এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
ইসলাম শান্তি ও আল্লাহর নিকট আত্ম সমর্পনের ধর্ম। সমাজে ফেতনা সৃষ্টি করা, কাহাকেও হত্যা করা, হত্যাকান্ড সংগঠিত করা, একে অপরের গীবত, হিংসা, হত্যার ব্যাপারে প্রণোদিত হওয়া ও উসকিয়ে দেয়া, যে কোন ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর আঘাত করা, তীর্যক ভাষায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে সমালোচনা করা, জোর করে অন্যের সম্পত্তির দাবীদার হওয়া ইত্যাদি সহ যে কোন ধরণের জোর জবর দস্তির স্থান ইসলাম ধর্মে একেবারেই নেই। যা আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন ও রাসূল (সাঃ) ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মুসলমানদের বারংবার এর অপরিসীম ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন।
পবিত্র কোরআনের আয়াত সূরা কাফেরুনা তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে ইসলাম ধর্মে জোর জুলুমের স্থান নেই। কোন ভিন্ন ধর্মের মতালম্বী ইসলামের সৌন্দর্য, মাধুর্য ও সুমহান ইসলাম ধর্মের আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে যদি ইসলাম ধর্মের সুশীতল পতাকা তলে না আসে, তবে তাকে বা তাহাদিগকে জোর করে আনা কে কোন মতেই তা ইসলাম যেমনি পছন্দ করে না, তেমনি সমর্থনও করেনা। বরং বলা হয়েছে, লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়াদীন। অর্থাৎ যার জন্য যার ধর্ম। লা একরা ফিদ্দীন অর্থাৎ ধর্মে জোর জুলুম নেই। ইসলামের এই সুমহান মর্মবাণী ও সৌন্দর্য মন্ডিত নির্দেশনা দেখেই যুগ যুগ ও শতাব্দীর পর শতান্দী ধরে অমুসলমানরা তওবা পড়ে এবং কালেমায়ে তৈয়্যাবা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) উচ্চারণ করে প্রতিনিয়ত মুসলমান হচ্ছে। যার উদাহরণের শেষ নেই। এমনকি সম্রাট বাবরের আমলে গড়া মুসলমানদের ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ভেঙে যারা এক সময় তদস্থলে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, তাদের মধ্যে পরবর্তী সময় অনেকেই তাদের ভুল বুঝতে পেরে ইসলামের সুমহান আদর্শ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মুসলমান হয়ে তারা দুনিয়াময় ইসলামের সুমহান আদর্শ, কোরআন, হাদীসের শিক্ষা ও তাৎপর্য কে ছড়িয়ে দিয়ে আজ ইসলামের মর্মবাণীকে উর্দ্ধে তুলে ধরছে। এমনিভাবে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার সাথে যে লোকটি হাতুড়ি, শাবল চালিয়ে ছিল এমন একজন ভারতীয় শিখের সাথে ২ বছর আগে কিশোরগঞ্জ জেলা শহীদী মসজিদ প্রাঙ্গনে ওয়াজ মাহফিলে আসা লোকটির সাথে আমার মতো অনেকের সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে থাকে। তার অনুসারী সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিলে বয়ান করে থাকেন।
তার সাথে সাক্ষাৎ করলে উক্ত নও মুসলীম শিখ হিন্দী ভাষায় লেখা এবং বাংলায় সংকুলিত তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও মুসলমান হওয়ায় কাহিনী বর্ণনা সমেত বিশ পৃষ্ঠার বইটি দেন। অনেককে বইটি পড়ার অনুরোধ করেন। সেই বইটি আমার মতো অনেকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। তিনি অনুরোধ করে বলেছিলেন, এই বইটির আরো কপি ছাপিয়ে যেন আরো মুসলীম ও অমুসলীমদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
তাছাড়া তার সাথে সাক্ষাৎ পর্বে আমার মতো অনেকেই প্রথমেই জামাতের সাথে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া, নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত এবং আল্লাহর রাস্তায় দীনে সময় দেয়ার জন্যও তাগেদা রাখেন। তারপর বলেছিলেন অন্ধকার থেকে যে আলোর পথে এসেছি, তা ভাবতে সর্বক্ষণ শরীর শিহরিয়া উঠে। এ দুনিয়ার কয়েকটা বছর আখেরাতের কয়েক মিনিটের সময় মাত্র। দুনিয়ার শানশৌকত কিছুইনা। সবকিছু পাপিষ্ট ইবলিশ শয়তানের প্রতারণা। তাছাড়া আরো বলেছিলেন তার সাথে আরো যারা ৯১ সালে দিল্লীর বাবরী মসজিদের স্থলে রাম মন্দির বানানোর জন্য