এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
একসময় গাড়ীর পেছনে নম্বর প্লেট দেখে বোঝা যেত, কোনটা সরকারী গাড়ী, আবার কোনটা প্রাইভেট গাড়ী। সরকারী কার, জীপ, মাইক্রো এমনকি সরকারী পরিবহন ট্রাকের পেছনেও থাকত লাল নম্বরের প্লেট। কিন্তু এখন লাল নম্বরের প্লেট দেখা না গেলেও প্রতিটি সরকারী গাড়ীর সামনে ষ্টিকার থাকে। গাড়ীটি সরকারী কোন অফিস, দপ্তর, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের তা ষ্পষ্টভাবে লেখা থাকে। আবার সরকারী অনেক গাড়ীতে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিভাগ ও দপ্তরের পরিচয় বিহীন গাড়ীও রাজধানী থেকে শুরু করে বিভাগ ও জেলা শহরগুলোতে চলতে দেখা যায়। সরকারী অফিসে কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আসা যাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সরকারী গাড়ী ও ফুয়েল ব্যবহারেরও একটি নীতিমালা রয়েছে। যা আবার কিছু সরকারী সংস্থা ও কর্মকর্তা বাদে অনেক অফিস, দপ্তর, অধিদপ্তরের জন্য প্রযোজ্য। এ ব্যাপারে কিছুদিন আগে একটি কাগজে সচিবালয় বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গাড়ী ও ফুয়েল ব্যবহারের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় অনেক অফিসের কর্মকর্তার গাড়ী অফিস সময়ের পর পারিবারিকভাবে ব্যবহারের অনিয়ম এবং সরকারী ফুয়েল ব্যবহারের অনিয়মের দৃশ্যপট ভেসে উঠে।
পরিসংখ্যানটিতে সঠিক সংখ্যায় বলা না হলেও শুক্র ও শনিবার সরকারী ছুটির দিন সরকারী গাড়ী ব্যবহারের বিশাল অনিয়ম ফুটে উঠে। তাছাড়া ছুটির দিন ছাড়া অফিস খোলার দিনও অগনিত সরকারী ষ্টিকার লাগানো গাড়ীর দৃশ্যপট, হাট, বাজার, বিপণি বিতাণ, কনফেকশনারী দোকান, গ্রোসারি দোকান, মাছ মাংসের দোকান সহ অন্যান্য কেনাকাটার দোকান ও আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে সরকারী কর্মকর্তার স্ত্রী, পুত্র, পরিজন, আত্মীয় স্বজনদের সরকারী গাড়ী ব্যবহারের দৃশ্যপট চলে আসে। এমনকি গভীর রাতেও এসব গাড়ীর চলাচল অনেকেরই দৃষ্টিতে পড়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এসব গাড়ী অনেক সময় বাসার লাকড়ি আনার কাজেও নাকি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পরিসংখ্যানটি থেকে আরো জানা যায়, এ সমস্ত গাড়ীতে ফুয়েল খরচের হিসেব সরকারী লক বইতে প্রদর্শিত না হলেও, পাম্পের মালিককে সরকারী কোষাগার থেকে ঠিকই ফুয়েল খরচের টাকা পেমেন্ট নাকি দেয়া হয়ে থাকে। যে কারণে পরিসংখ্যানটিতে লক বইয়ে সরকারী ফূয়েলের ও পাম্প থেকে উত্তোলিত
হিসেবের মধ্যে নাকি যথেষ্ট ফাঁক-ফোঁকড় থাকে বলে জানা যায়। এমনিভাবে সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কথা বললেও বাস্তবে এর চিত্রও দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে রয়েছে। রাজধানী, বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় এমন কিছু সরকারী কর্মকর্তাদের বাসভবনে প্রয়োজনের তুলনায় সন্ধ্যা নামতে না নামতেই প্রয়োজনের চেয়ে অধিক হারে লাল নীল বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। এ সমস্ত বিদ্যুতের বিল সরকারী কোষাগার থেকে যেমনি পরিশোধ করতে হয়, তেমনি দেশে বিদ্যুূৎ লোড শেডিংয়ের যে সমস্ত কারণ প্রদর্শিত হয়ে থাকে তাতে এভাবে বিদ্যুৎতের অপচয়ও একটি কারণ বলে জানা যায়। তদোপরি পিডিবি বা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে যারা কর্মরত নীচ থেকে উপর পর্যন্ত কোন কর্মকর্তা, কর্মচারীর বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয় না। যে কারণে তাদের মিটার রিডিংয়ের প্রয়োজন হয়ন। যার