মাহমুদুল বাসার
motamotসাহসই ছিলো দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালির একমাত্র অস্ত্র; বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আর কোনো বাহ্যিক চাকচিক্যময় যোগ্যতা ছিলো না। বিদ্রোহী সত্তাই নজরুলের আসল সত্ত। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাই তার শ্রেষ্ঠ কবিতা আর ‘মানুষ’ কবিতা। ব্রিটিশ সিংহাসন টালে উঠেছিলো নজরুলের বিদ্রোহী প্রবন্ধগুলোর উত্তাপে। বঙ্গবন্ধুকে খোদ মার্কিন রাজ্যের এক সাপ্তাহিক বলেছে ‘রাজনীতির কবি’। বলেছে তার ৭ মার্চের অন্নিগর্ভ ভাষণকে লক্ষ করে। যেখানে তার সাহসেরই দীপ্তিময় প্রকাশ ঘটেছে। সাহস রবীন্দ্রনাথের ও ছিলো। নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের চিঠিটি পড়লে বোঝা ইংরেজ লাটকে কী তেজস্বী ভাষায় লিখেছিলেন চিঠিটি। পেছন ফিরে তাকাননি। নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করলে আর্থিক লোকসানের কথা ভাবেননি, ইংরেজ তথা গোটা ইউরোপের বিরাজ ভাজনের তোয়াক্কা করেননি।

বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. ওয়াজেদের বইটি পড়লে বোঝা যায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সৌদি বাদশাহ্ বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অপসারণ করার জন্য। বঙ্গবন্ধু একটুও ভয় পাননি। মাথা নত করেন নি। বলেছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্মের মানুষ অংশ গ্রহণ করেছে, রক্ত দিয়েছে, সব ধর্মের নারী ইজ্জত দিয়েছে। সেখানে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে উচ্ছেদ করা যায় না। দেশ স্বাধীনের পর হাজীদের হজ্বে পাঠানোর ব্যাপারে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলো, যাতে তিনি ভয় পেয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতা ত্যাগ করেন। কিন্তু তিনি ভয় পাননি। ধর্মনিরপেক্ষতা ত্যাগ করেননি। অন্য দেশের সহযোগিতায় হাজীদের হজ্বে পাঠিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর দেশের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মৌলবাদীরা, পাকিস্তান পন্থীরা, চীনপন্থীরা, গলাকাটা পন্থীরা, ফতোয়াবাজরা, গণবাহিনী-সর্বহারা বাহিনী এক সঙ্গে জোট বেঁধে তাঁর বিরোধিতা করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে বামপন্থীরা পর্যন্ত কূট সমালোচনা করেছে, তিনি মাথা নত করেননি। প্রতিটি মাদ্রাসায় লুকিয়ে থাকা জামায়াতীরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রখর অপপ্রচার করেছে। তাকে ব্যঙ্গ করেছে। বলেছে তিনি ইসলাম ধবংস করেছেন, ভারতের কাছে দেশ বন্ধক দিয়েছেন। বলেছে তার পূর্বপুরুষরা হিন্দু ছিলেন। তিনি মাথা নত করেননি। তিনি মিত্র চিনতে ভুল করেননি। তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন কমরেড মনিসিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ও হাজী দানেশকে নিয়ে। এটা ছিলো তার দুঃসাহসী পদক্ষেপ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং সেকুলার শক্তির সঙ্গেই তিনি জোট বেঁধেছিলেন। এই সাহস, এই বিস্তৃত বক্ষপট, এই পদক্ষেপ নেবার দৃঢ়তা তাঁর ছিলো। মৃত্যুতে তাঁর কোনো পতন হয়নি, কোনো পরাজয় ঘটেনি। পরাজয় হতো যদি তিনি ১৫ আগষ্টের খুনীদের কাছে আত্মসমর্পন করতেন। তাঁর সেনা প্রধান তাঁকে বাসা থেকে পালাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ছিঃ ছিঃ। ১৯৭১ সালে পালালেন না আর কর্ণেল ফারুকদের মতো চুনোপুটিদের ভয়ে পালাবেন? বরং ওরাই ভয় পেয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড়াতে। তারপর মদখেয়ে মাতাল হয়ে গুলি চালিয়েছে।

