মোমিন মেহেদী
অনেক আগে একটি লেখা লিখেছিলাম, ‘স্মার্ট কার্ড কতটা স্মার্ট’ শিরোনামে। আজ যখন শুনলাম যে, স্মার্টকার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন; তখন আবারো প্রশ্ন নিরন্তর তৈরি হলো যে, ‘স্মার্ট কার্ড কতটা স্মার্ট’? ঐদি স্মার্ট-ই হতো, তাহলে তো আর এখন নতুন করে স্মার্টকার্ড বিতরণে নানা অসংগতি, ভোটারদের ভোগান্তি, ভুল সংশোধনের সুযোগ না থাকা, কার্ড বিতরণে শুধুমাত্র মৌখিক হিসাব থাকা এবং কার্ড বিতরণকারীদের অনিয়ম ও হারানো জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ব্যাংক ড্রাফট না করেই অবৈধ উপায়ে স্মার্টকার্ড সংগ্রহের অভিযোগ থাকায় 'পদ্ধতিগত' এ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, শোনা যেতো না। তার মানে নতুন প্রজন্ম জানে যে, জনগণকে বোকা বানিয়ে আবারো হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের রাস্তায় অগ্রসর হচ্ছে ইসি। অবশ্য এ নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে বলেও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে।
আর এরই প্রেক্ষিতে ইসির পক্ষ থেকে দায়সাড়া গোছের উত্তর সাজানো হয়েছে এভাবে, বিভিন্ন সমস্যা, অভিযোগ ও ভোটার ভোগান্তির প্রেক্ষিতে স্মার্টকার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে নিয়মের কিছুটা পরিবর্তন আনা হবে। কি কি পরিবর্তন আসবে তা নিয়ে সুপারিশ তৈরির কাজ চলছে; এই কাজ শেষ হলে নির্বাচন কমিশনে জমা তা দেয়া হবে। এক্ষেত্রে অন্যমত সুপারিশ হিসবে স্মার্টকার্ড বিতরণের বিপরীতে পুরনো এনআইডি কার্ড বা জিডির কাগজ অথবা স্লিপ সংগহের বিষয়টি থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে, স্মার্টকার্ড বিতরণের সময় ভোটারদের কাছ থেকে কোনো ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা হয় না। স্মার্টকার্ড দেয়ার ক্ষেত্রে যাদের পুরনো লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে সেই কার্ড দেখে পাঞ্চ মেশিন দিয়ে ফুটো করে তা ভোটারকেই আবার ফেরত দেয়া হয়। যাদের শুধু ভোটার স্লিপ রয়েছে তা দেখেও স্মার্টকার্ড দেয়া হয়। যাদের লেমিনেটেড পরিচয়পত্র হারিয়ে গেছে; তাদের ক্ষেত্রে পরিচয়পত্রের ফটোকপি, থানার জিডির কপি ও ব্যাংক ড্রাফটের স্লিপ দেখিয়ে স্মার্টকার্ড নিতে হয়। এক্ষেত্রে স্মার্টকার্ড বিতরণের বিপক্ষে ভোটারদের কাছ থেকে কোনো ডকুমেন্ট সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করা হয় না। এই কারণে কয়টা স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হচ্ছে এক্ষেত্রে মৌখিক ছাড়া অন্য কোন ভাবে হিসেব নেই। একজনের কার্ড অন্যজন নিয়ে যাচ্ছে কিনা এমন অভিযোগ আসলেও তা নির্ণয় সম্ভব হবে না। এই সুযোগে দুর্বৃত্ত চক্র যদি অন্যজনের কার্ড নিয়ে কোনো অপরাধ করে তাও ধরা সম্ভব হবে না। এছাড়া যাদের এনআইডি হারিয়ে গেছে তারা কি জরিমানার টাকা ব্যাংক ড্রাফট করে স্মার্টকার্ড সংগ্রহ করছেন; না ভিন্ন যোগসাজশ করে ব্যাংক ড্রাফট ছাড়াই কার্ড নিচ্ছেন তাও কমিশনের পক্ষে জানা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রতিটি হারানো কার্ডের জরিমানা বাবদ ৩৬৮ টাকা পাচ্ছেনা কমিশন। রাজধানীর বাসাবো কমিউনিটি সেন্টারে স্মার্টকার্ড বিতরণের কাজে নিয়োজিত একজন অপারেটর বলেন, পুরনো লেমিনেটেড কার্ড হারিয়ে ব্যাংক ড্রাফট না করে স্মার্টকার্ড নিচ্ছেন এমন সংখ্যা দিনে প্রায় দুই থেকে আড়াইশো। অভিযোগের আওয়াজও উঠেছে ঠিক এভাবে- ব্যাংকে টাকা জমা না দিয়ে অপারেটর বা রাজনৈতিক নেতাদের টাকা দিয়ে কার্ড সংগ্রহ করেছেন এমন কথা অনেকে মুখে স্বীকার করলেও লিখিতভাবে কেউ অভিযোগ করেন না। তাই ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয় না।
