nari shishuস্টাফ রিপোর্টার: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনে ধীরগতি বিরাজ করছে। ফলে বিপুল পরিমাণ বিচারাধীন মামলা নিয়ে একদিকে যেমন বিচারকরা হিমশিম খাচ্ছেন, অন্যদিকে বিচারপ্রার্থীরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। অথচ দেশে নতুন করে ৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব প্রায় ৮ মাস আগেই অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু এখনো ওই আদালত গঠিত হয়নি। আইন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশের ৪৬টি জেলায় ৫৪টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। ওসব ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মামলা। তার মধ্যে একটি ট্রাইব্যুনালেই ১০ হাজার মামলা বিচারাধীন। পাশাপাশি দেশের ১৮ জেলায় কোনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নেই। ওসব জেলায় সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা জজরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলার বিচারের দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে আদালত সঙ্কটের কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের অধীনে বিচারাধীন মামলার বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ ক্রমেই বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ ও মামলাজটের বিষয়টি লক্ষ্য করে ২০১৫ সালের অক্টোবরে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন সারাদেশে আরো ৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুপারিশ করে। তারপর আইন মন্ত্রণালয় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয় গতবছরের আগস্টে ওসব ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করে। ট্রাইব্যুনালগুলোর জন্য ৪১ জন বিচারকসহ মোট ২৪৬টি পদ সৃজনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ শাখা অনুমোদন দেয়। একই সাথে যানবাহন ও অফিস সরঞ্জামাদি ক্রয়েরও অনুমোদন দেয়া হয়। তার আগে গতবছরের এপ্রিলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ওসব ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পর প্রস্তাবটি আইন মন্ত্রণালয় হয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যায়। আর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরই সারাদেশে ওসব ট্রাইব্যুনাল গঠনের কাজ চূড়ান্ত হওয়ার কথা।

সূত্র জানায়, সরকার নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধ দমনের লক্ষ্যে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করে। আইনের ২৬(১) ধারায় বিশেষ ওই আইনের অধীনে দায়ের করা মামলাগুলোর বিচারের জন্য প্রতিটি জেলা সদরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে। এমনকি প্রয়োজনে একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথাও বলা হয়েছে। আইনের বিধান অনুসারে সারাদেশে ৫৪টি ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ওসব ট্রাইব্যুনালে হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন। ওই কারণে আইনের বিধান অনুযায়ী ওসব মামলার বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। মামলাজটের কারণে একটি মামলার বিচার শেষ করতে বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে। বর্তমানে যে ১৮ জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নেই সেসব জেলায় ওই আইনের অধীনে দায়ের করা প্রায় ১৫ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা জজদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ওসব মামলার বিচার করতে হয়। জেলা জজ নিজের বিচারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ওই জেলার বিচার প্রশাসনও দেখভাল করেন। তার ওপর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন খুবই কষ্টকর। ওসব জেলার মধ্যে মামলার আধিক্য বিবেচনায় ১২টি জেলায় একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়। জেলাগুলো হলো রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, পিরোজপুর ও ভোলা।

সূত্র আরো জানায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিদ্যমান মামলার জট সহনীয় পর্যায়ে আনা ও সুষ্ঠুভাবে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য বিচারক ও মামলার অনুপাত বিবেচনায় ২২টি জেলায় আরো ২৯টি নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়। তার মধ্যে রাজধানী ঢাকায় বিদ্যমান ৫টি ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি নতুন করে আরো চারটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ৩টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। জেলাটিতে নতুন করে আরো ৪টি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আর নীলফামারী, খুলনা, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং হবিগঞ্জে ২টি করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাছাড়া যশোর, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, কক্সবাজার, কুমিল্লা, গাইবান্ধা, বাগেরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও নীলফামারীতেও নতুন একটি করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা রয়েছে।

এদিকে বর্তমানে সারাদেশের আদালতগুলোয় প্রায় ৩২ লাখ মামলা বিচারাধীন। ওই সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ওসব মামলার বিপরীতে কাজ করছেন মাত্র ১৪শ’ বিচারক। গড়ে একজন বিচারকের দায়িত্বে মামলার পরিমাণ প্রায় ২৩শ’। বিচার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য একজন বিচারকের দায়িত্বে সর্বোচ্চ ৮শ’ মামলা থাকা উচিত। তাছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন টাইব্যুনাল বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হওয়ায় সেখানে অধিকতর স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি হয়। ওসব মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা বেশি হয় এবং বিচার কার্যক্রম সম্পন্নে অধিক সময় প্রয়োজন হয়। সে বিবেচনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও মামলার অনুপাতের পার্থক্য আরো কম হওয়া উচিত। মামলার জট ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে বিচারাধীন মামলার বিচারপ্রার্থীদের প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। নতুন ওসব ট্রাইব্যুনাল গঠন হলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমে আসবে।

অন্যদিকে নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠন প্রসঙ্গে আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক জানান, নারী-শিশুর মামলা কতোগুলো আছে তা ওপর থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে। জেলাওয়ারি কতোগুলো মামলা আছে তা এখন পাঠানো হচ্ছে। কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নেবে কতোগুলো কোর্ট গঠন করবে বা করবে না।

সাম্প্রতিক