মীর আবদুল আলীম
motamotআমাদের দেশটা অসম্ভব রকমের দামী! তাই ভিনদেশীরা এদেশ কিনে বারবার। সেই ছোট বেলায় শুনেছি এমন দেশ কেনা বেঁচার গল্প। এখনও শুনছি। আসলে এ গল্পটা বেশ পুরনো। ছোটকালে ভয় পেতাম, দেশ বুঝি সত্যিই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে; আর আমরা হবো ভিনদেশী। গল্প শুনছি, কিন্তু দেশ বিক্রি হয় না কখনো। স্বাধীন দেশ বিক্রি হয় কি করে? দেশ বিক্রির প্রথা আছে নাকি? ছোট বেলায় শুনতাম বঙ্গবন্ধু দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন। দেশ স্বাধীনের সেই ১৯৭১ সালেই নাকি ভারত আমদের দেশ কিনে নিয়েছে। জাতিরজনক (দেশের জন্মদাতা) বঙ্গবন্ধু নাকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির কাছে দেশ পুরটাই বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন এমন কথা বলছেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়অ। শিক্ষ জীবনে, কর্মজীবনে এসেও সেই দেশ বিক্রির রমরমা গল্প শুনছি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দেশে প্রচার করা হলো আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় গেলে দেশ বিক্রি করে দেবে। দলটি ক্ষমতায় এলো ঠিকই। দেশ আর বিক্রি হলো না। ২০১০এ শোনা গেলো চিনের কাছে নাকি দেশ বিক্রি হয়ে গেছে। হরদম শুনছি এই দেশ বিক্রির গল্প। এতোবার দেশ বিক্রি হলো কিন্তু আমরা এখনও অন্যদেশী হলাম না কেন?
বাঙ্গালীরাতো কথায় কথায় বলে আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায়ি ভালো বাসী। তবে কি সোনা দিয়েই মোড়া সোনার বাংলা? তা না হলে এত দাম এই দেশটার হয় কি করে? আর ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশটা কতবার বিক্রি হয় বুঝি না। ফেসবুক আর ইন্টারনেটের বদান্নতায় হালে বেশ দেশ বিক্রির গল্পটা বেশ মজেছে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি ভারতের কাছে দেশ বিক্রির করে দিয়েছেন। আর তাতেই ফেসবুতে তা নিয়ে লম্ফ জম্ফ চলছে। আমরাও বলে ফিরছি দেশটা বিক্রি হয়ে গেছে। কই সেই শিশু কাল থেকেতো শুনছি দেশ বিক্রির গল্প। এখনও বাংলাদেশ বাংলাদেশই আছে। কেউ দেশ এখনও বেঁচেনি, আর কেউ কিনেও নেয়নি এদেশ।
একটু পেছনে ফিরে যেতে চাই। বিএনপি জামায়াত জোট ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে শুরুতেই রীতি মতো ‘প্রতিরক্ষা চুক্তি’ করেছিল চীনের সাথে। তাতা কি তারা চীনের হাতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সার্বভৌমত্ব তুলে দিয়েছিলেন? এমন চুক্তি চিনের সাথে হয়েছে, তা প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের সাথেও হলো। তাতে দোসের কি আছে দেখি না। তবে কেন আজ তারাই দেশ বিক্রির গল্পে মজেছেন? এমন সস্তা ধুয়া তোলে সাময়িক দেশের কোমলমতি মানুষকে বিভ্যান্ত করা যায় কিন্তু তাতে সফলতা পাওয়া যায় না। একটু প্রশ্ন রাখি। আমাদেও মুক্তিযোদ্ধেও সময় ভারত কি আমাদেও পাশে ছিলো? তাদেও সহযোগিদায় আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। নতুন স্বাধীন দেশ হিসাবে আমরা ততটা শক্তিশালি ছিলাম না এখন যতটা আছি। দেশটাকে যদি ভারত নিয়ে নিতেই চাইত, তবে সে বাংলাদেশের গোড়ার দিকেই নিয়ে নিত। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর এসে চিন্তা করতো না। এমন যোক্তি কি খুব খোঁড়া যোক্তি? দেশ বিক্রির গল্পটা কিন্তু বেশ পুেেনা। পাকিস্থান আমলে বলা হলো এমন গল্প। ভারত দেশ নিয়ে যাবে জুজুর ভয়টাও বংশানুক্রমিক। এখনও তা চলছে। বোধ করি চলতেই থাকবে। ভারতীয়দের দেশ নেওয়ার ইচ্ছে থাকলে আজকে এত বছর পরেও যারা জুজুর ভয়ে ভীত তাদেরকে আর স্বাধীন বাংলাদেশ দেখতে হত না আমাদের। সেই ১৯৭১ সালেই দেশটা ভারতের একটি অঙ্গ রাজ্য হয়ে যেত। হয়েছে কি?
