মাহমুদুল বাসার
motamotছায়ানটের ৫০ বছর পূর্তিতে, ১৪২৪ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠানে ছায়ানটের সভানেত্রী, অগ্নিগর্ভ বাঙালি নারী ড. সনজীদা খাতুন ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমরা এ কথা বুঝি যে, আমাদের নতুন করে স্বাধীনতা সংগ্রাম করার সময় এসেছে। আমরা যেন স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি আবার। অস্ত্র দিয়ে নয়, সংস্কৃতি দিয়ে। আসুন, আমরা সবাই নতুন স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবৃত্ত হই। যে সংগ্রাম সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলবার সংগ্রাম। এই মিলবার চেষ্টাটাই এ বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় কথা।’ (সমকাল-১৬/০৪/২০১৭ইং)।

দ্বিতীয় পর্বের মুক্তিযুদ্ধটা যে চলছে পরোক্ষভাবে তার চিত্রটা ফুটে উঠেছে ড. সনজীদা খাতুনের কথায়। তবে যুদ্ধটা প্রধানত সংস্কৃতির। ১৯৭১ সালের যুদ্ধটা ছিলো প্রধানত রাজনৈতিক, তার সঙ্গে সংস্কৃতি যুক্ত হয়েছিলো। আর এখনকার যুদ্ধটা প্রধানত সংস্কৃতির, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি। একটা অপরটার পরিপূরক। কোনো একটা বাদ দিয়ে অপরটা বিকশিত হতে পারে না।

পাকিস্তানি শাসকরা, মওদুদীবাদী জামায়াতীরা, মুসলিম লীগের লোকজন আমাদের শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিলো না, সাংস্কৃতিক প্রতিপক্ষও ছিলো। সাম্প্রদায়িকতার মতো বিষ প্রথম সংস্কৃতিতে ঢুকেছিলো। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী আন্দোলন, বাংলা বর্ণমালা রক্ষার আন্দোলন, পয়লা বৈশাখ উদযাপনের আন্দোলন Ñ সবই সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রভাব সঞ্চারি ভূমিকাটা সাংস্কৃতিক ভূমিকাই ছিলো। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলকে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখেন নি। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দিতে বঙ্গবন্ধুর এক জীবনের সাধনার প্রয়োজন হয়েছিলো। ড. সনজীদা খাতুনই বলেছেন, পঞ্চাশের দশক থেকে বঙ্গবন্ধু তাঁকে দিয়ে ও জাহেদুর রহিমকে দিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে গানটি পরিবেশন করিয়েছেন। ড. সনজীদা খাতুনের ছায়ানট রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে গেছে। মোনায়েম খানের মতো কুৎসিত তাবেদাররা রবীন্দ্র উচ্ছেদে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো, রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী উদ্যাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো আইয়ুব খান। এ সবের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন তা ছিলো সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে তিনটি গান গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’, ডিএল রায়ের ‘ধন্যধান্য পুষ্প ভরা,’ আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারী’। ১৯৭১ সালে পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসান ইয়াহিয়া খানের যে দানবীর মূর্তিটি অংকন করেছিলেন তা গোটা মুক্তিযুদ্ধকে প্রভাবিত করেছিলো। এটা হঠাৎ করে হয়নি। শিল্পী কামরুল হাসান নিজেও বাঙালি মুক্তি সংগ্রামের একজন সৈনিক ছিলেন। সাংস্কৃতিক যোদ্ধা ছিলেন। শওকত ওসমানের ‘পোট্রের্ট গ্যালারী’ বইতে কামরুল হাসানের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ আছে। কামরুল হাসান লেখালেখিও করতেন। তথাকথিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। স্বৈরাচারী এরশাদের পশুমুখ অংকন করতে করতে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

একটা জাতির জীবন সংস্কৃতি ভিত্তিক, আর সংস্কৃতি জীবন ঘনিষ্ঠ-আচরণ ভিত্তিক। ভারত উপমহাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে সেই মধ্যযুগ থেকে কট্টর মৌলবাদীদের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। আজো সাংস্কৃতিক লড়াই চলছে। প্রায় সব ধর্মের পরিমন্ডলে মৌলবাদী আছে। হিন্দু মৌলবাদের প্রকট রূপ দেখতে পাচ্ছি এখন ভারতে, তালেবানি মৌলবাদ চলছে পাকিস্তানে আর বাংলাদেশে জামায়াতের বিটিম হেফাজত আর চরমোনাই গোষ্ঠীর মাধ্যমে মৌলবাদের বিকট বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। তাদের আক্রমণটা এখন সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ব্যাপার, মৌলবাদ এখন শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন বিদ্বান যথার্থ বলেছেন যে, ‘শেখ হাসিনার কাঁধে হাত দিয়ে মৌলবাদীরা কাজ হাছিল করতে চায়। মৌলবাদীদের যত আস্কারা দেয়া হবে তারা তত পেয়ে বসবে ।’ শেখ হাসিনার মনোবলে চিড় ধরানো ওদের একটা মূল টার্গেট। এক দিকে ওরা হুমকি দিচ্ছে সরকার পতনের, অন্যদিকে গোপনে গোপনে সরকারের অন্দরে ঢুকে কৌশল করে কাজ আদায় করে আনছে। ওরা যে শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে ‘নাস্তিক’ বলেছিলো, এটা ওদের কৌশল। মৌলবাদীরা ভন্ডামীতে, মিথ্যাচারে দক্ষ। ওরা নিরাপদে মিথ্যা কথা বলতে পারে, জনসাধারণ ওদের বিরুদ্ধে সহজে ক্ষেপে ওঠে না। এই সুবিধা ওরা সব সময় কাজে লাগায়।

