এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দেশের মানুষের পাশে থাকা গৌরব দিপ্ত সেনাবাহিনীর অবদান অবিস্মরণীয়। তদোপরি জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছে। দেশে প্রায় সময় সর্বনাশা সামুদ্রীক জলোচ্ছাস বন্যা, খরা থেকে শুরু করে বেআইনী অস্ত্র উদ্ধার, কালো বাজারি দমন, ভূমিধস, রানা প্লাজার উদ্ধার অভিযান, বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের কবল থেকে সাধারণ মানুষ কে উদ্ধার অভিযান, জঙ্গি দমন সহ রাস্তাঘাট, পুল, সেতু, পূণর্¯’াপন ও জাতীয় উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে দেশের অন্যান্য সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, দপ্তর, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের ভূমিকার চেয়ে কোন অংশেই দেশের মানুষও কম মনে করে না। যদিও অনেক বেশী অবদান রেখে জাতীয় জীবনে সেনাবাহিনী যথেষ্ট সুনাম নিয়ে এগিয়ে চলছে।
সেনাবাহিনী দেশের অন্যান্য বাহিনীর মতো দেশ মাতৃকার অকতোভয় গর্বিত সন্তান। তাদের নিরলস কর্ম প্রচেষ্টা, উদ্দীপনা, সাহস, দেশপ্রেম দুনিয়ার কোন দেশের সেনাবাহিনীর চেয়ে কম নহে। যখনই দেশ কোন সংকটে পড়েছে তখনই সরকার সেনাবাহিনীকে ডাকলেই পাশে এসে দাঁড়িয়ে দেশের সিভিল প্রশাসনের লোকদের মতো যে কোন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে দেখা যায়নী কোন উচ্ছাস, ভাবাবেগ ও জৌলুস। প্রমাণ মেলেছে বারবার। রানা প্লাজা ধ্বংসের পর দেশের মানুষ যখন আহত, নিহত ও জীবিতদের উদ্ধারের ব্যাপারে উৎকন্ঠিত, হতবাক সেই সময় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর সহ অন্যান্য ইউনিটের রাতদিন শ্রম, ত্যাগ, বিনিদ্র রজনী ও কর্ম প্রেরণাকে দেশের মানুষ আজো স্মরণ করে থাকে। স্বাধীনতার পর বঙ্গোপসাগরে পাক হানাদার বাহিনীর ফেলে যাওয়া মাইনসহ বিভিন্ন যুদ্ধ সরঞ্জামাদি উদ্ধারের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকারী সামরিক টিমকে যথেষ্ট সহযোগীতা করে সমুদ্র থেকে মাইনসহ অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। এসব মাইন ও অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার করা না হলে জাতির দুঃসময় মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরে খাদ্যশস্য সহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের জাহাজ ভিড়তে পারতনা। ফলশ্রুতিতে দেশে জিনিষপত্রের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, খাদ্য সংকট ও সীমাহীন অর্থনৈতিক সংকটে দেশ নিপতিত হত। এমনিভাবে সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার ও মানুষের বিভিন্ন সংকটে গৌরব দিপ্ত সেনাবাহিনীর অবদানকে ভুলে যাওয়ায় সুযোগ নেই। তবে দেশের অন্যান্য সংস্থার কাজের প্রচার বেশী লক্ষ্য করা গেলেও সেনাবাহিনীর কাজ বেশী, প্রচার কম বিশেষ গুন হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া ৮৬ সালে উড়ির চরে সর্বনাশা জলোচ্ছাস, ৮৮ ও ৯১ সালে দেশব্যাপী প্রলয়ংকারী বন্যা, আইডি কার্ড, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভিজিডি কার্ড বিতরণ, রাজধানীর যানজট, ওয়াসার পানি সমস্যা, বিদ্যুৎ বিতরণ সমস্যা থেকে উত্তোরণ, টিআর কাবিখার প্রজেক্ট দেখ ভাল, রিলিফের গম, চাউল, টিনের লুটপাট তদারকি, উদ্ধার এবং দেশের বিভিন্ন নির্বাচনে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ও সময় সময় আইন শৃংখলা উত্তরণের ব্যাপারেও সেনাবাহিনী যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবীদার বলে দেশের মানুষ মনে করে থাকে। যে কারণে দেশের সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের অর্গানোগ্রামে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনের প্রার্থীরা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নিকট সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কামনা করে থাকে।
