এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
১৪ বছরের টগবগে চেহারার নাদুস নুদুস তরুণ বয়সের তাহের যেমনি কোন রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক পরিসরের কেহ ছিল না তেমনি ছিল না কোন উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও সচল পরিবারের সন্তান। তাহের ছিল অজ পাড়াগাঁয়ের পাকুন্দিয়া থানাধীন চরপলাশ হাইস্কুল সংলগ্ন দক্ষিণ পাড়ার মৃত দিনমজুর আব্দুর রহমানের কনিষ্ট সন্তান। অভাব অনটনের কারণে তার পিতামাতা তাকে প্রাথমিক স্কুলেও পড়াতে পারেনি। সে দিনমজুরের কাজ করে যা আয় রোজগার করতো, তা দিয়ে তার অভাবী পরিবারের সংসার চালাতে সহযোগিতা করতো। তাহের কোন ধরণের খারাপ চরিত্রের ছেলে ছিল না। তাহের ছিল অন্যান্য তরুণ, চঞ্চল ও বন্ধুবৎসল ছেলেদের মতই একজন। এ বয়সে তারুণ্যের হাওয়া সবেমাত্র তাকে স্পর্শ করেছিল। পাড়া পরশী ও সমবয়সীদের সাথে সে দাড়িয়াবান্ধা, বোঁ বোঁ, হা-ডু-ডু, কানামাছি খেলাধূলোতে প্রায় সময় যেমনি অংশ নিত তেমনি বাড়ীর পাশেই চরপলাশ হাইস্কুল থাকাতে সেখানেও অবসর সময়ে স্কুলের সমবয়সী শিক্ষার্থীদের সাথে প্রায় সময় ফুটবল খেলাতেও অংশগ্রহণ করতো।
নিয়তির বিধান ১৯৭৪ সালের ২০ এপ্রিল তাহেরকে নির্মমভাবে চরপলাশ হাইস্কুলের সামনে দিন দুপুরে নির্মমভাবে প্রকাশ্যে লাঠিপেটা করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। শত কাকুতি মিনতি করেও পাষন্ড হত্যাকারীদের হাত থেকে তাহের রক্ষা পায়নি। যে হত্যা রহস্য আজো অনোদঘাটিত। তার বৃদ্ধ অসহায় দিনমজুর পিতা ও পরিবারের অন্য কেহই পাষন্ডদের ভয়ে থানায় বা কোর্টে মামলাও রুজু করেনি। এমনকি তাদের ভয়ে পোস্ট মর্টেম পর্যন্ত হয়নি। জানা যায়, সেই দিন লাঠিসোটা নিয়ে আসা কিছু দুর্ধর্ষ লোক যাকে পেয়েছে তাকেই পিটিয়ে ছিল। ঐ দিন চরপলাশ সংলগ্ন খলিশাখালীর শাসছুলকেও পিটিয়ে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করা হয়। এসব দেখতে গিয়ে তাহের অন্যান্যদের মতো সেখানে উপস্থিত হয়। তখন এমনিভাবে পিটিয়ে মানুষ মারার প্রতিবাদ করলে তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী লাঠিয়ালরা তাহেরকে মানুষের গাছের আম, জাম খাওয়া ও মিথ্যা এবং অহেতুকভাবে কলা চোর হিসেবে চালিয়ে থাকে। যদিও এর মধ্যে বিন্দু বিসর্গ সত্যতা ছিল না। প্রশ্ন হলো যদি ১৪ বছরের টগবগে সম্ভাবনাময় দিনমজুর তরুণ তাহের আম, জাম ও কলা চুরি করেই থাকে, তারপরও এই সামান্য কারণে তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করারই কি থাকতে পারে। যা আইন আদালতের দৃষ্টিতে গহির্ত কাজ। যা হত্যা ও চরম
