মাহমুদুল বাসার
পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম ওয়ারিস মীরের ছেলে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর। তার সম্পর্কে সশ্রদ্ধ ধারণা অর্জন করেছিলাম আমার বন্ধু, কবি-সাংবাদিক, কলাম লেখক সোহরাব হাসানের লেখা ‘পাকিস্তান নামা’ বইটি পড়ার সুবাদে। এই বইয়ের ১৪৮ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘বাংলাদেশের পক্ষে হামিদ মীরের জেহাদ।’ সেখানে এক জায়গায় সোহরাব লিখেছেন, ‘ঢাকা ত্যাগের আগে হামিদ মীর এসেছিলেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। ঘরোয়া আলোচনায় তিনি যা বললেন, তাতে এই পাকিস্তানি সাংবাদিকের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সমীহ আরও বেড়ে গেল। এতদিন তিনি পত্রিকায় লিখে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়ার কথাটি বলে আসছিলেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি এটিকে তাঁর ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার পক্ষে একটি প্রস্তাব নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন হামিদ মীর।’ (পাকিস্তান নামা, বিভাস- ২০১৪, পৃ: ১৪৮)।
এই হামিদ মীর সম্পর্কে বাংলাদেশের দৈনিক গুলোতে খবর প্রকাশিত হয়েছে, ‘একাত্তরে বাংলাদেশে দমন-পীড়রনের বিরোধিতায় কলম ধরায় বিদেশি বন্ধু হিসেবে যে সম্মাননা পেয়েছিলেন ওয়ারিস মীর, তা ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তার ছেলে পাকিস্তানি সংবাদিক হামিদ মীর।’ (যায়যায় দিন ২৯/০৪/২০১৭ইং)।
কোন ফিরিয়ে দেবেন? ওই সূত্রটি জানাচ্ছে, ‘বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কের টানা পোড়ানের জ্ন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করে তিনি বলেছেন, বাবার এই সম্মাননাকে এখন তাঁর ধোঁকা বলে মনে হচ্ছে। উনি চাচ্ছেন, বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক একেবারে শেষ হয়ে যাক। ওই অ্যাওয়ার্ড ছিলো ধোঁকা। আমি ধন্যবাদের সাথে বলছি, ওই অ্যাওয়ার্ড আমাদের হাসিনা ওয়াজেদকে ফেরত দেয়া উচিত। আমি এই ধোঁকা ফেরত দিচ্ছি।’
উল্লেখ্য যে, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানো যে ৬৯ জন বিদেশি বন্ধুকে ২০১৩ সালের মার্চ মাসে সম্মাননা দেয়া হয়, তার মধ্যে ওয়ারিস মীর সহ ১৩ জন ছিলেন পাকিস্তানি। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার ভয়াবহতা সচক্ষে দেখতে একদল ছাত্র নিয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক ও সাংবাদিক ওয়ারিস মীর। নির্মমতার চিত্র দেখে ক্ষুদ্ধ এই বাংবাদিক তা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন দৈনিক জং পত্রিকায়। শত্র“ দেশের এসব বন্ধু এবং তাদের প্রতিনিধিদের যাতে ২০১৩ সালে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
পিতার পক্ষে এই সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেছিলেন হামিদ মীর। আমরা তাতে ঢের খুশি হয়েছিলাম। কারণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশেও আনন্দ আছে। কিন্তু এই সম্মাননা ফেরত দেবার ঘোষণা দিয়ে হামিদ মীর বলেছেন, ‘মুসলিম লীগ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো হওয়া উচিত। ২০১৩ সালে আমাদের বলা হয়েছিলো পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো করার জন্য পাকিস্তানের কিছু মুরুব্বীকে বাংলাদেশ সরকার অ্যাওয়ার্ড দেবে। যার মধ্যে আমার বাবাও ছিলেন। ১৯৭১ সালে যারা বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক অপারেশনের বিরোধিতা করেছিলেন তাদের এই অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়।’
হামিদ মীর আলো বলেন, ‘যে সময় ১৩ জন পাকিস্তানি ওই দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন এ কারণে যে শেখ হাসিনা পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নতি করবেন। আমি সেখানে গিয়ে বাবার পক্ষে অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু এরপরে দেখলাম, হাসিনা ওয়াজেদ সম্পর্ক ভালো করার জায়গায় আরও খারাপ করলেন। এখন মনে হচ্ছে যে, তিনি পাকিস্তানিদের যে অ্যাওয়ার্ড দিয়েছিলেন সেটা ধোঁকা ছিলো।’
এতদিন পরে হাসিমদ মীরের এই বক্তব্য আমাদের প্রাণে শেলের মতো বিদ্ধ হয়ে আঘাত দিয়েছে। বক্তব্যটি খুব বিক্ষিপ্ত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত মনে হচ্ছে। ভালো কাজের স্থানে কাল-পাত্র নেই। পাকিস্তানের প্রগতিশীল কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজও আমাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এমন কোনো শর্ত আরোপ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেননি যে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের গায়ে পড়ে পিরিত রাখতে হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে হামিদ মীর যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, যে শব্দ প্রয়োগ করেছেন তা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি যদি সম্মাননা ফেরৎ দেন, দিতে পারেন, এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু তিনি যদি শেখ হাসিনাকে কটূক্তি করে কথা বলেন, অশ্রদ্ধা করেন, তাহলে আমরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করতে পারবো না। তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতাবোধ, শ্রদ্ধাবোধ ফেরত নিতে বাধ্য হবো আমরা। তাকেও বাংলাদেশের প্রতি উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদানকারী পাকিস্তানীদের কাতারে ফেলতে বাধ্য হবো। বাঙালির ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে যেন হামিদ মীর দূর্বলতা না ভাবেন।
বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে যায় নি। বার বার পাকিস্তান বাংলাদেশের অভ্যন্তরিণ ব্যাপারে নাক গলিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত করেছে। এ কথা হামিদ মীর নিশ্চয়ই জানেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গে পাকিস্তানের বক্তব্য, পাকিস্তানি পার্লমেন্টের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য পীড়াদায়ক। অপমান জনক। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় দাবি উঠেছে যে, পাকিস্তানের মতো শত্র“ রাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করতে হবে। কূটনৈতিক সম্পর্কও ছেদ করতে হবে। কিন্তু প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা অতদূর চরম সিদ্ধান্ত নেননি। বলেছেন যে, ‘ঝগড়াও করবো, সম্পর্কও রাখবো।’
শেখ হাসিনার এই কথার তাৎপর্য বোঝার ক্ষমতা পাকিস্তানী শাসকদের নেই, হামিদ মীরের থাকার কথা। পাকিস্তানের মতো একটি তালেবান অধ্যুষিত, সেনাশাসিত এবং বাংলাদেশের বৈরি রাষ্ট্রের সঙ্গে মাথানত করে সম্পর্ক রাখতে যাবো কেন? এসব কী বলেন হামিদ মীর? টাইগার কেন খেক শিয়ালের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে?
ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছে তাতে কী হয়েছে? ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে এই ঢাকার মাটিতে মুসলিম লীগের কবর হয়েছে। হামিদ মীরকে অনুরোধ জানাবো অ্যাওয়ার্ড ফেরৎ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘ধোঁকা’ শব্দটিও প্রত্যাহার করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর কন্যার বেলায় এই শব্দ প্রযোজ্য নয়। এই শব্দ ভূট্টো ও ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানের বেলায় প্রযোজ্য।
মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক, গবেষক।
< Prev | Next > |
---|