১৯৮৮ সালের নজির বিহীন সর্বনাশা বন্যার সময় বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতো কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা জেলার হাওড়, ভাওড় ও ভাটী এলাকার বানে ভাসা অসহায় মানুষের পাশে ১৯ পদাতিক ডিভিশন ও তৎকালীন ময়মনসিংহের ২৫ বেঙ্গলের সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের অপরিসীম শ্রম, সেবা ও কর্মোদ্দীপনা কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সেই সময় একজন সাংবাদিক কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ পূনর্বাসন ও সার্বিক সমন্বয় কমিটির সদস্য ও সমাজ কর্মি হিসেবে তাদের পাশে থেকে বন্যার্তদের জন্য কাজ করতে গিয়ে তাদের প্রচেষ্টা, শ্রম ও কর্মোদ্দীপনার স্মৃতি আজো ঘুরে ফিরে বারবার মনে পড়ে থাকে। সম্প্রতি সমাপ্ত সিলেট মহানগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ীর আতিয়া মহলের জঙ্গি তৎপরতা পুলিশের গোয়েন্দা জালে ২৪ মার্চ ধরা পড়লে, পরের দিন ২৫ মার্চ শনিবার থেকে সেনাবাহিনীর কমান্ডো প্যারা ইউনিট দায়িত্ব নিয়ে ২৮ মার্চ এর পরিসমাপ্তি ঘটায়। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সেনাবাহিনীর এই চার দিনের দুঃসাহসিক পরিকল্পিত পরিচালনার অভিযান প্রতিফলিত হয়। এই অভিযানের অগ্রগতি সম্পর্কে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিমের অধিনায়ক এ ব্যাপারে প্রায় সময় প্রেস কনফারেন্স ও আন্তঃ গণসংযোগ (আইএসপিআর) পরিদপ্তরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দেশের হতচকিত ও শংকিত মানুষের মনে যথেষ্ট আশার আলো সঞ্চার করে থাকে। এখানে আরো উল্লেখ্য জঙ্গি কবলিত আতিয়া মহল থেকে যে কলা কৌশল ও সামরিক কায়দায় প্যারা কমান্ডো দল যেভাবে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে বসবাসকারী ৭৮ জন নারী পুরুষ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা ও শিশুদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে তা যথেষ্ট দুঃসাহসিকতার অভিযান বলে ইতোমধ্যে সর্বমহলে প্রশংশিত হয়েছে। এ ব্যাপারে প্যারা কমান্ডো দলের অধিনায়কের মন্তব্য থেকে জানা যায় অভিযানকালে অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাত ও প্রবল বাতাস থাকার কারণে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে এ উদ্ধার অভিযানটি করতে সহজ হয়েছে। যদি সে সময় বৃষ্টি ও বাতাস একসাথে না থাকতো তবে হয়তোবা ৭৮ জনকে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে থেকে উদ্ধার করা খুবই কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেত। উদ্ধার কাজের সময় প্রবল বৃষ্টি ও বাতাসকে আল্লাহর রহমত ও আবরাহার হস্তী বাহিনীকে যেভাবে আবাবিল পাখীর ঝাঁকে কংকর নিক্ষেপ করে ধ্বংস করেছিল এমন ধরণের রহমতের নজির বলেও মন্তব্য করেছে অনেকেই। সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজন আরো অভিমত ব্যক্ত করে বলেছে, সেনাবাহিনীর এই অভিযান খুবই সফল ও প্রশংসিত।