ফলে বিদ্যুতের যথেচ্ছা ব্যবহার এমনকি তাদের বাসা থেকে অনিয়মভাবে এক্সটেনশন লাইন বা বাড়তি বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে প্রতিমাসে বিদ্যুৎ বিভাগের একটা শ্রেণী বেশী টাকাও নাকি আয় রোজগার করে থাকে। এতেও বিদ্যুতের উপর বাড়তি চাপ পড়ার কারণেও নাকি লোডশেডিং হয়ে থাকে। যদিও এ ব্যাপারে না গিয়ে যখন তখন বিদ্যুৎতের দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষকে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত হয়রানি করার কথা কারো না জানার কথা নয়।
মোদ্দাকথা সরকারী গাড়ী, ফুয়েলের অপব্যবহার এবং বিদ্যুৎতের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কারো কাম্য হতে পারে না। এ সমস্ত ব্যাপারে চোখ, কান খোলা রেখে অনেক সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী জীবন জীবিকা নির্বাহ করলেও সংখ্যানুপাতে তাদের সংখ্যা খুবই কম (uncountable) যা পরিসংখ্যানটিতে দৃশ্যমান না হলেও তাদেরকে সাধুবাদ জানাতে দ্বিধা সংকোচ না থাকারই কথা। এ নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে দুটি উদাহরণ তুলে না ধরলেই নয়। প্রথমটি হল, এক সময় দুর্র্নীতি দমন ব্যুরোতে যারা চাকরি করতো অফিসের ছোট কর্মচারী থেকে অফিসের অনেক বড় কর্মকর্তা পর্যন্ত নিজেদেরকে তুলসীপাতা ধোয়া বলে মনে করতো। অপরদিকে অন্য সব অফিসের লোকদিগকে দুর্নীতিবাজ ও অসৎ বলে মনে করে অনেক সময় এমনিতেই হয়রানী করতে কুন্ঠাবোধ করতনা। যে কারণে অন্যান্য অফিসের লোকজন দুর্নীতি ব্যুরোর উপজেলা, থানা, জেলা, বিভাগ ও সদর দপ্তরের লোকদের খুবই সমীহ করে চলতে ফিরতে লক্ষ্য করা যেত। যদিও দেশের জেলা, বিভাগ, রাজধানীতে বড় বড় ফ্ল্যাট, বাড়ী, বড় বড় নামী দামী মার্কেটের ব্যবসা বাণিজ্যের হাল হকিকত নিলে হয়তো জানা যাবে, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর পিয়ন, চাপরাশি থেকে শুরু করে বড় সাহেবদের কয়টা ফ্ল্যাট, প্রতিষ্ঠান, কয়টা বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠান আর অন্যদেরই বা কয়টা। এমন উদাহরণ শুধু শহর বন্দরেই নয় যারা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এলাকায় চলে এসেছেন চাকরির তুলনায় এদের সম্পদের পাহাড়ের ব্যাপারেও কারো দৃষ্টি ও দৃশ্যপটকে অন্যদিকে ফাঁকি দেয়ার সুযোগও পরাহত। যদিও বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এ ব্যাপারে দড়ি কষে ধরেছেন বলে অনেকেই মনে করে থাকে। যার ফলে দুদকের অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে রেহাই না দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত এবং যথাযথ আইনের মাধ্যমে বিচারের জন্য সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগে অনেককে জেলে পাঠিয়েছেন। আমাদের দেশে যদিও আউট গোয়িং গভর্নমেন্টের ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ দুর্নীতি মামলা হয়, তবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতি নির্মূল কমিশন (কেপিকে) ২০০৪-২০০৯ এই পাঁচ বছরে যাদের দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করেছে, বিচার প্রক্রিয়া ও অভিযোগ প্রমাণ করেছে তাদের মধ্যে ৪৫ জন এম.পি, ৪ জন মন্ত্রী, ৪ জন প্রাদেশিক গভর্ণর, ১ জন গভর্ণর, ৩ জন বিচারক, ৪ জন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণর, ২৭ জন মেয়র, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের ৩ জন প্রসিকিউর, দূত ও কাউন্সেলর জেনারেল এবং একজন পুলিশ প্রধান। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সরকারের এমন নজিরতো বলতে গেলে কোন সরকারের সময়েই চোখে পড়ে না।