অপরাধেরই নামান্তর। ১৪ বছরের সন্তান তাহেরের কথা চিন্তা করে তার পিতা দিনমজুর আব্দুর রহমান ও মাতাও কিছু দিনপর মারা যায়। এই দিনটি সমাগত হলেই প্রতিবছর তাহেরের আত্মীয় স্বজন ও বেঁচে থাকা ভাই বোন আজো বিলাপ করে তাহেরের রেখে যাওয়া রক্তমাখা জামা লুঙ্গি নিয়ে দেখে ব্যথা, বেদনা যতটুকু সম্ভব নিবারণ করে থাকে। আমার বাড়ী থেকে তাহেরের বাড়ী আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আমি তাদেরকে যতটুকু চিনি তার চেয়ে বেশী চিনে থাকে আমার প্রতিবেশী লোকজন সহ আমাদের বাড়ীর অনেকেই আমার আব্বা-আম্মা যতদিন জীবিত ছিলেন, প্রায় সময়ই তাহেরের অকাল ও নৃশংসভাবে মৃত্যুর কথা বলে খুবই আক্ষোপ করতেন। যে কারণে এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ এলেই আমার মাঝেও তাহেরের অমানবিক, নিষ্ঠুর ও নৃশংস হত্যার কথা রেখাপাত করে থাকে। তার মাগফেরাতের জন্য যেমনিভাবে শাহেন শাহে আলম আল্লাহর দরবারে দোয়া কালাম পড়ে থাকি, তেমনিভাবে এই দিনটির স্মরণে প্রতিবছর পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করে তাকে স্মরণ করে থাকি। তাহেরের নৃশংস ও অমানবিক হত্যার কথা লেখতে গিয়ে কলমের আঁচড়ে ভেসে ওঠে ১৯৭৪ সালের অসংখ্যা নিষ্ঠুরতার বাস্তব কাহিনী।
সেই সময় আলতাফ মাষ্টার ও সিরাজ খলীফার ছত্রছায়ায় একটি লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে ওঠে। এই বাহিনী সেই সময় কিশোরগঞ্জ ও পাকুন্দিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছত্রাকের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। কিশোরগঞ্জ শহরের গাইটাল কিশোরগঞ্জ সদর থানার (বর্তমান উপজেলা) বগাদিয়া, করমুলী, মারিয়া, বুড়–ংগার চর, মোল্লাপাড়া, বিন্নাটি, কালটিয়া থেকে শুরু করে পাকুন্দিয়া থানার সুখিয়া, চরপলাশ, কুশাকান্দা, বিরামদী, হাফানিয়া, হোসেন্দী, আঙ্গিয়াদী এ সমস্ত এলাকায় একশ্রেণীর লোককে সন্দেহ চোর মনে করে তাদের লাঠিয়াল বাহিনী প্রকাশ্যে দিন দুপুরে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে লাটিপেটা এবং কাটের তক্তা চাপা দিয়ে লোমহর্ষকভাবে হত্যা করা হত। তদোপরি মারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় এবং পাকুন্দিয়া বাজারের তৎকালীন মেনু মিয়ার চা ষ্টলের সাথে কুয়ারপাড়ে অফিস করে তাদের নেতৃত্বে ও ছত্রছায়ায় লোকদেরকে লাঠিয়াল বাহিনী হাজির করলে তাদের রায়ের মাধ্যমে কাহাকেও প্রকাশ্যে শাস্তি এবং কাহাকেও লাটিপেটা করে প্রকাশ্যে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হতো। যারা হত্যা করতো তাদের মাথার কালো টুপিতে লেখা থাকতো “আমি জল্লাদ”। যেভাবে কোর্টের মাধ্যমে জেল জরিমানা এবং ফাঁসির আদেশ তামিল করা হয়ে থাকে, তেমনিভাবে তাদের অঘোষিত কোর্টের রায় অনুসারে এমনিভাবেই বিচার কার্য পরিচালনা করা হত। কোর্টের মামলা মোকদ্দমার ব্যাপারে সুপিরিয়র কোর্টে আপীলের সুযোগ থাকলেও তাদের মনগড়া, অসাংবিধানিক ও স্বঘোষিত কোর্টে আপীলের কোন সুযোগ ছিল না।