আর ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্মার্টকার্ড বিতরণের কাজ শুরুর আগে পুরনো এনআইডি কার্ড জমা নেয়ার কথা থাকলেও এতগুলো কার্ডের রাখার জায়গা স্বল্পতার কারণে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ইসি। এখন স্মার্টকার্ড বিতরণের প্রেক্ষিতে তাদের কাছে কোন ডকুমেন্ট থাকছে না। তাই স্মার্টকার্ড বিতরণে মৌখিক হিসাবের উপর তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে। এছাড়া কয়টা হারানো এনআইডির কাগজ দেখে স্মার্টকার্ড দেয়া হচ্ছে; জরিমানার টাকা জমা দেয়া হয়েছে কিনা; কয়টা জমা দেয়া হয়েছে এর কোন হিসেব কমিশনের কাছে থাকছে না। এই সুযোগে নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাসহ যারা এই কাজে নিয়োজিত তারা নিজেরা হারানো কার্ডের টাকা নিয়ে স্মার্টকার্ড দিয়ে দেয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ আসছে। কিন্তু সঠিক প্রমাণাদিসহ কোন অভিযোগ না থাকায় কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। তাই কার্ড বিতরণের নিয়মের কিছুটা পরিবর্তন করা হবে যাতে কোন অনিয়মের সুযোগ না থাকে। দেশ্যব্যাপী স্মার্টকার্ড বিতরণ শুরু হলে পুরনো এনআইডি কার্ড ফেরত না দিয়ে সংগ্রহ করা হবে। হারানো কার্ডের জন্য হয় জরিমানা বাদ দেয়া হবে, নয়তো জিডি ও ব্যাংক ড্রাফট সস্নিপও সংগ্রহ করা হবে। যাতে আমরা হিসেব করতে পারি কয়টা স্মার্টকার্ড বিতরণ হয়েছে এবং এর মধ্যে কয়টা হারানো ও কয়টা লেমিনেটেড এনআইডি না দিয়ে সরাসরি স্মার্টকার্ড প্রদান হয়েছে।
কিন্তু তার পাশাপাশি সত্যও মহাসত্য হলো- যাদের স্মার্টকার্ডে তথ্যের ভুল রয়েছে তা সংশোধনের কোনো সুযোগ এখন পর্যন্ত নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নির্বাচন কর্মকর্তা জানান, যারা স্মার্টকার্ড নিচ্ছেন, তারা তথ্য সংশোধন করতে গেলে সহসাই ডুপ্লিকেট স্মার্টকার্ড পাবেন না। কবে নাগাদ পাবেন তাও বলা যাচ্ছে না। ২০১৪ সালে যারা ভোটার হয়েছেন তারা সরাসরি স্মার্টকার্ড পাচ্ছেন এখন। তাদের হাতে ১৩ ডিজিটের কিংবা ১৭ ডিজিটের লেমিনেটে এনআইডি নেই। সেক্ষেত্রে ১০ ডিজিটের স্মার্টকার্ড সংশোধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করলে তা যাচাইয়ে কারিগরি সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। উভয় ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন অফিসে কেউ সংশোধনের আবেদন করলে তথ্য সংশোধন হবে ডাটা বেইজে। প্রয়োজনে লেমিনেটেড সংশোধিত কার্ড নিতে হতে পারে। যারা বিতরণ কেন্দ্রে গিয়েও নানা জটিলতায় স্মার্ট নিতে পারেননি, সার্ভারে 'নট ফাউন্ড' দেখানো হয়েছে; তাদের ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে বলা হয়েছে বাড়িতে গিয়ে পরে পৌঁছে দেয়া হবে। কিন্তু আদৌ এসব নাগরিকের কার্ড বাড়িতে পৌঁছানো সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। একই সাথে এখন পর্যন্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার এমন অভিযোগ রয়েছে। আর যারা বিতরণ কেন্দ্রেই যাননি, তারা আবার কবে, কোথায় ও নির্বাচন কমিশনের কোন অফিসে গিয়ে কার্ড নিতে পারবেন সে বিষয়েও ইসির নির্দেশনা নেই বলে জানান নির্বাচন কর্মকর্তারা।
প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংম ভোটার স্মার্টকার্ড নিতে আসেননি। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানতে পেরেছি। এর উপর আবার হারানো এনআইডির মালিক যদি জিডি করতে থানায় যায়, তাহলে তো চরম ভোগান্তির পর্ব আছেই। এম একটা পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছে আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা; যে পরিস্থিতিতে তালাবদ্ধ হয়ে থাকার প্রতিবাদ জানালেও জঙ্গী, না জানালেও জঙ্গীদের হামলার শিকার হতে হবে, হতে হয়, হতে হচ্ছে। তবু বাংলাদেশকে ভালোবেসে সাহসের সাথে এগিয়ে চলার জন্য নিবেদিত থাকি, আছি, থাকবো। পাশাপাশি বলবো- বাংলাদেশে আর কতকাল চলবে এসব ভন্ডামি আর নষ্টামি? জলদি শেষ হোক কষ্টগুলো, চাই না এসব কষ্টামি। আর তাই চাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক কন্যা শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ। যাতে করে পিতা হারানো, মাতা হারানো নির্মম কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাতকারি রাজনীতির দেশে সবাই অন্তত তাদের মত বেড়ে উঠুক-গর্জে উঠুক; কষ্ট যাদের রাজপথের রাজনীতি- প্রেরণার উৎস। সেই উৎস থেকে ক্রমশ সফলতার সিঁড়িতে পা রাখবে বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজন নীতির চর্চা। যেমন নীতির চর্চা থাকলে গণপরিবহনে নীতিমালা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়ে গড়তে হবে বাংলাদেশ...
স্মার্ট কার্ড দিয়ে অনবরত যেন কোন অভিযোগ গড়ে না ওঠে; সেজন্য চাই সতত চেষ্টা-ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি
< Prev | Next > |
---|