স্টাফ রিপোর্টার: আইনি ফাঁদে আটকে আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ৩৩ হাজার কোটি টাকারও মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। তাতে অর্জিত হচ্ছে না অর্থবছরের শুরুতে নেয়া রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা। ফলে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায়ও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সব মিলিয়ে ৮০৪টি মামলা ও বকেয়া মিলিয়ে আটকে রয়েছে ৩৩ হাজার ৭৯ কোটি টাকার ভ্যাট! এর বাইরে আয়কর ও শুল্ক সংক্রান্ত মামলায় আটকে রয়েছে আরো বিশাল অঙ্কের রাজস্ব। বড় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কাছেই মামলায় আটকে রয়েছে ১৬ হাজার ২৭৬ কোটি টাকার ভ্যাট। তার মধ্যে ২৩৯টি মামলা বর্তমানে হাইকোর্টের রিট জুরিসডিকশনে রয়েছে। তার বাইরে সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়া রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট। ওসব মামলায় এনবিআরের ভ্যাটের পরিমাণ ১০ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। হাইকোর্টের আপিল জুরিসডিকশনে ৪৬ মামলায় দাবিকৃত ভ্যাটের পরিমাণ ১৫৯ কোটি টাকা। তাছাড়া দাবিকৃত ভ্যাটের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ২ হাজার ৫৪ কোটি টাকা আর এনবিআরের আওতাধীন ভ্যাট আপিলাত ট্রাইবু্যুনালে রয়েছে ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। মূলত ওসব প্রতিষ্ঠানের কাছে রাজস্ব দাবি করা হলেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলা করে রাজস্ব আটকে রাখার কৌশল নেয়া হয়। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এনবিআরে কোনো লিগ্যাল উইং নেই। রাজস্ব মামলা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে কিংবা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সঙ্গে সমন্বয় করতে সক্ষম এমন কর্মকর্তাও খুব নগণ্য। ওই কারণে অনেক সময়ই কাক্সিক্ষত ফল আসছে না কিংবা মামলায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এনবিআরের আদেশ স্থগিত করার রায় দিলে এক মাসের মধ্যে সিএমপি (সিভিল মিসিলেনিয়াস পিটিশন) করতে হয়। অনেক সময়ই এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সেটি না করতে পারায় মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। তবে সম্প্রতি ওসব সমস্যা ও জটিলতার বিষয়ে নজর দিয়েছে এনবিআর। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে উচ্চ আদালতে সরকারি আইনজীবীদের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করতে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাছাড়া রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে একাধিক বেঞ্চও গঠন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, আইনি জটিলতায় বিপুল পরিমাণ ভ্যাট আটকে থাকা ৩০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪টি মোবাইল ফোন কোম্পানি রয়েছে। সেগুলো হলো গ্রামীণ ফোন, বাংলালিংক, রবি অজিয়াটা ও সরকারি ফোন সেবাদানকারী কোম্পানি টেলিটক। তাছাড়া রয়েছে সিগারেটের দুটি কোম্পানি। আকিজ গ্রুপের রয়েছে ৪টি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো আকিজ পার্টিক্যাল বোর্ড মিল, আকিজ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং মিল, আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি। তাছাড়া তালিকায় রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট (ওয়েস্টিন হোটেল), ইউনিলিভার বাংলাদেশ, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, ইসলামী ব্যাংক, এসিআই, গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, জনতা ব্যাংক, ট্রান্সকম বেভারেজ, ঢাকা ওয়াসা, পারটেক্স বেভারেজ, প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন, সেভেন সার্কেল বাংলাদেশ, সোনালী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। অতীতে আইনি প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত রায়ের বেশিরভাগই এনবিআরের পক্ষে এসেছে। যে কোনো দাবিনামা জারি করা হলেই কোম্পানিগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় চলে যাচ্ছে। তাতে বকেয়া আদায়ে বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। ফলে কাক্সিক্ষত সময়ে সরকারের ঘরে আসছে না রাজস্ব।
সূত্র আরো জানায়, এনবিআর যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ভ্যাট দাবি করলে তার আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে এনবিআরের আপিলাত ট্রাইব্যুনালে বা উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করতে পারে। উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করার পর আবেদন খারিজ করে এনবিআরে পাঠাতে পারেন। সেক্ষেত্রে এনবিআরের আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হয়। সেজন্য দাবিকৃত অর্থের ১০ শতাংশ পরিশোধ করতে হয়। আপিলাত ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজনীয় শুনানি শেষে রায় দেন। তারপর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ফের উচ্চ আদালতে আপিল করে। এভাবেই গড়িয়ে যায় বছরের পর বছর। আর ওসব মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের সাথে এনবিআরের সমন্বয়ের অভাবও একটি অন্যতম কারণ। কারণ মামলা পরিচালনায় প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন না হওয়া, শুনানির জন্য কার্যতালিকায় উঠানোর ক্ষেত্রে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের কাক্সিক্ষত সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান জানান, মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তার বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমেও বিরোধ নিষ্পত্তিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর বকেয়া আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে আলাপ-আলোচনাও চলছে। তার ফলও মিলতে শুরু করেছে।
Next > |
---|