pm 28 4স্টাফ রিপোর্টার: পারস্পরিক দোষারোপের পথে না হেঁটে সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে সমঝোতার মাধ্যমে আরও সচতেনতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার এই তিনটা স্তম্ভের মধ্যে একটা সমঝোতা নিয়েই চলতে হবে, কাজ করতে হবে। একটি আরেকটিকে দোষারোপ করে কোনোদিন একটা রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে পারে না। এই বিষয়টায় সকলকে আমি একটু সচেতন থাকার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

শুক্রবার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গতকাল শুক্রবার জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এ কথা বলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সংসদ আইন প্রণয়ন করে, তা প্রয়োগ করে বিচার বিভাগ। আর তা কার্যকর করার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। ক্ষমতা কোনো বিভাগেরই কম নয়। কিন্তু কেউ এককভাবে চলতে পারে না। সবাই মিলে সমঝোতা রেখেই চলতে হয়। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দুই বছর আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে তার কথায় রাষ্ট্রের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে টানাপড়েনের প্রকাশ ঘটেছে। সপ্তাহ দুই আগে প্রধান বিচারপতির উপস্থিতিতেই এক অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের এই দ্বন্দ্বকে ‘অপ্রত্যাশিত’ বলেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। উচ্চ আদালতের বিচারকদের বাসস্থানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এস কে সিনহা বলেছিলেন, একটি মহল সব সময় সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে দূরত্ব তৈরির অপচেষ্টায় লিপ্ত। এরকম ভুল বোঝাবুঝির কারণে সাধারণ জনগণের কাছে ভুল বার্তা চলে যায়। বিচার বিভাগ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাকে পাশ কাটানো হয়েছে বলেও ওই অনুষ্ঠানে অসন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি।

সেদিন সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ক্ষমতা কারও কিন্তু কম নয়। এখন কে কাকে সম্মান করবে, কে কাকে করবে না, কে কার সিন্ধান্ত নাকচ করবে, কে কাকে মানবে, না মানবে; এই দ্বন্দ্বে যদি আমরা যাই, তাহলে একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। এরপর গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতির প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল হয়ে বলব, কোনো দেশে বিচারকাজ ছাড়া মাননীয় প্রধান বিচারপতিরা এত উষ্মা, এত কথা পাবলিকলি বলেন না।

আর শুক্রবারের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ যদি মনে করেন যে, না, ‘এখানে আমার ক্ষমতা, আমিই সবটুকু প্রয়োগ করে ফেলব’ কিন্তু সেই প্রয়োগটা করবে কে? তার জন্য তো কাউকে লাগবে। কাজেই এ কথাটা কেউ যেন ভুলে না যায়, আমি সেটুকুই বলব। দেশের মানুষের অধিকার সুরক্ষিত করার পাশাপাশি বিচার বিভাগের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা অনুষ্ঠানে সবিস্তারে তুলে ধরেন সরকারপ্রধান।

২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরপরই জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ফৌজদারি কার্যবিধির সংস্কার এবং বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার প্রক্রিয়া শুরুর কথা তিনি মনে করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে অধঃস্তন আদালতের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো করা, উচ্চ আদালতের বিচারকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, আবাসনের ব্যবস্থা করা, প্রতিটি জেলায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নতুন ভবন নির্মাণ শুরুর কথা প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যা যা করণীয়, আমরা করে যাচ্ছি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অধঃস্তন আদালতে ৫৮৬ জন বিচারক নিয়োগ দেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আরও ৩৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। নতুন নতুন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পদও সরকার সৃষ্টি করছে। মামলাজট নিরসন ও মামলার দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে সরকার আইনি সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির পাশাপাশি দেওয়ানী কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে। ফৌজদারী কার্যবিধিও সংশোধনের কাজ চলছে। সরকারের অর্থায়নে অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটিতে ৫৪০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করা এবং অধঃস্তন আদালতের দেড় হাজার বিচারকের উচ্চতর প্রশিক্ষনের জন্য ভারতের ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমির সঙ্গে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেন।

তবে শুধু আইন করে আর অবকাঠামো সুবিধা বৃদ্ধি করে বিচারপ্রার্থী মানুষের ভোগান্তি কমানো সম্ভব নয়। আমাদের বিচারক এবং আইনজীবীদের আরও মানবিক এবং জনগণের প্রতি সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে, বলেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিকের আইনগত সহায়তা লাভের অধিকার রয়েছে এবং তার সরকার একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও আধুনিক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি মনে করিয়ে দেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর অসহায়, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত বিচারপ্রার্থী জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সুগম করতে আওয়ামী লীগ সরকার ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন’ করলেও পরের মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে সেই কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল। ওই আইনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থের অভাবে কেউ আইনি সহায়তা পাবে না, বিচার পাবে না; এটা তো হতে পারে না। ১৯৭৫ এ এক ভয়ঙ্কর হত্যাকা-ে পিতাসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হারানো এবং পরবর্তীতে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ প্রণয়নের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা হাসিনা বলেন, “বিচার না পাওয়ার যন্ত্রণাটা যে কী; আমাদের থেকে ভালো কেউ জানে না। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করেন তার মেয়ে।

১৯৬৬ সালের ২৭শে জুলাই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘অত্যাচারেরও একটা সীমা থাকে! আটটা মামলা সমানে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করেছে। একজন লোকেরই এই বুদ্ধি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পিছন দরজার রাজনীতিতে যথেষ্ট’।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রমকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে দেশের সকল জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটি করা হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত আট বছরে এক লাখ ৬৬ হাজার ৩৩৯ জন নারী-পুরুষ শিশুসহ মোট দুই লাখ ৩১ হাজার ৬২৬ জন ব্যক্তিকে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ওই সময়ে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় মোট ৪৬ হাজার ৫৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে গত আট বছরে সুপ্রিম কোর্টে এক হাজার ৬৯৩টি জেল আপিলের নিষ্পত্তি করা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় স্থায়ী ‘লিগ্যাল এইড অফিস’ স্থাপনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে শুধু আইনি সহায়তার কেন্দ্র হিসেবে আমরা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। বিচারপ্রার্থী জনগণের কল্যাণে এটিকে আমরা ‘এডিআর কর্ণার’ বা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে কাজে লাগাতে চাই।

আপস-মীমাংসা বা সমঝোতার মাধ্যমে স্থানীয় বিরোধ নিষ্পত্তিতে লিগ্যাল এইড অফিস কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই লিগ্যাল এইড সার্ভিস নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। পরে পারিবারিক সমস্যা ও তা সমাধানে লিগ্যাল এইড সার্ভিসের কার্যক্রম নিয়ে আইন সচিব রচিত এবং অভিনীত একটি ডকুড্রামা প্রদর্শন করা হয়। অন্যদের মধ্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো.জহিরুল হক এবং লিগ্যাল এইড সার্ভিসের পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।

সাম্প্রতিক