মোমিন মেহেদী
তিস্তা পাইনি, পাইনি নতুন অঙ্গীকারের দেখা
সকল কথাই মনের ভেতর কষ্টে আছে লেখা
খই ফোটানো স্বপ্নগুলো লোভের টানে পড়ে
মৃত্যু মুখেও হাজার ব্যাথায় আবার সাহস গড়ে
ঠিক এভাবে আর কতকাল চলবে বলো দেশটা
আমরা সবাই দেখবো ভাবি কষ্ট-দুখের শেষটা...
এভাবে বিনয়ের কাব্যেচ্চারণ ব্যতিত আর কিছুই যেন নেই নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কাছে। আছে কেবল সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে শনির হাওরের এই বাঁধটি পানির প্রবল তোড়ে ভেঙে যাওয়ার দু:সংবাদ; আছে, তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত-এর মত জঘণ্য শিরোনাম। কিন্তু কেন? কারণ একটাই- এই দেশে সততার রাস্তায় এগিয়ে চলা মানুষের সংখ্যা আর আগের মত নেই। আছে ক্ষমতায় থাকার আর আসার চিন্তায় মশগুল কিছু হায়ে না। যারা চায় না দেশ বা দেশের মানুষের সুখ; তাদের কাছে মূখ্য কেবলই কষ্টময় অন্ধকারের ঘণঘটা। অবশ্য সেই সাথে তাদেরও দোষ আছে, যারা রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করছে ছাত্র শিবির-জামায়াত-জঙ্গী-যুদ্ধাপরাধীদেরকে সাথে নিয়ে। এরই মধ্যে আবার রাঘব বোয়ালদের বিভিন্ন রকম মন খারাপ করার মত কর্মকান্ড আমাদেরকে ক্রমশ সহায় সম্বলহীন করে দিচ্ছে। অবৈধ জমিতে গড়ে উঠছে মসজিদের ভবন, সেই ভবনে অবৈধ অর্থ নিয়ে লাগানো হচ্ছে এসি। আর তার-ই সাথে পত্রিকায় পড়তে হচ্ছে- প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে জয় হল না। টানা ২৪ দিন তাহিরপুরসহ তিন উপজেলার ৪০ গ্রামের হাজার হাজার মানুষ এ যুদ্ধে হেরে গেছেন। শনিবার মধ্য রাতে সুনামগঞ্জের শনির হাওরের বাঁধ ভাঙার মধ্য দিয়েই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। কথায় আছে- ‘আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর।’ হয়তো তাই হচ্ছে এখন। অন্যায়ের রাস্তায় অগ্রসর হওয়ায় আমাদের উপর, এই দেশ ও জাতির উপর নেমে আসছে সীমাহীন নির্মমতর কষ্ট।
কষ্ট আর বেদনার রাতে তৈরি হচ্ছে সর্বনাশের শরীর। যে কারনে সর্বশেষ হাওরটির সঙ্গে তলিয়ে যায় ২২ হাজার একর জমির আধাপাকা ধান। বাঁধ ভাঙার খবরে এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সব হারানো কৃষককের হাহাকারে হাওর পাড়ে সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। ফলে ভারি হয়ে উঠে এলাকার পরিবেশ। এ অবস্থায়ও কৃষকরা তাদের ক্ষতির জন্য দায়ী করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারদের। একদিকে দুর্নীতি, অন্যদিকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষে থাকা জাদুকাটা নদী। টাঙ্গুয়ার হাওর হয়ে পাটলাই নদের সংযোগ নদ তাহিরপুরের বৌলাই। পাহাড়ি ঢল নামলে এ নদী উপচে বিভিন্ন হাওরে পানি ঢোকে। শনির হাওরের ফসল রক্ষায় উত্তর দিকের বৌলাই নদীর তীর ঘেঁষা অংশ ফসল রক্ষা বাঁধ। এ বৌলাই নদীর তীর ভেঙেই লালুর গোয়ালার বাঁধ আর ভোরের দিকে সাহেব নগর বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢোকে শনির হাওরে। পানির স্রোত বেশি থাকায় তা সামাল দেয়ার সাহসও করেননি কৃষকরা। পানি ঢুকে ডোবে হাওরের প্রায় ৬০ শতাংশ। অথচ বাঁধ রক্ষায় সুনামগঞ্জের তাহিরপুরসহ তিন উপজেলার সহস্রাধিক কৃষক ২৯ মার্চ থেকে দিন-রাত কাজ শুরু করেন। তারা শনির হাওরের বাঁধ সংস্কারের পাশাপাশি মাটি ও বাঁশ দিয়ে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শনিবার মধ্য রাতে তীব্র বেগে পানি ঢুকে চোখের পলকে সব ভেঙে নিয়ে যায়। তলিয়ে যায় জেলার সর্বশেষ হাওরটি। সেই সঙ্গে ডুবে যায় পুরো সুনামগঞ্জবাসীর স্বপ্নও। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর পেয়ে শত শত কৃষক ভোর রাতেই কাঁচা-পাকা ধান কাটা শুরু করেন। এ সময় কৃষকের চোখের পানি আর হাওরের জলরাশি একাকার হয়ে যায়। কিন্তু তা তো হবার কথা ছিলো না; কথা ছিলো কৃষকের মুখে হাসি থাকবে, ভালোবাসার স্বপ্নজ জীবনের হাতছানি থাকবে। কিছুই নেই; সব শেষ হয়ে গেছে, ছন্দ নেই, তাল নেই। আছে কেবল ছন্দপতন আর নিরব কান্নার রাত।
