স্টাফ রিপোর্টার: বন্ড সুবিধা বিদেশে টাকা পাচারের অন্যতম একটি খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে দেশ থেকে বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাচার হচ্ছে। বন্ড মাধ্যমে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পায় ব্যবসায়িরা। আর এ সুযোগে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে প্রতিনিয়ত অসাধু ব্যবসায়িরা বিদেশে টাকা পাচার অব্যাহত রেখেছে। ইতিমধ্যে ব্যাংক, বন্ড কমিশনারেট, স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন প্রতিষ্ঠান শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেয়েছে, যারা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে দেশের বাইরে অর্থপাচার করেছে। আর বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে তাইওয়ান, চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড, দুবাই, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে শুল্ক গোয়েন্দারা ছাড়াও এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল সিআইসি, শুল্ক মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল এবং ট্যাকসেস অ্যান্ড লিগ্যাল এনফোর্সমেন্ট শাখার কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একাধিক টাস্কফোর্স কার্যক্রম চালাচ্ছে। ওসব টাস্কফোর্স বন্ড সুবিধায় এলসি খুলে কী পরিমাণ অর্থে কতো পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়, তার কতোটুকু কারখানায় ব্যবহার করে কী পরিমাণ পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি হয়, কী কৌশলে অর্থপাচার হচ্ছে, কী ধরনের পণ্যের বিপরীতে অর্থপাচার বেশি হচ্ছে ওসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাছাড়া বিদেশে কোন কোন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অর্থপাচার হচ্ছে তা চিহ্নিত করতেও এনবিআর কর্মকর্তারা দ্বৈত কর চুক্তির আওতায় তথ্য সংগ্রহ করেন। ইতিমধ্যে উৎপাদনে থেকে আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে ৪ হাজার ৫৮ প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচারের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে এনবিআর। তার মধ্যে ৫৬২টি প্রতিষ্ঠান পাচার করেছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থপাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আবার দীর্ঘদিন উৎপাদনে নেই অথচ ওসব প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানির নামে অর্থপাচার করা হচ্ছে এমন ২ হাজার ৭৩২ প্রতিষ্ঠানও চিহ্নিত করেছে এনবিআর। ওসব প্রতিষ্ঠানের নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ৫ হাজার ২১৪ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। ওই অর্থের বিপরীতে অধিকাংশ সময়ই কাঁচামাল আনা হয়নি। কখনো নামমাত্র কিছু আনা হলেও তা খোলা বাজারে বিক্রি করে বন্ড সুবিধার শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, কাগজপত্রে পণ্যের মূল্য হিসেবে যা উল্লেখ থাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে তাই পাঠিয়ে থাকে। অথচ প্রকৃতপক্ষে আমদানি হয় তার থেকে অনেক কম। অনেক সময় ব্যাংকিং চ্যানেলে পণ্যের মূল্য হিসেবে অর্থ পাঠিয়েও কোনো কাঁচামাল আনা হয় না। অনেক সময় বেশি মূল্যের পণ্য আমদানির এলসি খুলে আনা হয় কম দামের জিনিস। ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তি এ দুর্নীতিতে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া এদেশের বন্ড সুবিধাপ্রপ্তি প্রতিষ্ঠানের অনেক মালিক নিরাপদে অর্থপাচারের কৌশল হিসেবে বিদেশে নিজস্ব মালিকানায় কাঁচামালের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানও খুলে বসেছে। তারা পণ্যের নাম ও পরিমাণের ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অর্থ পাঠায়। যা মূলত বিদেশে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই জমা হচ্ছে। আবার বিদেশে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমেও অনেকে অর্থপাচার করছে। পণ্যের দাম হিসেবে পাঠানো অর্থ কিছু কমিশনের বিনিময়ে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থপাচারকারী নিজস্ব তহবিলে নিয়ে নেয়।
সূত্র আরো জানায়, অসাধু ব্যবসায়ীদের একার পক্ষে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্থপাচার সম্ভব নয়। ব্যাংক ও এনবিআরের কিছু দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দিয়েই তারা আইনের চোখ এড়িয়ে অর্থপাচার করছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহারে ব্যাংক ও এনবিআরের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় ওই বিষয়ে তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে ৫০৭ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১৫২ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে এনবিআর। আর প্রায় আড়াই হাজার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় চিহ্নিতকরণ নম্বর (বিআইএন) স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ৩৫১ প্রতিষ্ঠানের ৮২৩ পরিচালকের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৫১ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় মামলা করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান জানান, বন্ড দুর্নীতির কারণে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাছে সরকার। দেশ থেকে বিপুল অংকের অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। ওসব বন্ধে এনবিআর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে এবং বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
< Prev | Next > |
---|