সূত্রে জানা যায়, যারা টাকা দিতে পেরেছে এর মধ্যে অনেকেই এই অমানুষিক নির্যাতন, বেইজ্জতি ও হত্যার হাত থেকে রেহাইও নাকি পেয়েছে। যে সমস্ত লোকদেরকে হত্যা করা হতো তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল স্বল্প আয়ের মানুষ ও দিন মজুর। তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই টাকা খরচ করে তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার আদৌ কোন সুযোগ ছিল না। তাদের হাতে ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যুই ছিল ধৃত ব্যক্তিদের শাস্তি। ১৪ থেকে ৩০ বছরের তরুণ ও যুবকরাই ছিল এই লাঠিয়াল বাহিনীল মূল টার্গেট। এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মধ্যে ত্রাস ও আতংক সৃষ্টি করা এবং তাদের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব একভাগ্যে মেনে নেয়া। এত কিছুর পরও অজ্ঞাত কারণে ভোক্তভোগীদের ভাই বোন, পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজন দজ্জাল বাহিনীর ভয়ে কোর্ট ও থানায় মামলা করার সাহস পেতনা। যা সভ্য দুনিয়ার মানুষ হিসেবে ভাবতে হিমশিম খাওয়া ছাড়া কোন উপায়ন্তর না থাকারই কথা। এই জঘন্য অভিযানের সাথে থানার লোকদেরও নেপথ্য সহযোগীতা ছিল বলে ভোক্তভোগীদের আইনের দ্বারটিও বন্ধ ছিল বলে সমসাময়িক অনেকের কাছ থেকে জানা যায়। এ ব্যাপারে পরবর্তীসময় নৃশংসভাবে মানুষ হত্যার খবর পেয়ে তদানীন্তন পাট প্রতিমন্ত্রী ও এলাকার জাতীয় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান খান এ ধরণের হত্যাকান্ড বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। সেই সময়ের বয়োবৃদ্ধ লোকদের কাছ থেকে জানা যায়, এই বাহিনী তৎকালীন সময়ে কিশোরগঞ্জ ও পাকুন্দিয়া এলাকার ১০০ থেকে ১৫০ জন লোককে নির্মম, নিষ্টুর, নৃশংস ও বর্বরোচিতভাবে প্রকাশ্যে দিন দুপুরে হত্যা করে থাকে বলে তৎকালীন সময়ের একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়। সেই সময় কিশোরগঞ্জ থেকে পাকুন্দিয়া মির্জাপুর এবং পাকুন্দিয়া থেকে মঠখোলা রাস্তার দুপাশে হতভাগ্যদের লাশ মরা ছাগল, গরু, মহিষের মতো পড়ে থাকতে লক্ষ্য করা য়ায়। যা প্রকাশ্যে শৃগাল, কুকুর ও শকুনে টেনে হেঁছড়ে খাওয়ার সুকরুণ দৃশ্য পথচারীদের চোখকে নিষ্টুরতার চোখের পানিতে আবৃত করে। নিভৃতে অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে অনেকেই গন্তব্যে ফিরে।
যে স্মৃতি তর্পন থেকে আজো সেকালের লোকদের কিশোরগঞ্জ টু পাকুন্দিয়া হয়ে মির্জাপুর এবং পাকুন্দিয়া ভায়া মঠখোলা যাওয়ার পথে অশ্রু সংবরণ করতে খুবই কষ্ট হয়। একটি স্বাধীন দেশে তৎকালীন সময়ে কোন অবস্থাতেই এমন নিষ্টুর, নৃশংস হত্যাকান্ড সংগঠিত হওয়ার কথা ছিল না। যা বর্বর পাকহানাদার বাহিনীর নির্মমতার মতো মানুষের মনে দানা বেঁধেছিল। যা ভুলা যায় না এবং কারো পক্ষেই ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এমনিভাবে দেশে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের উত্থান আজ নতুন করে অতীত ইতিহাসকে ঘুরে ফিরে সামনে নিয়ে আসছে। তবে এর মধ্যে দুটি ধারা দৃশ্যমান, যেটি হল লাটিয়াল বাহিনীর প্রধানরা তাদের জয় ঝংকার প্রতিষ্ঠার