স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকার সাভার উপজেলা থেকে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা নিহত জেএমবি নেতা তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে জানিয়েছে র্যাব।
গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের রাজফুলবাড়িয়ার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি বাস থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে গণমাধ্যমকে জানান র্যাব-৪-এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর আবদুল হাকিম। মেজর আবদুল হাকিমের নেতৃত্বে রাজফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে চেকপোস্ট বসানো হয়।
এ সময় মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী ভিলেজ লাইন পরিবহনের একটি বাসে তল্লাশি চালানো হয়। তিনজনের কাছ থেকে বেশ কিছু বোমা তৈরির সরঞ্জাম, জিহাদি বই, পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়। আটক সদস্যরা হলেন- তামিম দ্বারী, কামরুল হাসান ওরফে কাজল ওরফে নুরুদ্দিন (২৬) ও মোস্তফা মজুমদার ওরফে শিহাব ওরফে হামজা (৩২)। এদের মধ্যে তামিম দ্বারী ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে বলে র্যাব জানিয়েছে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজারের র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান এসব তথ্য জানান। তিনি জানান, ২০০৩ সালে কলেজে পড়া অবস্থায় ইসলাম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন শ্রী গৌরাঙ্গ কুমার ম-ল।
তারপর নাম পাল্টে হয়ে যান তামিম দ্বারী। এরপর প্রথমে তাবলীগ জামায়াত পরে জড়িয়ে পড়েন জঙ্গিবাদে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধর্মান্তরিত হয়ে পর্যায়ক্রমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কথা স্বীকার করেন তামিম। র্যাব জানায়, তামিম নামধারী এ ব্যক্তি নব্য জেএমবির প্রাক্তন নেতা তামিম চৌধুরীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিদেশ থেকে জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেশে আনার চেষ্টা করছিলেন। এজন্য তিনি ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে জাহাজে লোকবল রিক্রুট করার চেষ্টা করছিলেন। নেতৃত্বশূন্য নব্য জেএমবিকে আবার সক্রিয় করে নাশকতার পরিকল্পনা ছিলো তার। তাবলীগ জামায়াতে তামিম দ্বারীর সঙ্গে তানভীর কবির নামের এক যুবকের পরিচয় হয়। তখন তানভির কবিরের বাবা তামিম দ্বারীকে পালক সন্তান হিসেবে নেন।
২০০৫ সালে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তামিম। সেখানে সাত থেকে আট মাস পড়ালেখা করে ২০০৬ সালে চট্টগ্রামের মেরিন একামেডিতে ভর্তি হন। পড়াশোনা শেষে ২০১০ সালে তিনি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের অধীনে চাকরি পান। এরপর ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলার কলিসহ বিভিন্ন জাহাজে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। সেখানে তার অ্যাকাডেমিক জুনিয়র আবু বক্করের সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০১৩ সালে ‘বাংলার কলি’ যখন পাকিস্তান যাচ্ছিলো তৎকালীন বিশ্বব্যাপী মুসলামনদের ওপর বিভিন্নধরণের নির্যানতন-নিপীড়নের বিষয়ে আবু বক্করের সঙ্গে তামিমের আলোচনা হয়। এ প্রেক্ষিতে এসবের একমাত্র সমাধান হিসেবে জিহাদের কথা আলোচনা হয়।
পরবর্তীতে ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে আবুর মাধ্যমে ঢাকার মিরপুরে-১১ নম্বরের একটি জায়গায় নিহত তামিম চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয় তামিম দ্বারীর।
জিহাদের জন্য তামিম চৌধুরী বিদেশে থেকে এসেছে বলে সে তামিম দ্বারীকে অনুপ্রাণিত করে। এ কথায় তামিম জিহাদের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেন। ২০১৪ সালে জানুয়ারিতে তামিম চৌধুরী চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় যান। সেখানে তাকে তামিম দ্বারী বাংলার দূত জাহাজ ঘুরিয়ে দেখান। সে সময় তারা জাহাজের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় রসদ আনার ব্যাপারে পরিবহণের জন্য বিশ্বস্থ লোকের প্রয়োজন অনুভব করেন। এ কারণে তারা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বিশ্বস্থ যুবকদের জাহাজে রিক্রুট করার পরিকল্পনাও করেন।