হাতুড়ী, শাবল দিয়ে বাবরী মসজিদ ভেঙে ছিল তাদের মধ্যে জীবিত আছে এমন সব সহকর্মিও নাকি ওনার মতো ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মুসলমান হয়ে ভারত, বাংলাদেশসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ভিন্ন মতালম্বী ধর্মের লোকদিগকে আল্লাহ ও কোরআনের বাণী এবং রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশিত পথে আসার আহবান জানাচ্ছেন। যার ফলে ভারত, বাংলাদেশ সহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ভিন্ন বর্ণের নারী পুরুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মুসলমান হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে অন্য ধর্ম থেকে স্ব ইচ্ছায় ইসলামের সুশীতল পতাকা তলে আসার সংবাদ আজ কারো অজানা নহে। বর্তমান প্রিন্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়া আধুনিক তথ্য প্রবাহ ও তথ্য প্রযুক্তির যোগে (Information technology), চোখ, কান খোলা লোকদের আজ তা জানতে কোন অসুবিধা হয়নি।
তবে দুঃখ হয় এখানেই যারা আজ জঙ্গি ও জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে। কিভাবে ওরা মানুষ হত্যার জঘন্যতম ও ঘৃণ্য ভেষ্ট বোমায় নিজের জীবনকে নিজেই বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। যার অস্থিত্ব ইসলামের কোথায়ও নেই। তাদের মুখ থেকে আবার “আল্লাহু আকবর” ধ্বনিও উচ্চারিত হয়ে থাকে। কারণ ইসলাম ধর্মে অন্যকে যেমন হত্যা করা বারংবার নিষেধ ও সতর্ক করা হয়েছে তেমনি নিজেকে নিজে এবং আত্মহত্যার পথ থেকে সম্পূর্ণ সজাগ থাকার কথাও বলা হয়েছে। যা রয়েছে পবিত্র পাক-কালাম কোরআনের বিভিন্ন সূরা ও নির্দেশনায়। তাছাড়া আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন সুষ্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, হত্যাকারীকে কোন অবস্থাতেই আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন ক্ষমা করবেন না। যারা স্ব-ইচ্ছায় গাছে ঝুলে, পানিতে, আগুনে, বাসে, ট্রেনে, ট্রাকের তলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বোমা মেরে নিজেকে উড়িয়ে দেয়, বিষপান করে এবং অন্যান্য উপায়ে নিজের জান নিজে ত্যাগ করে বা আত্মহত্যা করে তাদের জানাযা না পড়ার জন্যও নির্দেশ দিয়েছেন। সৃষ্টির মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং নেয়ার মালিকও আল্লাহ। বলা হয়েছে, তুমি কি জাননা, অনু পরমাণু বীর্য কণা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছি। তারপর বলা হয়েছে, তোমার জান তুমি ত্যাগ করার কে? আরো বলা হয়েছে, জান দেয়া এবং নেয়ার মালিক কী তুমি? জান দেয়া, নেয়া ইহকাল ও পরকালের সবকিছুর মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন। শুধু যারা এভাবে আত্মহত্যা করে তারা হাশরের ময়দানে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার ও কোন সুযোগ পাবে না। তদোপরি হত্যাকারীরও কোন ক্ষমা নেই।
এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ হচ্ছে, তায়েফের যুদ্ধে রাসুল (সাঃ) রক্তে রঞ্জিত হন। ইচ্ছা করলে তিনি আল্লাহর নির্দেশে বিধর্মীদের সমূলে ধ্বংস করে দিতে পারতেন। কিন্তু দয়ার নবী তা না করে আল্লাহর দরবারে তাদেরকে হেদায়েত দানের কথা আরজ করেন। যার ফলে বিধর্মীরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে থাকে। আজ জঙ্গি এবং জঙ্গিবাদে বিশ্বাসীরা যে ভুল ও গুমরাহীর পথ বেছে নিয়েছে, এটা সম্পূর্ণ অন্ধকারের পথ। তা একজন মুসলমান হিসেবে আমার মতো অনেককেই ভাবিয়ে তুলছে। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আলেম ওলেমা ও মাওলানা সামসুল ইসলাম সাহেবের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ পথ ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য জঘন্যতম পথ, চরম অন্যায়ের পথ, তেমনি এ পথ বিভ্রান্ত পথও বটে। তাছাড়া এ ব্যাপারে অনেকেই আফসোস করে বলেছেন, এমন জঘন্য ও বেদাত পথে কোন মুসলমান নরনারী,
