এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
motamotতিস্তা চুক্তি আন্তর্জাতিক নদী আইন ও হেলসিংকি নীতিমালার নিরিখে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ন্যায্য ও প্রাণের দাবী। তদোপরি সংবিধানের ২৫৩ অনুচ্ছেদের আলোকে এ সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়। এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বা ভারতের অন্য কোন এলাকার মুখ্যমন্ত্রীর এ বিষয়ে নাক গলানোর তেমন কোন কিছু থাকার কথা নয়। তারপরও তিস্তা যেহেতু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে পতিত হয়েছে, সেহেতু বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রিয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সলা পরামর্শ ও আলোচনা তাদের একান্ত অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ বিষয়ে তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, মমতা ব্যানার্জি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে আলোচনা কালে যে বেরসিক দৃশ্যপট বেড়িয়ে এসেছে তা শুধু বাংলাদেশের জন্য দুঃখজনকই নহে, বরং এ জ্বালা প্রাণে সহে না ও মনে মানেনার মতই। তদোপরি এ জ্বালা ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের ললাটেও কম তকমা ও কালিমার দৃশ্যপটের অবশিষ্ট থাকেনি।

তিস্তার পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। গণতান্ত্রিক ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। কারণ আমরা কারো ভাগে শেয়ার দাবী করছিনা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন রয়েছে কিনা সেটা আমাদের বিচার্য বিষয় নহে। আমাদের অধিকার যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। জানা যায়, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার খড়িগড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনির হাটের সদর পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজার হাট, উলিপুর হয়ে চিলমারিতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারি এ নদীর বাংলাদেশ অংশের ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে আলোচনার দ্বার উন্মোচিত হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুদেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বন্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ, ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর


জন্য সংরক্ষিত রাখার একটি সমঝোতা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোন চুক্তি হয়নি। পরবর্তী সময় ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ বন্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয় মমতার আপত্তি। তারপর ২০১০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং ২০১১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসলে সেই সময় মমতা ব্যানার্জিও এসেছিলেন। তখন তিস্তার চুক্তির ব্যাপারে সবকিছুর খসড়া পাকা পোক্ত হয়। বাংলাদেশের কোন প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। তিস্তার পানি বন্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কারণ সিকিম উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তার পানি প্রবাহ কমে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে পানির চাহিদা বেশী।

মমতা ব্যানার্জি এই পানি চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক নদীর পানি তিনি এককভাবে ব্যবহারের কথা চিন্তাও করতে পারেন না। নয়াদিল্লীতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিস্তা চুক্তির আলোচনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মমতা ব্যানার্জি যে ফর্মূলা দিলেন তা ধোপে টিকেনি। তিনি তোরসা ও জলঢাকা সহ ৪টি ছোট নদীর নাম বললেন, যেখান থেকে পানি নিয়ে বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ করা যায়। বাংলাদেশে তোরসা এবং জলঢাকা, দুধ কুমার ও ধরলা নামে পরিচিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মমতার এ বক্তব্যতো স্পষ্টতঃ ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পেরই নামান্তর। তারও আগে মমতা ঢাকায় এসে অভিযোগ করেছিলেন, বাংলাদেশ নাকি আত্রাই নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। মমতার এসব কথা ও কথার ভাবার্থ এ দেশের মানুষের পোড়া গায়ে লেবুর ছিটা। যে জ্বালা প্রাণে সহেনা ও মনে মানে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবার ভারত সফরে গিয়ে হয়তোবা তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আগেভাগেই মমতার ভাবটা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। আনন্দ বাজারে খবর থেকে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন ০৭/০৪/১৭ ইং শনিবার নয়াদিল্লীর হায়দরাবাদ হাউজে মধ্যাহ্ন ভোজের সময় মমতা শেখ হাসিনাকে আপনি বলে সম্বোধন করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সম্পর্কটা আগে থেকেই আনুষ্ঠানিক। যার ফলে তারা আগ থেকেই একে অপরকে বরাবরই “তুমি” বলে সম্মোধন করে আসছিলেন। কিন্তু ভারত সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সাক্ষাৎ পর্বে মমতা ব্যানার্জি তুমি থেকে বারবার আপনি সম্বোধন করলে এ ডাকটা খানিকটা করে হলেও অবাক করে দেয় শেখ হাসিনাকে। তাইতো মমতাকে তিনি বলেন, “আগে না তুমি বলতে, এখন আপনি কেন? তারপর ঐদিনই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশভোজে খেতে খেতেই কথা হয় শেখ হাসিনা ও মমতার। সেখানেও শেখ হাসিনা মমতাকে আবারো বলেন, মধ্যাহ্ন ভোজের সময় তুমি আবার আমাকে আপনি বলতে শুরু করলে কবে থেকে? তুমি বলে ডেকে যাওয়া মমতা জবাব দেন, ভাবছিলাম সকলের সামনে তুমি বলব? আরো জানা যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন দিল্লীর রাষ্ট্রপতির ভবনে নিজ হাতে ভাপা ইলিশ রেঁধেছিলেন। নজির বিহীন এই আতিথেয়তায় সাক্ষী হয়ে রয়ে গেল ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন। এ জন্য তিনি দেশ থেকে ৬ জন রাঁধুনি সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিন রকম ইলিশের পদ রান্না করেছিলেন। শুধু ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীই নহেন, মমতার জন্যও রেঁধে ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে মমতা রাতের খাবার এত তাড়াতাড়ি খাননা বলে, মমতা শুধু মুড়ি ও বাতাসা খেয়েই ফিরে যান। সেই সময় মমতার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উপহার হিসেবে নিয়েছিলেন ঢাকাই জামদানী শাড়ী। অপরদিকে ঐদিন রাতের নৈশ ভোজের আগে মমতাও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টি ঘর রাধামন মল্লিকের মিষ্টি ও নকশী করা শাল উপহার দেয়ার কথা তথ্য সূত্রে জানা যায়।

