pm2ঢাকা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ বিদ্যালয়ে ভর্তি না করার মন-মানসিকতা ত্যাগ করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছেন, প্রতিবন্ধিতার কারণে কোন শিশুকে শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে রাখা যাবে না।
তিনি বলেন, ‘অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সকল শিশু সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করবে। ফলে এ ধরনের সকল শিশুরা নিজ পরিবার থেকে বাড়ির নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। অন্যদিকে সাধারণ শিশুরা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সাথে মিশে মানুষের ভিন্নতা সম্পর্কে জানবে এবং ভিন্নতাকে মেনে নেয়ার শিক্ষা পাবে।’
শিক্ষাকে তাঁর সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ২০১০ সালে একটি বাস্তবমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছি। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘প্রতিবন্ধিতার কারণে কোন শিশুকে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা যাবে না’।
শেখ হাসিনা বলেন, এতে করে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই সহনশীলতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের শিক্ষা লাভ করবে। এতে গোটা সমাজ ব্যবস্থাই উপকৃত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘দশম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ২০১৭’ উপলক্ষে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ সব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অটিজম বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন ব্যক্তিরাও বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে কম্পিউটার, ইন্টারনেটেও অন্য সবার মতোই সমান পারদর্শিতার সাথে কাজ করতে সক্ষম। তিনি প্রতিবন্ধীবান্ধব সফটওয়্যার, অডিও-ভিডিও শিক্ষা উপকরণ, অবকাঠামো, প্রযুক্তি উদ্ভাবনসহ তথ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে আমি সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি অনুরোধ জানান।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. মো. মোজাম্মেল হোসেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জিল্লার রহমান স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, জাতীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ের উর্ধ্বতন কমৃকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ এবং অটিজম আক্রান্ত শিশু-কিশোর, অভিভাবক ও শিক্ষকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে অটিজম অতিক্রমে সফল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে নীলবাতি প্রজ্জ্বলন করেন।
২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২ এপ্রিল দিবসটি বিশ্ব অটিজম সজেতনতা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-‘স্বকীয়তা ও আত্মপ্রত্যয়ের পথে।’
অটিজমসহ সকল ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং পরিবারে ও সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে কর্মসংস্থানের বিকল্প নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজের প্রতি এসকল বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের একাগ্রতা থাকে অনেক বেশি এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতিও অন্যদের তুলনায় সন্তোষজনক। তিনি বলেন, অটিজম একটি স্বাভাবিক অবস্থা এটি শিশুর শৈশব থেকেই দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে তাদের উপযোগী কর্মক্ষেত্র চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এ ছাড়াও বিসিএসসহ সকল শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে অটিজমসহ সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কোটা সংরক্ষিত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অটিজমসহ সকল ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে অটিজম সম্পর্কে মানুষের তেমন কোন ধারণা ছিল না। আমার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ-এর নিরলস প্রচেষ্টায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অটিজমের গুরুত্ব ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সে এখন বাংলাদেশে অটিজম বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন। তার উদ্যোগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং আর্থ-সামাজিক সহায়তা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
তিনি বলেন, আমরা ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর সায়মা ওয়াজেদ-এর পরামর্শে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও তাদের কল্যাণে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে বাস্তবায়ন শুরু করি।