এত কিছুর পরও যেভাবে ধীরে ধীরে জঙ্গিদের ব্যাপ্তী সামনে এগিয়ে চলছে তা যেমন মর্মস্পর্শী, দুঃখজনক তেমনি এ নিয়ে দেশের মানুষ খুবই উদ্বিগ্ন। এ নিবন্ধটি লেখার সময় দেখা যায়, আতিয়া মহলের ঘটনা শেষ হতে না হতেই মৌলভীবাজারের বড় হাট, নাসির নগর ও কুমিল্লার কোট বাড়ীর গন্ধমতির এলাকায় জঙ্গিদের আস্তানার খবর পেয়ে পুলিশ সমস্ত আস্তানা ঘিরে রেখেছে। এ সমস্ত আস্তানা থেকে জঙ্গিদের গ্রেনেড ও গুলিবর্ষনের কথাও জানা যায়।
দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সামরিক বিশ্লেষক, সুশীল সমাজ ও দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে, দেশের রাজনৈতিক দল, সুশিল সমাজ, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী কাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত কর্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ বিশেষ কোন ব্যক্তি ও গোষ্ঠি নয়, দেশ, জাতি ও জনগণের শত্রু ও বিষ ফোঁড়ার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। শোলাকিয়ার জঙ্গি হামলার ব্যাপারে আগ থেকে পুলিশের নজরদারী ও সতর্কতা না থাকলে যেমনি শত শত নিরীহ মানুষের আহত নিহত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তেমনি হলি আর্টিজান ও আতিয়া মহলের ঘটনা দেখেও তাহাই ভাবতে হচ্ছে। শোলাকিয়ার ঘটনার ব্যাপারে আগ থেকে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের সতর্কতা, অভিজ্ঞতা এবং আতিয়া মহলের ঘটনায় পুলিশের গোয়েন্দা তৎপরতার ব্যাপারে ও দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ তাদেরকে সাধুবাদ জানায়। অনুধাবন করা প্রয়োজন ঞযব ঢ়ধঃরবহঃ যধফ ফরবফ নবভড়ৎব ঃযব ফড়পঃড়ৎ পধসব অর্থাৎ ডাক্তার আসার আগেই রোগী মারা গেলে এর চেয়ে আগে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেমনি যৌক্তিক তেমনি ঢ়ৎবাবহঃরাব রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎব এর মর্মকথাকে বাস্তবে রূপ দান করে যত তাড়াতাড়ি দেশ থেকে এই জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের বিষফোঁড়ার অবসান হয় ইহা দেশের মানুষের প্রত্যাশা ও এখনই সময় বলে দেশের বিজ্ঞজনরা মনে করে থাকে। পরিশেষে আতিয়া মহলের জঙ্গির ঘটনায় উক্ত বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে অবস্থানরত নীরিহ ৭৮ জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারের ব্যাপারে প্যারা কমান্ডোর সংশ্লিষ্ট দল, অধিনায়ক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সহ অন্যান্য কর্তব্যরত সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন সহ ইসলামের সর্বনাশ ডেকে আনা জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের নির্মূল করতে আল্লাহর গায়েবী সাহায্য (ঁহংববহ যবষঢ়) কামনা করে দেশের জনগণ। দেশের উন্নতি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের উত্থানও এই বিষফোঁড়া দলমত, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান অবসান ও উত্তরনে সমন্বিতভাবে সামনে এগিয়ে চলাই হোক আজকের শ্লোগান। সরকার সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের তৎপরতার বিরুদ্ধে এগুলে এটাকে তেমন বড় কিছু মনে করার অবকাশ নেই বলেও অনেকেরই অভিমত। দেশ, জাতি ও জনগণ এ সহিংস বিষফোঁড়ার মূলোৎপাটনে এক অভিন্ন ও ঐক্যবদ্ধ।
এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট
< Prev | Next > |
---|