সশস্ত্র জঙ্গিরা মৌলবাদীদের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এ কথা মানতে হবে, সশস্ত্র সহিংস জঙ্গিরা এলোপাতাড়ি হত্যাকান্ড চালিয়ে, আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরন ঘটিয়ে স্বাধীন দেশের বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতার করালে মূর্তি ধারণ করেছে। অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা, বিদ্বান অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে প্রকাশক দীপনকে হত্যা করা, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার হুমকি দেয়া বাঙালি সংস্কৃতির জন্য বড় মাপের হুমকি। মৌলবাদীরা ভয় ধরানোর কৌশল অবলম্বন করেছে যাতে সংস্কৃতির চর্চা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়, ইহজগতিক চর্চা বন্ধ হয়ে যায়।

সংস্কৃতি শুধু সন্দরের কথা বলে না, শুধুই নাচ-গানের কথা বলে না, কুসংস্কারের, ধর্মান্ধতার, অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলে। রাষ্ট্র, সমাজ, সভ্যতা আকাশ থেকে পড়েনি। আইএস, তালেবান, জেএমবি আকাশ নির্ভর নয় অস্ত্র নির্ভর। ওরা সব চেয়ে বড় ইহজাগতিক। ওরা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাংলাদেশে একটা সন্ত্রাসী ইসলামী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইসলামের আধ্যাত্মিক জগতে ওরা নেই। ওরা আছে ইসলামের নামে মানবতার সংস্কৃতি ধ্বংস সাধনে লিপ্ত।

এতবার বলা হচ্ছে, বোঝানো হচ্ছে যে, ভাস্কর্য কোনো মূর্তি নয়, সেখানে পূজা পার্বন ইয় না, গণজাগরণ মঞ্চের ছেলেরাও বোঝানোর চেষ্টা করছিলো যে, আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে নামিনি, আমরা যদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে নেমেছি। কিন্তু মৌলবাদীরা তা বুঝেনি। কেননা তাদের মতলব অন্য রকম। সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর ‘লাল সালু’ উপন্যাসের ভন্ডপীর মজিদ যেমন কৌশল করে আক্কাস এক তরুনের স্কুল প্রতিষ্ঠা বন্ধ করে দেয় তেমনি আল্লামা শফির মৌলবাদী গোষ্ঠী সংগঠিত হয়ে, হুমকি দিয়ে দিয়ে, ফতোয়া দিয়ে গনজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে দমিয়ে দিয়েছে। এখন শেখ হাসিনার ‘পা’ টার্গেট করেছে। হয় শেখ হানিার পায়ে শেকল পরাবে না হয় কুড়াল মারবে। তারা অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। পাঠ্যপুস্তকে ঢুকে পড়েছে, গণভবনে ঢুকে পড়েছে। চরমোনাই হুমকি দিয়েছে ২০ এপ্রিলের মধ্যে আদালত চত্বর থেকে গ্রিক জাস্টিশিয়া ভাস্কর্য না সরালে আন্দোলন করবে। এখন দেখা যাচ্ছে, জামায়েতের ভূমিকা পালন করছে হেফাজত আর চরমোনাই। আর ২য় পর্বের মুক্তিযুদ্ধটা চলছে এই দুই অপশক্তির বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলবো, মৌলবাদীদের মাথায় হাত দিয়ে আপাতত থামানোর চেষ্টা করবেন না। এতে আপনার দূর্বলতা প্রকাশ পাবে। সব সময় দূর্বলকে ছলের আশ্রয় নিতে হয়। আপোসের কৌশল দিয়ে মৌলবাদীদের বশে রাখবার চেষ্টা করবেন না, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে স্টেট ফরোয়ার্ড না হলে, রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে শানিত না করলে আপনার অর্জিত গরিয়ান ভাবমূর্তি বিপন্ন হবে। আপনি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকর্ম করেন, এটা কোনো দোষের না, কিন্তু স্টেট পলিসির মধ্যে ধর্ম ঢোকানো হলে, আদালতের ভাস্কর্য সরালে আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এক ধরনের পরাজয় ঘটবে। আপনার প্রতি আমাদের ভালোবাসায় চিড় ধরবে। অতএব সাধু সাবধান।

মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক, গবেষক।

সাম্প্রতিক