জন্যে নীরিহ মানুষকে চোর আখ্যা দিয়ে অহেতুক হত্যা করে মানুষের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করে নিজেদেরকে যেমনি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল তেমনিভাবে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ ইসলামের নামে মিথ্যা বুলি আউড়িয়ে বিদেশী ইহুদী, নাসারাদের মদদে ইসলামের মুল দর্শনকে বাদ দিয়ে হত্যা ও আত্মহত্যার মতো জঘন্যতম পথ বেছে নিয়েছে। যা ইসলাম ধর্মের কোথায়ও নেই। যে পথ গোমরাহীর পথ, যে পথ অন্ধকারের পথ, যে পথ সীমালংঘনকারীর অস্পৃশ্য পথ। যারা এর সাথে জড়িত, ওরা মানুষ নামের নরকীট, দেশ, জাতি ও দেশের মানুষের ঘৃণ্য শত্রু। দুনিয়া সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে যেমনি কোন অত্যাচারী টিকে থাকতে পারেনি, যেমনি তাদের পতন হয়েছে তেমনি ইতিহাসের পাতায় ওরা কলংকের বুঝা হয়ে রয়েছে। কিশোরগঞ্জ ও পাকুন্দিয়ায় নৃশংসভাবে নীরিহ মানুষকে হত্যার নায়ক ও তল্পী বাহকদের মৃত্যুও স্বাভাবিকভাবে হয়নি। জানা যায়, এই লাঠিয়াল বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী দুইজন ও সংশ্লিষ্ট অনেকেই দীর্ঘদিন যাবত শয্যায় থেকে বিনা চিকিৎসায় মরণঘাতি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তাই বলা হয়ে থাকে ংরহহবৎ পধহ হবাবৎ মড় ঁহঢ়ঁহরংযবফ অর্থাৎ দুনিয়া থেকে কোন অত্যাচারী পাপী কখনও শাস্তি ছাড়া বিদায় হয়না।
যেভাবে ১৪ বছরের তাহেরসহ অনেককে লাঠিয়াল বাহিনী হত্যা করেছে এ ধরণের নির্মম নৃশংসতা ও হত্যাকান্ড কারো কাম্য হতে পারেনা। অহেতুকভাবে এসব সম্ভাবনাময় তরুণ যুবকের নিহত হওয়ার কারণে অনেক পরিবার ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে। অনেকেই পুত্র শোকে ও ভাই হারা বেদনায় তিলে তিলে অনুশোচনায় অকালেই অর্ধাহারে অনাহারে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছে। জানা যায় তাদের পরিবারের আজো যারা বেঁচে আছে তাদের দুঃখ, কষ্ট, হাহাকার ও বেদনার শেষ নেই। ১৪ বছরের তাহেরের নৃশংস হত্যার দিন হিসেবে স্মরণীয় ২০ এপ্রিল ১৯৭৪ সালকে আজো ভুলা যায় না। অশ্রু সিক্ত ব্যথিত হৃদয়ে বারবার মনে পড়ে। হে রাব্বুল আল আমীন, হে দয়ালু আল্লাহ, তুমি যা জান কেহই তা জানে না। হে আল্লাহ, তাহের সহ নৃশংসভাবে লাঠিয়াল বাহিনীর হাতে নিহতদের তুমি ক্ষমা করে দাও। তাদের বেঁচে থাকা ভাই বোন, পিতামাতা ও স্বজনদেরকে শান্তি, স্বস্থি দাও। তাদের ব্যথা বেদনা সংবরণ করা ও ধৈর্য ধারনের শক্তি বাড়িয়ে দাও। তুমি দয়ালু, তুমি সুমহান, তুমি রহমানুর রাহিম, তুমি রাব্বুল আল আমীন, তুমিই সর্বশ্রেষ্ট। তাহেরের নৃশংস হত্যা আজো ভুলা যায়না। তদোপরি জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের জঘন্য তকমা থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা কর।
এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট
< Prev | Next > |
---|