যুবক, যুবা যাওয়াতো দুরের কথা চিন্তা করাও মহাপাপ। যারা এ জঘন্য কাজে শরীক হয়ে “আল্লাহু আকবর ধ্বনি দেয়” আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ট। তারা বরং ইহকাল পরকালের সর্বেস্বর, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনকে যেভাবে অসম্মান করার পথ বেছে নিয়েছে, তেমনিভাবে ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদেরকে দুনিয়ার বিধর্মীদের নিকট হালকা ও সমালোচনা মুখর করে তুলছে। ওরা যেমনি মানবতার শত্রু, তেমনি ইসলাম, মুসলমান, আমাদের প্রিয় রাসুল (সাঃ) আলেম, ওলামা ও সর্ব শক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনেরও শত্রু। অনেকে বলছেন, ইসলাম ও মুসলমানকে হেয় করার জন্য এই জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ ইহুদী, নাসারা ও বিধর্মীদের ইন্ধন, উৎসাহ, অর্থ, অত্যাধুনিক বোমা, গ্রেনেড, গুলি, বন্দুক দেয়ার কারণেই এ জঘন্যতম ও ইসলাম বিরোধী কাজ করার সাহস পাচ্ছে।
আজ দেশের সকল মতের রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, ছাত্র, যুবক, জনতা ও সর্বশ্রেণীর মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই জঘন্যতম এ হেন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত বলে অনেকেই মনে করে থাকে। ওদের আসলে কোন জাত নেই, ধর্ম নেই, দর্শন নেই এবং কোন রাজনীতিও তাতে থাকার কথা নয়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সামরিক বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) এম সাখাওয়াত হোসেন এক মন্তব্যে বলেছেন, ‘এ পরিস্থিতিতে আমরা সবাই আতংকগ্রস্থ। কোথায় কখন কি হবে কেউ জানেনা। সংকট উত্তরনে সব দল ও নানা মতের মানুষকে এক ছাতার নীচে আনতে হবে। দেশবাসীকে সচেতন করতে হবে। তা না করে এখনও যদি আমরা দোষারোপের রাজনীতি করি, তা হলে ভুল করা হবে। মনে রাখতে হবে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ন (Sensative) এক বাক্যে ও এক কথায় ওরা দেশ জাতি ও জনগণের জঘন্য শত্রু। দেশের মানুষ মনে করে থাকে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এখনই সমন্বিতভাবে কর্মসূচী নিয়ে সামনে না এগুলে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত পাচ্ছে বাংলাদেশ দুনিয়ার বুকে অকার্যকর দেশের মতো পরিণত হয়ে গেলে এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের অনেকটাই পিছিয়ে যেতে পারে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। তদোপরি ১৬ কোটি মানুষের জন্য জঘন্য এ ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা ও সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এখনই কৌশল বেড় করে ওদেরকে থামাতে হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মক্তব, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনই শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের অনেকেই যেতে ভয় পায়। এমনকি অভিভাবকরাও এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ম। এ জঘন্য ও ঘৃণ্য সমস্যাকে দেশের বড় সমস্যা হিসেবে দেখার মতো অবস্থা আজ সম্মুখীন। যত তাড়াতাড়ি এ ঘৃণ্য সমস্যার সমাধান হয়, ততই দেশ ও জনগণের জন্য অতীব মঙ্গল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল ও জনগণের সহায়তায় এ হেন জঘন্য ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা অপরিহার্য বলে দেশের মানুষের অভিমত। জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ দমনে এ পর্যন্ত আইন শৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর কমান্ডো ইউনিটের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমায় আতিয়া মহলে জঙ্গি কবলিত বিল্ডিং থেকে সম্প্রতি অক্ষত অবস্থায় ৭৮ জন নারী পুরুষ, যুবক, বৃদ্ধ ও শিশুদেরকে উদ্ধার করা সত্যিই আল্লাহর রহমত ও উদ্ধারকারী সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের দুঃসাহসিক ভূমিকা বাস্তবিকই গৌরবোজ্জল।
এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট
< Prev | Next > |
---|