স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীতে চাহিদা বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে বাসা ভাড়া, জমি ও ফ্ল্যাটের দাম। আবাসনের তীব্র সংকটের কারণে মানুষের আয়ের অর্ধেকই চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া, জমি বা ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ বা এ বাবদ নেওয়া উচ্চ সুদে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে। একসময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের নিশ্চয়তা ছিল। এখন তাঁদের অর্ধেকেরও সেই সুযোগ নেই।
বেসরকারি খাতের ব্যাপক প্রসারের সঙ্গে ঢাকায় যে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হয়েছে, নিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে তাঁদের জন্যও আবাসনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে শ্রমিক-কর্মচারী থেকে শুরু করে পদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সর্বস্তরের চাকুরের নিজের থাকার ব্যবস্থা নিজেরই করতে হয়। উচ্চ আয়ের মানুষজন যেখানে প্লট ও ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টা করছে, মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষজন তেমনি সাধ্যের মধ্যে ভাড়া বাসা খুঁজছে। তবে বাসা খুঁজে পেলেও বেশিরভাগ বাড়ির ভাড়া স্বল্প বা মধ্যম আয়ের মানুষের সাধ্যেও মধ্যে নেই।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক সমীক্ষায় সম্প্রতি দেখা যায়, রাজধানীতে ২০১৬ সালে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
আর গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৩৮৮ শতাংশ। অথচ একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। শহরে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় বসবাস করে, যাদের মোট আয়ের সিংহভাগই ব্যয় হচ্ছে বাড়ি ভাড়ায়। চার দশকের পরিকল্পনাহীনতায় সৃষ্ট এ অবস্থা থেকে শিগগিরই উত্তরণের কোনো পথ দেখাতে পারেননি উন্নয়ন গবেষক ও নগর পরিকল্পনাবিদরা। তবে মধ্যমেয়াদি নীতি প্রণয়ন ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে আবাসন সমস্যার অনেকটাই লাঘব করা সম্ভব বলে তাঁদের বিশ্বাস। সরকারি আবাসিক এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে আবাসিক ভবন নির্মাণ করে সীমিত আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া অথবা সহজ শর্তে বিক্রি করা, স্বল্প সুদে গৃহঋণ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল গঠন করার পরামর্শ দেন তাঁরা।
বাড়ি ভাড়া আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে ভাড়াটেদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন তাঁরা। তাঁদের মতে, কেবল আবাসন সুবিধা বাড়ালেই হবে না, একইসঙ্গে ঢাকার আশপাশে স্যাটেলাইট টাউন নির্মাণ, জেলা শহরের অবকাঠামো ও সেবা উন্নয়ন, রাজধানী থেকে পর্যায়ক্রমে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও কল-কারখানা সরিয়ে ঢাকার ওপর নির্ভরশীলতাও কমাতে হবে। সরকারি ক্ষমতা ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকায়। বেসরকারি খাতের কর্মকা-ও পরিচালিত হচ্ছে মূলত ঢাকাকে ঘিরেই। তাই জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় আসতে হচ্ছে সারা দেশের মানুষকে। দেশের সেরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সেবার ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছে রাজধানীতে। পোশাক, চামড়া খাতের মতো শ্রমঘন শিল্পও গড়ে উঠেছে ঢাকায়। ফলে ঢাকায় বসতি স্থাপনের আকাক্সক্ষা প্রবল হচ্ছে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র অনুযায়ী, রাজধানীতে এখন প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ বসবাস করছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের আবাসন সমস্যাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করছেন এই শহরের বাড়িওয়ালারা। বছরের শুরুতে আর বছরের মাঝামাঝি সময়ে নতুন বাজটের আগে আগে বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেন তারা। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক বাড়িওয়ালা জানান, দফায় দফায় পানি-বিদ্যুৎ-জ¦ালানির মূল্য বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া, গৃহনির্মাণ ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, বাড়ি বানানোর খরচ বেশি হওয়া ইত্যাদি কারণেই তারা প্রতিবছর বাড়িভাড়া বাড়ান।
তবে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সূত্রে জানা গেছে, বাড়ি ভাড়াটা বেশি বাড়ে নিম্ন আয়ের মানুষদের। গুলশান, বারিধারা, উত্তরা কিংবা বনানী এসব এলাকায় বাড়ির সংখ্যা বেশি থাকায় বাসাভাড়া কিছুটা কমেছে বাড়েনি। অন্যদিকে টিনশেড বাড়ি, বস্তির বাড়ি কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত যারা ৫ হাজার থেকে ২০-২৫ হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন, তাদের বাড়ি ভাড়া অনেক বেশি হচ্ছে।
বাড়িভাড়ার এই ভোগান্তি থেকে নিস্তারের জন্য নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সরকারের উচিত এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাতে নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত যারা আছে তাদের জন্য ফ্ল্যাট এবং বাড়ির সংখ্যা বাড়ে। স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে যাতে তারা বাড়ি কিনতে বা বানাতে পারেন। তাহলে অবস্থার উন্নতি হবে। আর বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ঢাকাকে সব কিছুর কেন্দ্র না করে যদি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলেও ঢাকার ওপরে চাপটা কমে আসে।
মানুষ কমে এলে বাড়ির ওপরে চাপটাও কমে আসবে। পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লেখ্য, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত একটি অধ্যাদেশ প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৮৬ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করে ১৯৬৩ সালের অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়। এর মেয়াদ ছিল ৩ বছর এবং তা ১৯৮৯ সালে শেষ হয়। বর্তমানে প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি ১৯৯১ সালের। কিন্তু সরকার এখনো এ আইনের বিধিমালা তৈরি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সমস্যা হচ্ছে।
Next > |
---|