতীয় দফায় পানি বৃদ্ধির কারণে নতুন করে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল মানুষের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নিচু এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে এবং যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য তাঁরা প্রস্তুত রয়েছেন। পাউবো কেন্দ্রীয়ভাবে জানিয়েছে, দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর পানি বাড়ছে।
নেত্রকোনা: কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে নেত্রকোনার তিনটি নদীতে পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তাহের জানান, গতকাল শনিবার বেলা দেড়টায় সোমেশ্বরী, কংস ও উব্ধাকালি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে রেকর্ড করা হয়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে নদ-নদীর পানি বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, নেত্রকোনায় পানি বাড়ছে হু-হু করে। গত তিন ঘণ্টায় পাহাড়ি সোমেশ্বরীর পানি বেড়েছে ১১০ সেন্টিমিটার। এখন বিপৎসীমার ১৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একইভাবে কংস নদে ৩০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং উব্ধাকালি নদীতে ১০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি যেভাবে বাড়ছে, অব্যাহত থাকলে এসব নদ-নদীর আশপাশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি জানান।
বাগেরহাট: মধুমতীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে; এক সপ্তাহে চিতলমারী উপজেলায় অনেক বাড়ি, জমি ও দোকানপাট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনরোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত ও হুমকিতে থাকা মানুষ। সরেজমিনে চিতলমারী উপজেলার শৈলদাহ গ্রামে গিয়ে অন্তত ২০টি বাড়ি, অনেক জমি ও বেশকিছু দোকানপাট নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার চিত্র পাওয়া গেছে। ওই গ্রামের এস এম শাহ আলম বলেন, মধুমতীর তীরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছিলাম। কদিনের প্রবল বর্ষণে ভাঙন তীব্র হয়েছে। আমি জীবন বাঁচাতে পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছি। তিন দিন আগে আমার বসতঘরটি নদীগর্ভে চলে গেছে। বসতঘর হারিয়ে সর্বহারা হয়ে গেছি। এখন পরিবার নিয়ে কোথায় যাব জানি না। ওই গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন, রবিউল ইসলাম ও রহমান শেখসহ অনেকে বলেছেন, প্রমত্তা মধুমতী বর্ষা এলেই অশান্ত হয়ে ওঠে। কয়েক বছর ধরে পানির চাপ বাড়ছে। এতে ভাঙন দিন দিন তীব্র হচ্ছে। জাহাঙ্গীর বলেন, ইতোমধ্যেই কয়েক কিলোমিটার এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। গত এক সপ্তাহে উপজেলার কলাতলা ইউনিয়নের শৈলদাহ গ্রামের অন্তত ২০টি বসতবাড়ি ও বেশ কিছু দোকানপাট নদীগর্ভে চলে গেছে। বাকপুর ও শৈলদাহ গ্রাম সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছেন রবিউল ইসলাম। তিন বলেন, প্রশাসন বালির বস্তা দিয়ে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করছে, কিন্তু তা কোনো কাজে আসছে না। এভাবে ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব না। ভাঙনরোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তারা। চিতলমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান শামীম বলেন, নদীভাঙনে অন্তত ২০টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছে। দোকানপাট হারিয়ে শৈলদাহ গ্রামের অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। নদীতীরের বেশ কটি গ্রাম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা ওই গ্রামগুলো রক্ষা করতে অবিলম্বে টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিতে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু সাঈদ বলেন, নদীভাঙনে ২০টি বসতবাড়ি ও দোকানপাট বিলীন হওয়ার পর স্থানীয়ভাবে তা রোধের চেষ্টা করতে জরুরিভাবে বালুর বস্তা দেওয়া হচ্ছে। ভাঙন প্রবল হওয়ায় নদীর পাশে থাকা পিরোজপুর-চিতলমারী সড়ক অধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খুশি মোহন সরকার বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনে নদ-নদীতে দিন দিন পানির চাপ বাড়ছে। এ কারণে ভাঙনও বাড়ছে। মধুমতী নদীর ভাঙনরোধে কোনো বরাদ্দ নেই। তবে জরুরি ভিত্তিতে কিছু কাজ করা হচ্ছে। ব্যবস্থা নিতে প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। সরকার ওই প্রকল্পে বরাদ্দ দিলে ভাঙনরোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সুনামগঞ্জ: টানা ভারি বর্ষণে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত হয়েছে। জেলার কয়েকটি এলাকায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যা মোকাবেলার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। গতকাল শনিবার বেলা ১২টায় ষোলঘর পয়েন্টে সুরমার পানি বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে হয় বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিদ্দিকুর রহমান ভূইয়া। জেলায় সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় গড় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১২৫ মিলিমিটার। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান জানান, বৃষ্টিপাতের কারণে জেলা শহরের সঙ্গে তাহিরপুর উপজেলার সড়ক যোগগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সড়কে পানি উঠে বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া উপজেলার কয়েকটি গ্রামে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তিনি বলেন, হাওরে ফসলডুবি, মাছের মড়ক, টানা কয়েকদফা ঘুর্ণিঝড় এবং সর্বশেষ পানিতে প্লাবিত হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বেড়েছে। তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল কর্মকর্তা মির্জা রিয়াদ হাসান বলেন, গত দুই দিন ধরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আশপাশে পানি প্রবেশ করায় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। তবে আমরা পানিবাহিত রোগের চিকিৎসার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি রেখেছি। জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। আমরা মাইকিংয়ের ব্যবস্থা নিয়েছি, যাতে মানুষজনকে দিক নির্দেশনা দেওয়া যায়। ইতিমধ্যে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ দিয়েছি। প্রতি উপজেলায় তিন মেট্রিক টন চাল এবং ১০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সকল উপজেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক করছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা শুকনো খাবার কিনে রেখেছেন।
লালমনিরহাট: ৫ দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল ৯টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে ৫২ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। যা স্বাভাবিকের (৫২ দশমিক ৪০) চেয়ে ২৫ সেন্টিমিটার উপরে। ব্যারাজের সবগুলো জলকপাট খুলে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। সেচ প্রকল্পের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র জানায়, কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত শুক্রবার দুপুরে পানি প্রবাহ বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করলে রাতে আরো বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করে। গতকাল শনিবার সকাল ৬টায় এ পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার। ৩ ঘণ্টা পর সকাল ৯টায়ও একই পরিমাণ রেকর্ড করা হয়। এ কারণে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলায় তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৪০ হাজার পরিবার।
বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে বলেও জানান তিস্তা ব্যারাজের উপ-সহকারী (পানি পরিমাপক) প্রকৌশলী আমিনুর রশীদ। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ দিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে তিস্তার তীরবর্তী এলাকায় দেখা দিয়েছে বন্যা। নদী ভরে যাওয়ায় বৃষ্টির পানিতে ডুবে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এরইমধ্যে পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতিবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, ডাউয়াবাড়ী, সিঙ্গীমারী, পাটিকাপাড়া, সিন্দুর্না, কালীগঞ্জের কাকিনা, তুষভান্ডার, চন্দ্রপুর, আদিতমারীর মহিষখোচা, দুর্গাপুর, পলাশী, লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা, রাজপুর, মোঘলহাট কুলাঘাট ও খুনিয়াগাছ ইউনিয়ন তিস্তা নদী বিধৌত হওয়ায় কিছু এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ফলে এসব এলাকার প্রায় ৪০ হাজার পরিবারের জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে। গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন লোকজন। পানি নিচে ডুবে গেছে সদ্য রোপণ করা কয়েক হাজার হেক্টর জমির আমন ধান খেত, বিনষ্ট হয়েছে সবজি ও মরিচ খেত। হাতিবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না এলাকার বাদল হোসেন ও মফিজ উদ্দিন জানান, তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় নদীর আশপাশের লোকজনের বাড়িতে পানি ঢুকে বন্যা দেখা দিয়েছে। অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল মজিত হোসেন জানান, অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে তার এলাকায় কয়েকশ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দিদের জন্য শুকনো খাবার বিতরণের দাবি জানান তিনি। গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার রহমান জানান, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য তিস্তা পাড়ের বসবাসরত লোকজনকে সতর্ক থাকতে সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে খবর পাঠানো হয়েছে। হাতিবান্ধা উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম জানান, বন্যার্তদের জন্য মজুদ রাখা ১৫ মেট্রিক টন জিআর চাল পানিবন্দিদের মধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। আদিতমারী উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মফিজুল হক জানান, বর্নাত্যদের জন্য ২০ মেট্রিক টন চাল মজুদ রয়েছে। সেখান থেকে বর্নাত্যদের মধ্যে খুব শিগগিরই বিতরণ করা হবে। লালমনিরহাট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার সুজা উদ দৌলা জানান, বন্যা কবলিত উপজেলাগুলোতে আগাম মজুদ রয়েছে ত্রাণ। সেখান থেকে বিতরণ করা হচ্ছে। এরপরও জেলায় মজুদ রয়েছে ২০২ মেট্রিক টন জিআর চাল ও সাড়ে ৪ লাখ টাকা। প্রয়োজন হলে আরও বরাদ্ধ নেয়া হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক বর্নাত্যদের খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজার রহমান জানান, বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যার আরো অবনতি হতে পারে।
< Prev | Next > |
---|