একটি উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে ফিরে তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে নাকি বলেছেন, দিদি কি সাত বাত হুয়ি। পানি মাঙ্গা, মাগার ইলেকট্রিসিটিতো তো মিলা। কুছতো মিল গ্যায়া। এমনিভাবে তিস্তা চুক্তি বাদে প্রতিরক্ষা চুক্তিসহ ২২টি চুক্তি হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে এ নিবন্ধে একটি গল্পের সারাংশের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হল। জনৈক রাজ পল্লবের মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় একই এলাকার পল্লবের ছেলের। দুজনে বিবাহের আগ থেকেই গভীর সম্পর্কে সম্পর্কিত। যারা এলাকার বাল্য বন্ধু হিসেবে পরিচিত। যে সম্পর্কের দৃষ্টান্ত বিরল। যেমন কাঁঠালের আটা ও জিঘার কষের মতো

সম্পর্ক। একজন আরেকজন ছাড়া বাঁচবে না এমন অবস্থা। তাছাড়া একজনের মেয়ের সাথে আরেক জনের ছেলের বিয়ে শাদীর পর দুই বেওয়াইয়ের সম্পর্ক কাঁঠাল ও জিগার কষ ছাড়িয়ে যায়। একদিন ছেলের বাবা বাজারে কলা বেচতে গেলে ছেলের শ্বশুর কলা কিনতে যায়। তা দেখে ছেলের বাবা বেওয়াইকে বললো, বেওয়াই সাহেব যত কথাই বলুন না কেন, আমার কলার হালির দাম চার আনা। আজ মমতা ব্যানার্জির হাল হকিকত, ধরণ ধারণ দেখে দুই বেওয়াইয়ের কলা বেচা এবং কলা কেনার কথা ঘুরে ফিরে বার বার মনে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে যত সম্পর্কই থাকুক না কেন, যত ভাপা ইলিশ, ঢাকার জামদানী, কলকাতার মিষ্টি এবং শাল দেয়া হোক না কেন, মমতার কলার হালি চার আনা।

এ দেশের মানুষ যেমন আজো হুগলীর নিকট গঙ্গা নদীর ওপর মরণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর ওপর বাঁধ ও উজানে গ্রোয়েন নির্মাণ মেনে নেয়নি, তেমনি যত চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও চমকই হোক না কেন, এ দেশের ১৬ কোটি মানুষ পানির ন্যায্য হিস্যা ও ন্যায় সংগতভাবে তিস্তা নদীর পানি না পাওয়া পর্যন্ত এর পিছু ছাড়বেনা। তিস্তা, গঙ্গা ও ৫৪টি নদীর পানি আমাদের ন্যায্য দাবী ও অধিকার। যতদিন না এর পরিসমাপ্তি ঘটবে, বন্ধুত্বের সূত্রে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ২২টি নয়, শত রকমের চুক্তি হলেও, প্রাণের দাবী তিস্তা, গঙ্গা ও ৫৪টি নদীর ন্যায়সঙ্গত চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত এমনকি এর দিকে বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা না করে বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর মীমাংসার ব্যাপারে দ্বারস্থ হতে বাধ্য হবে। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মওলানা ভাসানী মরণ ফাঁদ ফারাক্কার বিরুদ্ধে লং মার্চ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট হাইস্কুলের জনসভায় বলেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করে লাভ নেই। যার ফলাফল সময়ের কালক্ষেপন ও বিগজিয়ো। এবার বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের স্মরণাপন্ন হতে হবে। ফারাক্কা লং মার্চের পর তিনি বেশী দিন বেঁচে থাকেননি। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তা হলে হয়তো বা মরণ ফাঁদ ফারাক্কা নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের মাধ্যমে একটা জায়গায় চলে যেতেন।

পরিশেষে বলব, প্রধানমন্ত্রীর ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ৪ দিন ভারত সফর কালে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে এর আগে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ২০১০ ও ২০১১ সালে তিস্তা নিয়ে যে আলোচনা হয়েছিল, সেই চুক্তির খসড়াতো দুই সরকারের কাছেই আছে। যদি মমতা ব্যানার্জি বারবার এমনিই করেন এবং কলার হালি চার আনাই মনে করেন তবে সংবিধানের ২৫৩ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট তিস্তা চুক্তির ট্রাম্প কার্ড তো রয়েছেই। মমতার এ দৃশ্যপট থেকে ভারতের অনেক নেতা যেমন ধিক্কার দিয়েছে তেমনি বাংলদেশের মানুষের নিকট মমতার এ দৃশ্যপট যেমনি কেহ মেনে নিতে পারেনি, তেমনি এ জ্বালা কারো প্রাণে সহেনা, মনে মানে না। কারণ তিস্তা, ৫৪টি অভিন্ন নদী ও গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের মানুষের মরা বাঁচার ও প্রাণের দাবী। তারপরও মমতা ব্যানার্জি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দিকভ্রান্ত সা-রে-গা-মা গেয়েই চলছেন।

এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট

সাম্প্রতিক