তাঁর সরকার অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩’ পাশ করেছে এবং এই আইনের বিধিমালা প্রণয়ন করেছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা তাদের ভবিষ্যত জীবনের কথা বিবেচনায় নিয়ে এই আইনের আওতায় একটি নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট গঠন করেছি। ট্রাস্টের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে আমরা ৪১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দিয়েছি এবং আমি চাই সমাজের বিত্তবানরা এখানে সহায়তা করবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়নের কাজ চলছে। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ‘ডিজ্যাবিলিটি ইনফরমেশন সিস্টেম’ সফটওয়্যার চালু করা হয়েছে। এতে দেশব্যাপী ‘প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ’ কর্মসূচির মাধ্যমে ১৫ লাখ ১০ হাজার ৮শ’ প্রতিবন্ধীর ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালার আওতায় ৬২টি বিদ্যালয়ের প্রায় ৮ হাজার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে।
‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘ন্যাশনাল একাডেমী ফর অটিজম এন্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজএ্যাবিলিটিস’ স্থাপনের কাজ চলছে। এখানে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সকল শিশুদের একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এসকল শিশুদের বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের সুবিধার্থে ক্রমান্বয়ে সকল বিদ্যালয়ে র‌্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, মূক ও বধির শিশুদের সুষ্ঠুভাবে পাঠদানের লক্ষ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে’ বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বছরের প্রথম দিনে তাঁর সরকারের উদ্যোগে চালু করা বই উৎসব প্রসংগে বলেন, নতুন বছরের প্রথম দিন আমাদের শিশুরা বই উৎসব পালন করে। একই দিনে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের হাতেও আমরা ব্রেইল বই তুলে দিচ্ছি। নিবিড় শিক্ষা গ্রহণের জন্য দেশের ৭০ হাজার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীদের জন্য বাংলা একাডেমি বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসসমৃদ্ধ ব্রেইল বই প্রকাশ করছে।
অটিজম বৈশিষ্ট্রসম্পন্নদের জন্য সরকারের সুযোগ- সুবিধা প্রদান প্রসংগে তিনি বলেন, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের বিনামূল্যে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ঢাকার মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে অটিজম রিসোর্স সেন্টার ও একটি ‘স্পেশাল স্কুল ফর চিলড্রেন ও উইথ অটিজম’ স্থাপন করা হয়েছে। এখানে প্রায় ৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন কমপ্লেক্স নির্মিত হচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অটিজমসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত শিশু শনাক্তকরণসহ বিনামূল্যে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ৩২টি মোবাইল থেরাপি ভ্যান চালু রয়েছে।
তিনি বলেন, বিনামূল্যে স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের থেরাপী-সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সকল জেলায় ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র (ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার) স্থাপন করা হয়েছে। এসব জায়গায় একটি করে অটিজম ও এনডিডি কর্ণার চালু করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিজঅর্ডার এন্ড অটিজম-এর মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে ডাক্তারদের অটিজম ও ¯œায়ু-বিকাশজনিত সমস্যা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের সকল কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
অটিজম প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল হলেও অটিজম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী অনেকেই অত্যন্ত মেধাবী হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের রয়েছে অনন্য প্রতিভা। আপনাদের প্রতিভাকে বিকশিত করাই আমাদের লক্ষ্য। বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, ডারউইন, নিউটন জীবনের একটা সময় অটিজমের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছেন। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী উইলিয়াম বাটলার ইয়টস্, ড্যানিস কবি হ্যানস্ এন্ডারসন, সুর¯্রষ্টা বিথোভেন, মোজার্ট প্রতিবন্ধী ছিলেন। বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস্ আজীবন প্রতিবন্ধী থেকেও তাঁর আবিস্কার থেমে থাকেনি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর সরকারের উদ্যোগে জাতীয় প্রতিবান্ধি ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ‘আপনারা প্যারা অলিম্পিক ও স্পেশাল অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করেছেন। তাই আমরা অটিজম বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন ও প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের জন্য ঢাকার অদূরে সাভারে ১২ একর জমিতে ৩১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া কমপ্লেক্স’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসুন আমরা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াই। তারা আমাদেরই আপনজন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি বিশ্বাস করি, সকলের সমন্বিত উদ্যোগ ও উপযোগী পরিবেশ পেলে অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তিরা স্বাবলম্বী হয়ে গড়ে উঠে আমাদের জন্য অপার সম্ভাবনা বয়ে আনবে।
অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্ব শেষে অটিজম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী শিল্পীদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। - বাসস

সাম্প্রতিক