নজরুলের প্রবন্ধগুলোর মধ্যেই তার চরম সাহসের পতাকা উড্ডীয়মান হয়েছে। ‘আমি সৈনিক’ প্রবন্ধটি যখন পড়ি তখন রক্তের ফোটায় ফোটায় আগুন ধরে গেছে। রবীন্দুনাথ ইংরেজের ঔদ্ধত্যের মুখে দাঁড়িয়ে ১৯০৫ সালে, বিদ্রোহী বাংলাদেশে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি লিখেছিলেন। আর নজরুল ইংরেজের আস্ফালনের মুখেই ‘আমি সৈনিক’ প্রবন্ধে বললেন, ‘ওরে আমার ভারতের সেরা, আগুন খেলার সোনার বাঙলা।’ অগ্নির অক্ষরে লেখা এমন প্রবন্ধ সাহস না থাকলে লেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথের সাহস না থাকলে কি নজরুলকে টেলিগ্রাম করে বলতে পারতেন, ‘প্লিজ গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার প্লেইমস্ ইউ।’ সাহস ছিলো বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচর্যের। নাহলে কি বলতে পারতেন ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘটি’? না হলে কি বলতে পারতেন, ‘জ্বলে পুড়ে মার ছারখার। তবু মাথা নোয়াবার নয়?’

কিন্তু আজ কি আমরা ৩০ লক্ষ শহীদের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে সাহস হারিয়ে ফেললাম, যে জন্য মৌলবাদীদের ভয়ে মাথা নোয়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম? কেউ মানুক বা না মানুক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে দ্বিতীয় পর্বের মুক্তিযুদ্ধটা চলছে। আপোস করে, ভয় দিয়ে কিছুই জয় করা যায় না। মৌলবাদীদের কাছে যদি আপোসই করতে হবে তাহলে ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিলো কেন? যুদ্ধের কৌশল একটাই, তাহলে শত্রুকে মোকাবেলা করা। সন্তোষগুপ্ত একটা প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে টিপু সুলতানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। টিপু সুলতান নিজেই যুদ্ধের মাঠে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। শেষ মুহূর্তেও যুদ্ধের মাঠ ত্যাগ করেননি, পালাননি। বঙ্গবন্ধুও খুনীদের ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণ করেননি, তার সেনা প্রধানের কথামতো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেননি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিরস্ত্র কৌশলেই লড়াই করতে করতে প্রাণ দিয়েছেন।

আর এখন আমরা কী করতে যাচ্ছি? মৌলবাদীদের ছবক নিতে শুরু করেছি। মৌলবাদীদের দাওয়াত দিয়ে ঘরে এনে তোয়াজ করতে শুরু করেছি। নজরুল বলেছেন, ‘মৌ-লোভী যত মৌলভী’-এদের ভয় পেতে হবে? কেন কী অন্যায় করেছে বাঙালি জ্যাতি? এরা তো পাকিস্তানি আর ইসলামকে এক করে দেখে, এ সব মৌ-লোভী, মৌলবাদীরা আয়ুব খান কে গাউস কুতুব মনে করত, বঙ্গবন্ধুকে ইসলামের শত্রু ভাবতো। এরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টকে স্বাগত জানিয়েছে, জিয়ায়উর রহমানকে ইসলাম পুনরুদ্ধারের নব খলিফা মনে করতো। এদের আস্কারা দিলে তো বাঙালি জাতির নৈতিক স্পিরিট হারিয়ে ফেলবে। বর্তমান যুদ্ধটাতো এদের বিরুদ্ধেই। এরা জিয়া এবং এরশাদের কাছ থেকে স্বার্থ নিয়ে তাদের ক্ষমতায় থাকার ছাড়পত্র দিয়েছে। এরা ধর্র্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে। যে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই, সে দেশ হবে ওলামা লীগের দেশ, সে দেশ মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ হতে পারে না। মধ্য যুগের মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষ চালু করেন। পাঠান সুলতানরা ধর্মনিরাপক্ষতা লালন করেছেন, বাঙালি সংস্কৃতির, বাঙালির উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সেখানে মৌলবাদীরা বাগড়া দিতে এসেছে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে। আমরা কি কাঠমোল্লাদের কথা মত চলবো নাকি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লা, ড. মুহাম্মদ এনামূল হক, মাওলানা সুবীরুজ্জামান ইসলামাবাদী এবং আব্দুল করিম সাহিত্য বিশরেদের আদর্শ মেনে চলবো? আমরা কি এই মন্ত্র ভুলে যাবো,’ আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটা কি কাঠ মোল্লাদের দেশ হবে?

মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক, গবেষক।

সাম্প্রতিক