২০১৫ সালে জুলাইয়ে ইনস্টিটিউব অব মেরিন টেকনোলজিতে (আইএমটি) ভর্তি হন তামিম। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা ও তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর তামিম দ্বারী নিজের জঙ্গিসম্পৃক্ততা গোপন করতে আইএমটিতে পড়ালেখা শেষ না করে জাহাজে যোগ দেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে তিনি সেখান থেকে চাকরি ছেড়ে দেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হিজরতের জন্য গৃহত্যাগ করেন। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, তামিম দ্বারী ২০১৪ সালে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর ২০১৬ সালে আবার চাকরিতে যোগ দেন। মাঝখানের সময়টাতে হলি আর্টিজান হামলাসহ কয়েকটি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় তামিম দ্বারীর সম্পৃক্ততা আছে কি না খতিয়ে দেখা হবে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে সাভার থেকে তামিম দ্বারী ওরফে আব্দুল্লাহ আল হাসান ওরফে আজিজুর রহমান ওরফে আব্দুল্লাহ আল জাফরী ওরফে আমির হামজা ওরফে আল হুজাইফাসহ তিন জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র্যাব-৪। সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, বিদেশ থেকে নৌপথে বাংলাদেশে অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছিলো নব্য জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপ। এজন্য তারা জাহাজে নিজেদের লোক রিক্রুট করার চেষ্টা করছিলো।
হাতিয়ায়সহ উপকূলীয় অঞ্চলে তাদের বেশ কিছু ট্রলার রয়েছে। র্যাবের তদন্তে এমন একজনের নাম আসে যিনি হলি আর্টিজান হামলার কয়েকবছর আগ থেকেই নিহত তামিম চৌধুরীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৈঠক করে নাশকতার পরিকল্পনাও করেছেন। পরে র্যাব নিশ্চিত হয় ওই ব্যক্তির নাম তামিম দ্বারী (৩২) ওরফে আব্দুল্লাহ আল হাসান ওরফে আজিজুর রহমান ওরফে আব্দুল্লাহ আল জাফরী ওরফে আমির হামজা ওরফে আল হুজাইফা।
এমন তথ্যের ভিত্তিতে তামিম দ্বারীকে ধরতে তৎপরতা শুরু করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র্যাব-৪। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে সাভারে একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে দুই সহযোগিসহ তাকে আটক করে র্যাব-৪ এর সদস্যরা। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, ৫ রাউন্ড গুলি, ২টি ম্যাগজিন, প্রায় এক কেজি প্লাস্টিক ইম্প্রোভাইজ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) তৈরির সরঞ্জামাদী, ৩টি চাকু, একটি চাপাতি, একটি ল্যাপটপসহ বিভিন্ন বৈদেশিক মূদ্রা উদ্ধার করা হয়। মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আটকরা প্রাথমিকভাবে তামিম-সারোয়ার গ্রুপের সক্রিয় সদস্য বলে স্বীকার করেছে।
হলি আর্টিজান হামলা পরবর্তী বেশকিছু অভিযানে নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ অনেকেই মারা যায়। নেতৃত্বশূন্য দলকে পুনরায় সংগঠিত করতে চেষ্টা করছিলো তামিম দ্বারী। সে যেকোনো সময় রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারে এমন তথ্যের ভিত্তিতে সম্ভাব্য সব স্থানে নজরদারি বৃদ্ধি করে র্যাব।
পরে গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে সাভারে ঝিটকা-গাবতলীগামী ভিলেজ পরিবহনের একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে তাদেরকে আটক করা হয়। তিনি জানান, গত বছরের ৮ অক্টোবর র্যাবের অভিযানে পালানোর সময় নিহত হন সারোয়ার। পরে তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ নথিপত্র উদ্ধার করা হয়। সেসব নথিপত্র বিশ্লেষণ করে এ পর্যন্ত তামিম-সারোয়ার গ্রুপের ২৫ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। যাদের মধ্যে ১৪ জন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
সেসব নথিপত্রেই তামিম চৌধুরীর বিশ্বস্ত তামিম দ্বারীর নাম পাওয়া যায়। সে জঙ্গিবাদে আগ্রহী যুবকদের উদ্বুদ্ধ করাসহ তামিম চৌধুরীকে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নাশকতার পরামর্শ দিতো। তামিম দ্বারী মেরিন একাডেমিতে পড়াশোনার পর বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের বাংলার কাকলীসহ বিভিন্ন জাহাজে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। একই জাহাজে কর্মরত আবু বক্করের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন এবং তামিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব জানতে পারে, তামিম দ্বারীর বিদেশ থেকে নৌপথে অস্ত্র-গোলাবারুদ আনার পরিকল্পনা ছিলো। এজন্য ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বিভিন্ন জাহাজে তাদের লোক রিক্রুটের চেষ্টা করে সে। এ বিষয়ে নিহত তামিম চৌধুরী ও তামিম দ্বারীর মধ্যে বেশ কয়েক বার বৈঠক হয়। আটক মোস্তফা মজুমদার কুমিল্লা পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে ২০০৭ সালে পাওয়ার গ্রিড অব কোম্পানি বাংলাদেশে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন।
কর্মজীবনে এসে একই মনোভাবাপন্নদের সংস্পর্ষে এসে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সে। কামরুল হাসানের বাবা বিডিআর বিদ্রোহের অভিযোগে ৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। ২০০৬ সালে কুমিল্লার একটি মাদ্রাসায় অধ্যায়নকালে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হন। ২০১৪ সালে তামিম চৌধুরী ও তামিম দ্বারীর মাধ্যমে জিহাদে উদ্বুদ্ধ হয়। ২০১৬ সালের নভেম্বরে সে হিজরতের জন্য গৃহত্যাগ করেন।
< Prev | Next > |
---|