স্টাফ রিপোর্টার॥ আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট। এ তারিখটি জাতীয় শোক দিবস, বাঙালি জাতির শোক ও সন্তাপের দিন। আজ থেকে ৪২ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে দেশি-বিদেশি মদদপুষ্ট, পথভ্রষ্ট এ দেশেরই কিছু দুর্বৃত্ত। ঘাতকদের হাতে ওইদিন রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেল কিংবা পুত্রবধূরাও। ঘনিষ্ঠজনসহ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা শুধু ব্যক্তিকে হত্যাপ্রয়াস ছিল না, ছিল জাতির স্বাধীনতার শক্তিকে হত্যার অপচেষ্টা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। বাস্তবতা যে, ঘাতকচক্র তাকে বা তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে হত্যাকারীদের নিরাপদ জীবনও নিশ্চিত করেছিল। লজ্জাজনকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে ওই অপশক্তিকে ক্ষমতার ভাগিদার করেছিল। যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতা চায়নি, যাঁরা জাতির জনককে হত্যার মতো কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা করেছিল তাদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হলে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব মলিন হয়ে যায় বইকি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতালোভীরা এ দেশে এমনটিই করেছেন, যা লজ্জাজনক ছাড়া আর কিছুই নয়।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক। তিনি ছিলেন দরদি নেতা, সেরা মুক্তিসংগ্রামী ও সেরা রাষ্ট্রনায়ক। জননন্দিত নেতা হিসেবে তার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও দায়বোধ তাকে মহীরুহে পরিণত করেছিল। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন গণমানুষের ভাত-কাপড় নিশ্চিত করতে, কৃষকের হাতকে শক্তিশালী ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। সমাজের ধনী-দরিদ্র বৈষম্য দূর করাও ছিল তার অন্যতম শপথ। নীতি-আদর্শ ও কর্মনিষ্ঠার কারণে ব্যক্তি শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল। অথচ নৃশংসভাবে তাকে খুন হতে হয় তার প্রিয় দেশের মাটিতেই। কিন্তু বাঙালি জাতি বেইমান নয়, তারা বুঝিয়ে দিয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এ দেশের মাটিতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে কাজটিই করেছেন। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাঙালি জাতি পিতৃহত্যার বিচার পেয়েছে। জাতির জনক হত্যার রায় কার্যকরের মাধ্যমে জাতি কলঙ্কমুক্ত হলেও সত্য যে, এখনো কয়েকজন ঘৃণ্য অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এসব অপরাধীদের সত্বর দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকরের উদ্যোগ নিলে জাতির পিতার হত্যাকান্ডের পূর্ণাঙ্গ বিচার সম্পন্ন হতে পারে।
উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায়, এ দেশে একাত্তরের পরাজিত প্রেতাত্মার আস্ফালন আবারো বেড়েছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরুর পর থেকেই দেশবাসী এ অপশক্তির আস্ফালন দেখে আসছে। এরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হত্যাসহ সারাদেশে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। বিভিন্ন অজুহাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। এখনো বিচ্ছিন্নভাবে এরা সংগঠিত হওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার আদর্শকে নিরঙ্কুশ করতে সরকারের কর্তব্য হওয়া দরকার সব ধরনের অপশক্তির মূলোৎপাটন করা। এটি করতে পারলে জাতির পিতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি জাতি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তর করতে হলে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের বিকল্প থাকতে পারে না। এজন্য ১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অর্জন স্বাধীনতাকে যাঁরা মেনে নিতে পারেনি, তাদের ব্যাপারেও সদাসতর্ক থাকতে হবে। দেশ থেকে প্রতিক্রিয়াশীলদের উচ্ছেদ করতে হবে, যাতে আর কোনো শোক তারা বাংলার মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে না পারে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিক মতাদর্শের সঙ্গে কারো মতের অমিল থাকতে পারে। কিন্তু কারো জন্য বা কোনো রাজনীতিক দলের জন্য তার নৃশংস হত্যাকান্ডকে সমর্থন জানানো শুধু অমানবিকই নয়, প্রতিহিংসাপরায়ণতার চরম পরাকাষ্ঠা। সঙ্গত কারণেই এটা মনে রাখা দরকার, মানুষের মহত্ত্বকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ফলে এ দিনটি অস্বীকারের ধৃষ্টতা যেন কারো না হয়। আজকের এ শোকাবহ দিনে আমরা স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ নিহতদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
আজ চারদশকের বেশি সময় পার হয়ে এসেও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা সুফল ভোগ করতে পারছে না। বিরোধী শক্তিরা এখনো তাদের সর্বশক্তি দিয়ে আরো ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট ঘটাতে চায়। তবে জাতি এবারের ১৫ আগস্ট পালন করবে আলাদা মর্যাদায়। এদেশের সব গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপন, ফিচার, গল্প, উপন্যাস প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই স্বাধীনতা বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বেশিরভাগই সম্পন্ন হয়েছে। জাতির পিতাকে নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ কিছুটা হলেও নিতে পেরেছে। জাতি এতদিনের গ্লানি ও লাঞ্চনা অনেকটা হলেও মুছতে পেরেছে বলে মনে করে। যুদ্ধাপরধাীর বেশ ক’জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তাদের দম্ভ চিরতরে বিলীন হয়েছে। যারা বুক ফুলিয়ে বলত দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, রাজাকার নেই। তারা আজ সত্যিকার অর্থে জাতির কাছে পরাজিত।
< Prev | Next > |
---|