একটি পরিসংখ্যানের প্রেক্ষাপটে অপব্যবহার সম্পর্কে এ নিবন্ধে বলা হলেও জানামতে ২৫/৩০ বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারী কর্মকর্তার গাড়ী ও ফুয়েলের ব্যবহার সম্পর্কে একটি উদাহরণ তুলে ধরা হল। যদিও এ ধরণের আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে। ১৯৮৬ সালের কথা সেই সময় ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (Regional controller of food) ছিলেন জনাব মোঃ ইসহাক। তাহার অফিস ছিল শান্তিনগরে। বিশিষ্ট একজন স্বনামধন্য সাংবাদিকের পরিচয়সূত্রে প্রায় সময় তাহার কাছে যাওয়া আসা হত। কিন্তু দেখা যেত, অফিসের গাড়ী থেকে নেমেই প্রথমেই চিমটা দিয়ে গাড়ীর ফুয়েল মেপে নোট করে রাখতেন এবং বাসায় পৌঁছে নাকি তিনি একইভাবে ফুয়েল মেপে নোট করে গাড়িটি সোজাসোজি সরকারী পোলে পাঠিয়ে দিতেন। এই গাড়ী কোন অবস্থাতেই তিনি যেমন তার স্ত্রী পুত্র পরিজনকে ব্যবহার করতে দিতেন না তেমনি জানা যায়, তার স্ত্রী, পুত্র, পরিজন সরকারী গাড়ী ব্যবহার করার চিন্তাও নাকি কোনদিন করেনি।
দেশের মানুষ মনে করে থাকে জনগণের শ্রম ও ট্যাক্সের টাকার মাধ্যমে কেনা সরকারী গাড়ী, সরকারী ফুয়েলের ব্যবহার এবং বিদ্যুতের অপব্যবহারের হাত থেকে নিজেকে সামলিয়ে যদি এগুলোর ব্যবহারে সরকারী প্রবিধান (নির্দেশনা) অনুসারে নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়, ততই দেশ, জাতি, জনগণ ও সরকারের জন্য হিত কর। এমনিভাবে বছরের পর বছর কোন দেশে এ প্রথা অনিয়মেরই সামিল। যদিও প্রতিবেশী ভারতে সরকারীভাবে অফিস আদালতে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট স্বাধীনতার পর থেকে এখনও কঠোরভাবে সরকারী গাড়ী ব্যবহার, ফুয়েল ও বিদ্যুৎ ব্যবহারের নীতিমালা মেনে চলা হচ্ছে বলেই সে দেশটি আজ উন্নত। তদোপরি সে দেশে আয়ের চেয়ে ব্যয়েরও একটি নীতিমালা রয়েছে। কেউ ইচ্ছে করলেই আয়ের সাথে ব্যয়ের সংগতি প্রদর্শন না করে কোনভাবেই যেমন গাড়ী, বাড়ী, ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ নেই, তেমনিভাবে সংগতি বিহীনভাবে নামী দামী সিগারেট ও বাজার থেকে একটি বড় মাছ কিনে নেয়ারও সুযোগ নেই। এ ধরণের কোন ব্যতিক্রম হলেই সরকারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও জনগণকে পুংখানুপুংখভাবে এর জবাবদিহী করতে হয়। তদোপরি সে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ সচেতনতা ও প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় বলে সরকারের নীতিমালার বাইরে হয়তো এ কাজটি করতে কেহ সাহস পায়না।
যতদিন পর্যন্ত নিজ থেকে নিজের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের দিকপালদের মধ্যে অনুশোচনা আসবে, ততদিন পর্যন্ত সরকারী গাড়ী, সরকারী ফুয়েল ও বিদ্যুৎতের অপব্যবহার খোদ দেশের মানুষের মুক্তি পাওয়াতো দুরের কথা বরং তা বেড়ে চলবে বলেই অনেকেরই ধারণা। এসব থেকে উত্তরনের লক্ষ্যে সরকারী কর্মকর্তাদের নিয়মনীতি, আদর্শ ও সরকারী নীতিমালার নিরিখে ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে নিজে নিজেই সরে আসা উত্তম ব্যবস্থা বলে দেশের সচেতন শ্রেণী পেশার মানুষের অভিমত। তাই লর্ড অ্যাকটন বলেছেন, "Power corrupts and absolute power corrupts absolutely" অর্থাৎ ক্ষমতার সাথে দুর্নীতির সম্পর্ক এবং চরম ক্ষমতা ব্যাপকভাবে দুর্নীতির বিস্তার ঘটায়। তাছাড়া এসবের জন্য জবাবদিহীতার অভাবকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই বলেও সরকার পরিচালনাধীন বিশ্লেষকদের মন্তব্য।
(এ.কে.এম শামছুল হক রেনু)
লেখক কলামিষ্ট
< Prev | Next > |
---|