স্টাফ রিপোর্টার: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গোপনে সরকারের সেবাধর্মী বিভিন্ন সংস্থা ও দউুরের দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত অন্তত ২৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালাচ্ছে দুদক এবং ওসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছ থেকে দুর্নীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিসংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি গোপনে বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমেও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নেয়া হচ্ছে। দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দুদকের অনুসন্ধানকারীরা সেবাধর্মী যেসব সরকারি দফতর থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করছে তার মধ্যে রয়েছে ওসব প্রতিষ্ঠানের আইন ও বিধি, পরিচালন পদ্ধতি, সরকারি অর্থের অপচয়, জনসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধকতা, সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি এবং দুর্নীতির কারণ। তাছাড়া দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতেও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিগত ৩০ জানুয়ারি থেকে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিমের দুর্নীতি অনুসন্ধানের কাজ শুরু করা হয়। ওই টিম প্রায় দুই মাস ধরে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, তিতাস, বিমান, ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস, বিএসটিআই, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, ওয়াসা, বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিএ, গণপূর্ত অধিদফতর, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, রাজউক, শিক্ষা অধিদফতর, বিআইডব্লিউটিসি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, রেলওয়ে, তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স, হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিজিএ), কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগ, সওজ ও পরিবেশ অধিদফতরের দুর্নীতির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। তাছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ঠেকাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমেও দুদকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, দুদক ২৩টি সেবাধর্মী সরকারি সংস্থার দুর্নীতি খুঁজে বের করতে কমিশনের ৯ জন পরিচালকের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের টিম গঠন করে তাদের কাজের পরিধি ঠিক করে দিয়েছে। প্রতিটি টিমে একজন পরিচালক ছাড়াও একজন উপ-পরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালক রয়েছে। আর ওসব টিমের কাজ তদারকিতে রয়েছেন দু’জন মহাপরিচালক। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, ওয়াসা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দুর্নীতির খোঁজে গঠিত টিমের সদস্যরা ওই তিনটি সংস্থাকে থেকে ইতিমধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছে। একই সাথে আরো অফিসিয়ালি তথ্য চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দুদক টিমের সদস্যরা ওসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে সোর্সও তৈরি করছে। ওসব সোর্সের মাধ্যমেও দুর্নীতির তথ্য নেয়া হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায় ওই প্রতিষ্ঠান থেকে কোন নীতিমালায় ওয়্যারহাউস ও বার পরিচালনার লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে, এনার্জি ড্রিংকে মাদকের উপস্থিতির বিষয়ে সংস্থাটি কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বার কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে, দুর্নীতির সাথে জড়িত কারা, তাদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন ১৫ ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। তাছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সহায়তায় মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোয় সেবা গ্রহীতাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা, কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রি করা এবং মাদক পরীক্ষাগার থেকে অর্থের বিনিময়ে মনগড়া রিপোর্ট প্রদান প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিষয়েও তথ্য চাওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন ওসব তথ্যেও ওপর পর্যালোচনা চলছে। তাছাড়া দুদক টিমের সদস্যরা যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছে, ওসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম দুটি কাজ বেশি জোর দিচ্ছে। তার একটি হল কিভাবে দুর্নীতি হয় এবং তা কিভাবে দমন করা যায়। সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ তৈরি করে কমিশনের কাছে তা জমা দেয়া হবে।
সূত্র আরো জানায়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), বিমান, রাজউক ও পরিবেশ অধিদফতরের দুর্নীতি নিয়ে যে কাজ করছে ওই কাজ অন্য সময়ের মতো নয়। বর্তমানে কমিশন সরকারি সেবা খাতের দুর্নীতির দৃশ্যমান অনুসন্ধানই দেখতে চাচ্ছে। আর তাা মাথায় রেখেই দুদক কর্মকর্তারা কাজ করছে। দুদক সরকারি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা করার পর তার দুর্বল দিক খুঁজে দেখছে। কি কারণে দুর্নীতি হয়, কারা দুর্নীতি করে সেই তথ্য বের করা হয়েছে। ইতিমধ্যে দুর্নীর অনেক তথ্যই দুদক টিমের হাতে এসেছে। দুদক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটির অর্গানোগ্রাম, জনবল নিয়োগ, ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিধি ও ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনসহ ওই সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের কপি ইতিমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। আর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহের বন্দর কিভাবে পরিচালিত হয়, কিভাবে হ্যান্ডলিং, ক্লিয়ারিং, আমদানি-রফতানি শুল্কায়নসহ নানা প্রক্রিয়ায় কিভাবে দুর্নীতি হয় বন্দর পরিদর্শন করে দুদক টিম এমন কিছু তথ্য পেয়েছে। আর তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের দুর্নীতির অনুসন্ধানকারীরা রাজধানীর ১১টি থানা অঞ্চলের জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন নিয়ে দুদক সংশ্লিষ্টরা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। কারণ সাবরেজিস্ট্রাররা দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। ওই দফতরে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে যে সরকারি রেজিস্ট্রেশনের অর্থ কোষাগারে জমা না দিয়ে সাবরেজিস্ট্রার তার পকেটে করে নিয়ে গেছে। আর জমি বা ফ্ল্যাটের দাম কমিয়ে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় চলছে সীমাহীন দুর্নীতি। তবে বিশেষজ্ঞরা দুদকের এমন উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। তারা দুদক টিম অনুসন্ধানের মাধ্যমে অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থার তথ্য বের করে দুর্নীতি প্রতিরোধের সুপারিশসহ যথাযথ ব্যবস্থা নিলে জনগণ উপকৃত হবে বলে তারা মনে করছেন।
অন্যদিকে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতির তথ্য পাওয়া পর কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে সে প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ জানান, কিভাবে সেবাধর্মী সরকারি দফতরগুলোয় দুর্নীতি হয়, তার জন্য দায়ী কারা বা সিস্টেমের কারণেই দুর্নীতি হয় কিনা এবং দুর্নীতির সোর্স বা উৎসও বের করা জরুরি। আর ওই সিস্টেমের কারণেই দুর্নীতি হলে তা বদলানোর জন্য কী করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক কমিটিকে ওই সুপারিশ করবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ দুর্নীতির কাছে সরকার সেবাপ্রার্থীদের জিম্মি হতে দিতে রাজি নয়। আর ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে তাদের সেবার স্বরূপ নির্ণয় করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে দুদকের এক মহাপরিচালক জানান, অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কাঁটা সরিয়ে সেবা নিশ্চিত করাই দুদকের অভিযানের মূল লক্ষ্য।
< Prev | Next > |
---|