আমার জানা মতে, এই অশনি সংকেতে তৈরি হওয়া শনির হাওরে আগে কখনও শনি লাগেনি। ১৯৭৭, ১৯৯৩ ও ২০১০ সালে সারা জেলায় ফসলহানি ঘটলেও শনির হাওর ছিল অক্ষত। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতার কারণে টানা ২ বছর ফসল তলিয়ে যাওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। অবশ্য, স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হতে দেখে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার রাজিনপুর গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করেছিলাম হাওর বাঁচানোর জন্য। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতির কারণে সময়মতো বাঁধে কাজ না হওয়ায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি। গত বোরো মৌসুমেও শনির হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে আধাপাকা ধান তলিয়ে যায়। টানা দুই বছর ফসলহানির কারণে দিশেহারা কৃষক। আহাজারিতে হাওরপারের গ্রামগুলোর বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বিগত বছরের ক্ষতি ও চলতি বছরের জীবিকার তাগিদে নতুন উদ্যম নিয়ে হাওরে ধান বুনেছিলেন কৃষকরা। কিন্তু শনির হাওরের শনির দশা না কাটায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে হাজার হাজার কৃষক পরিবার। প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর আয়তনের এ শনির হাওর। তাহিরপুর ছাড়াও জামালগঞ্জ ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষকদেরও জমি রয়েছে এখানে। আয়তনের দিক থেকে জেলার ৪২টি বড় হাওরের মধ্যে এটি দ্বিতীয়। হাওরটিতে ২২ হাজার একর জমিতে আবাদ হয়েছে বোরো ধান। তিন উপজেলার ৪৮টি গ্রামের মানুষ বছরের একটি মাত্র ফসল বোরো ধান আবাদ করেন এ হাওরে। ২ কোটি ২৯ লাখ টাকায় ৪ ঠিকাদার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ পেয়েছিল হাওরটি রক্ষায়। কিন্তু তারা কোনো কাজই করেনি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর এই এলাকার স্থানিয় জনগন অবশ্য গত কয়েক দিন ধরেই এলাকার মানুষ হাওরটি রক্ষায় যুদ্ধ করেছে। কয়েক স্থান থেকে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর আসতে থাকে। খবর পেয়ে এলাকার হাজার হাজার মানুষ যার যা কিছু আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাটি তাহিরপুর গ্রামের সালাম মিয়া বলেছিলেন, ‘শনিবার রাতে ১০টার দিকে লালু গোয়ালা বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটেছেন অনেকেই। তখন কোনো ভাঙার আলামত দেখা যায়নি। এর আধা ঘণ্টা পরই হঠাৎ করেই শুনতে পাই যে বাঁধটি ভেঙে গেছে।’ নদীতে ঢলের পানি বাড়ার পরপরই এ হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে যখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার কিংবা প্রকৌশলীর দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না, ঠিক তখন থেকে এ হাওরের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে উঁচু করতে শুরু করেন স্থানীয় মানুষ। যে কাজটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারের করার কথা, সেটার দায়িত্ব নেন তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল। তরুণ এই উপজেলা চেয়ারম্যানের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এগিয়ে আসেন তিন উপজেলার হাজারও সাধারণ মানুষ। বাঁধ ভাঙার আগমুহূর্ত পর্যন্ত স্বেচ্ছাশ্রমে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন টানা প্রায় ২৪ দিন। কিন্তু হাজারও কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমকে প- করে দিয়ে শনিবার মধ্যরাতে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। আর এরই মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশে সমস্যার নিশান উড়িয়ে কষ্ট- বেদনার চরে হাবুডুবু খাওয়া শুরু বাংলাদেশের মানুষ।
প্রবাদ ছিলো যে, শনির হাওর ধানের ভান্ডার। এ ধানের ভান্ডার তলিয়ে গেল ঠিকাদার ও পিআইসিদের গাফিলতির কারণে।