আসলে দেশ বিক্রির গল্পটা তখনই শুরু হয় যখন অন্যদেশের সাথে কোন চুক্তি হয়। এক দেশের সাথে আরেক দেশের চুক্তি হতেই পারে। তাই বলে তাকি দেশ বিক্রির দলিলদস্তবেদ? বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি ক্ষমতায় থাকবার জন্য এদেশের কিছুই রাখেননি, সব ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনকি বাকি যা আছে তাও বিক্রি করে আসবার জন্যই নাকি এবারের ভারত সফরে গেছেন। প্রতিরক্ষা চুক্তি নাকি এমনই চুক্তি। এমন চুক্তি বিশ্বেও বিভিন্ন দেশে আছে কই সেসব দেশতো বেঁচাবিক্রি হয়নি? চুক্তিটা জেনে, পড়ে না হয় মন্তব্য করি? আমি যতটুকু জানি এ চুক্তির বাস্তবায়ন বাংলাদেশের ইচ্ছে মাফিকই হবে। এনিয়ে দেশ বিক্রির সাজানো গল্পটা বোধ করি জনগন খায়নি। বাংলাদেশের আয়তন কত? ৪৬ বছর বয়স্ক দেশটা যেভাবে বিক্রি হচ্ছে(!) তাতে দেশের আয়তন নিয়ে ভাবতে হবে। এভাবে বিক্রি হচ্ছে দেশ কই দেশের আয়েতোনতো কমছে না। দেশটাওতো আছে এদেশেই। নামটাও সেই বাংলাদেশ। ভাবি স্বাধিন দেশ কিভাবে বেঁচা বিক্রি হয়? আর এ গল্পটাও খায় কি করে মানুষ?
৮ এপ্রিল রাতে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে ভারতের সঙ্গে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দেশের যা বাকি ছিলো সবকিছু এই সরকার বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। আর তাতেই “দেশ বিক্রি হয়ে গেছে” এমন কথামালাই যেন ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে পুরো ফেসবুকের দেয়াল জুড়ে। তাতে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা। এমন সরেস আলোচনায় আর নানান জনের নানা মতামতো ফেসবুক বেশ চাঙ্গা। বেগম জিয়া এভাবে বলেছেন- এই সরকার আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন পূরণ করতে কাজ করে যাচ্ছে। তারা দেশের কিছুই রাখেনি, সব বিক্রি করে দিয়েছে।’ একদম স্পষ্ট কথা দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন। এর পওে আমরা আর বাংলাদেশি থাকি কি করে? একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এমন কথা বললে আর কিছুই থাকে না। এ কথার পর আমরা আর বাংলঅদেশী নই। অঅর যারা রাজনীতি করছেন তারা ভারতোর রাজনীতিবিদ, যারা চাকুরি করছেন তারা ভারত সরকারের চাকুরে। বাহ! বেশ ভালেঅ গল্প। আল্প দামে কেনা গল্পটা মন্দ না।
এর আগে পাবত্য চুক্তির সময় শুনেছি পাবত্য চট্রগ্রম এদেশ থেকে আলাদা করার জন্যই নাকি পাবত্য চুক্তি। পাবত্য চট্রগ্রাম কি আলাদা হয়ে গেছে? এদেশেইতো আছে। এর আগে শুনতাম, ফেনী পর্যন্ত নাকি ইন্ডিয়ার দখলে চলে যাবে। অনেক বছর গড়িয়েছে কিন্তু ফেনি কোন দেশে যায়নি এদেশেই আছে। এখন শুনছি পুরো দেশটার যা কিছু ছিলো সবই বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রির পর আমারওতো বিক্রিই হয়ে গেলাম ভারতের কাছে। ভাবি এসব কথা কিভাবে বলি আমরা? আমাদের রয়েছে চীনের সাথে সবচেয়ে বড় এক সামরিক চুক্তি। চীন ছিল আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী। ভারত আমাদের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে, আর সেই ভারতের সাথে একটি সামরিক সমঝোতা স্বাক্ষরেই দেশ বিক্রি হয়ে গেছে এটা ভাবা কতটা যোক্তি যুক্ত। এবার প্রধানমন্ত্রীর সফরে ভারতের সঙ্গে সমরিক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষও করেছেন। এটি কোনো ‘আন্তর্জাতিক চুক্তি’ নয়। তা কোন কোনো বাধ্যবাধকতা না, ‘সমঝোতা স্মারক”। এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশ যতটুকু প্রয়োজন মনে করবে ততটুকুই ব্যবহার করবে।এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশ কোনো অস্ত্র কিনবে না। অস্ত্র ছাড়াও আরো অনেক কিছু যেমন, গরহব চৎড়ঃবপঃবফ ঠবযরপষবং, টঘ ঠবযরপষবং, ঈড়ঁহঃবৎ ঊীঢ়ষড়ংরাব উবারপবং, ঈড়সঢ়ঁঃবৎরুবফ চধপশধমবং ভড়ৎ ংরসঁষধঃরড়হ ইত্যাদি যেগুলো আমাদের টঘ সরংংরড়হ এবং অভ্যন্তরীন জঙ্গী মোকাবেলায় দরকার হবে। এগুলো আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে এমনিও কিনি।
জন্মের পর থেকেইতো শুনছি, বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ নাই। এটা ভারতে এটা চিনের। কেউ কেউতো বলেন এইটা নাকি ১৯৭১ সালেই ভারতের অধিকারে চলে গেছে। প্রশ্ন হলো ১৯৭১ সালেই যদি দেশ ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে যায় তাহলে আবার বারবার কেন দেশ বিক্রি করতে হবে। এক মুরগি কয় বার জবাই হয় বুঝি না। দেশ যদি ভারত ১৯৭১ এ কিনেই থাকে তা হলে এভাবে বারবার দেশ কিনছে কেন? এমন প্রশ্নই কি বারবার ঘুরেফিরে সামনে এসে না। দেশ ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে গেলে কিভাবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে আমাদের বিশ্ববাসির কাছে মর্যাদা পাই?
লেখক- মীর আব্দুল আলীম
সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

সাম্প্রতিক