শুধুমাত্র তারা রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত; তাই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত কাজ না করে ক্ষতির মুখোমুখি করেছে দেশকে, দেশের মানুষকে। অথচ তাহিরপুরের শনির হাওর রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫টি প্যাকেজে বাঁধ নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করে। এতে টাঙ্গাইলের গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ ৪৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় একটি কাজ পায়। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট বাঁধে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে মাত্র ১০ পার্সেন্ট। গত বছরও এই প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে অর্ধেকেরও কম। আর বিল নিয়েছেন ১০ লাখ ৬১ হাজার টাকা। রাজেন কন্সট্রাকশন নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩৬ লাখ টাকায় শনির হাওরে একটি কাজ পায়। এই প্রতিষ্ঠানটির কাজের অগ্রগতি উল্লেখ করা হয় ১০ পার্সেন্ট। গত বছর একই বাঁধে প্রতিষ্ঠানটি সামান্য কাজ করে তুলে নিয়েছে ১৪ লাখ টাকা। সুনামগঞ্জের পার্থ’র মালিকানাধীন এলএন কন্সট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক কোটি ১২ লাখ ৪৪ হাজার টাকায় সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে দুটি বাঁধের কাজ দেয়া হয়। অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি একটিতে ১৫ পার্সেন্ট এবং অপরটিতে ১৫ পার্সেন্ট কাজ করে। গত বছর এই দুটি বাঁধে নামকাওয়াস্তে কাজ করে তুলে নিয়েছে ৩৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ক্ষমতা এমন একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন গলি যে, এই গলিতে যে ঢোকে, সেই-ই অন্যায়ের কারনে হারিয়ে যায়। ১১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৭ টাকা নিয়ে একটি প্রকল্প চেয়ারম্যান তাহিরপুর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন যেভাবে হারিয়ে গেছে দায়িত্বের কথা ভুলে। শুধু কি একটি, অন্য আরেকটি প্রকল্প- ৮ লাখ ৫৪ হাজার ২২৯ টাকার; এই প্রকল্পের চেয়ারম্যান ছিলেন ইউপি সদস্য হোসেন মিয়া। ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮৯ টাকায় আরেকটি প্রকল্পের চেয়ারম্যান ছিলেন ইউপি সদস্য বুলবুল মিয়া। এই প্রকল্পের চেয়ারম্যানগণ জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগনের ক্ষতির সর্বোচ্চ চেষ্টাটি কেন অব্যহত রেখেছে? কারণ তারা রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত; তাদের প্রতিক ছিলো নৌকা। আর যার প্রতিক নৌকা; তার কোন ভয় নেই। ন্যায়-অন্যায়ের রাস্তা বা গলি নিয়ে তারা ভাবে না। তাদের ভাবনা- ক্ষমতা, ক্ষমতা এবং ক্ষমতা।
এই পরিস্থিতিতে তৈরি হতে হবে বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-অর্থনীতি সচেতন নতুন প্রজন্মকে। যারা রাজনীতির নামে অন্যায় নয়; ন্যায়ের নিশান দেখতে চায়। আর তেমনটা চায় বলেই এগিয়ে যেতে যেতে তারা সকল দিকে লক্ষ্য রেখে সমস্যা সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টায় অনবদ্য-অনন্য-নিরন্তর। এই পথে তাদেরকেও আজ খুব প্রয়োজন; যারা রাজনীতির রাজপথে সবার আগে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা। যদি তাই বলেন, তাহলে সেই অনুযায়ী চলেন। কেননা, বঙ্গবন্ধু কৃষকদের জন্য নিরন্তর নিবেদিত ছিলেন। তাঁর মত করে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এগিয়ে আসবেন বলেই আমি বিশ্বাস করি। একই সাথে বিশ্বাস করি যে, জনগনের জন্য ক্ষতিকারক পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তা, স্থানিয় ৫ চেয়ারম্যান, এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান-এর পাশাপাশি সকল লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেবেন, যারা ন্যায়ের নামে অন্যায়ের দোকানদার...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি
< Prev | Next > |
---|