মনির । ১১ এপ্রিল ২০১৭
দা খোন্তা কোদাল আর হাতুড়ির এক একটা আঘাত পুরনো ঘরটা একটু একটু করে ছোট করে দিচ্ছে। পাকা ঘর ভাংতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এক একটা ইট যেন একে অপরকে আঁকড়ে ধরে আছে। কেউ কাউকে ছাড়তে চাচ্ছে না।শাবলের গুঁতায় ভেংগে যাচ্ছে তবু ছেড়ে যেতে চাই না। মিস্ত্রিদের গায়ে শক্তি আছে বলতেই হয়। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এক একটা ইট খুলে খুলে ফেলছে।
ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ভিড় করে দেখছে। বড়রাও যাদের কাজ কাম নেই তারা সকালের দাত মাজতে মাজতে ঘর ভংগা দেখছে। গ্রামের মানুষের বিনোদন বলতে এক জায়গায় জটলা পাকিয়ে গল্প করতে পারলেই হল।
পুরনো একখান কাঠের চেয়ার নিয়ে বাপজান বসে আছে নিম গাছের গোড়ায়।
গ্রামে যখন বাশ কাঠ দিয়েই অনেকে ঘর তুলতে পারেনি তখনকার আমলেই বাপ এই পাকা ঘরটা তুলে ছিল তার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে।
বাপ চেয়েছিল যত কষ্টই হোক ছেলেপুইলে যেন তার মত ঘরের কষ্ট না করতে হয়। তাই শত কষ্ট করেও পাকা বাড়ি করেছিলেন।
আজ দিন পালটেছে। দিনমজুর থেকে শুরু করে সবার মোটামুটি পাকা বাড়ি হয়েছে।
গ্রামের যুবক ছেলেরা পাড়ি দিয়েছে বিদেশ। কাচা টাকা দিয়ে পাকা বাড়ি করা যেন ছেলের হাতের মোয়া। সেন্টু এক রুম করলে বিল্টু দুইরুম করছে।
কেউ টিন দিয়ে করলে আরেকজন ছাদ দিয়ে ফেলছে। এভাবেই চলছে গ্রামের উন্নয়ন।
সারাদিন পরের জমিতে কামনা খেটে বিকেলবেলা ঘাস নিয়ে বাড়ি ফিরছে দিনমজুর। একটা দুই টা গরু পুষে দুই বছর পরেই তুলে ফেলছে পাকা ঘর।
সবারই কষ্ট হচ্ছে। তবু না করে উপায় নেই। ছেলে মেয়ে ভাল থাকুক সবাই চায়। তাছাড়া দেখাদেখি চাষ দেখাদেখি বাস।
এই সময় বাবার তোলা সেই পুরনো বাড়ি বড্ড বেমানান। ইটের উপর ইট সাজিয়ে রাখলেই পাকা বাড়ি বলা যায় না। ডাইনিং কিচেন ড্রয়িংরুম না থাকলে ভালো বাসা বলা যায় না। অন্তত জাতে উঠতে হলে বা ভদ্র সমাজে জাত টিকিয়ে রাখতে হলে বাপজানের পুরনো বাড়ি না ভাংলেই না।
বাড়ি ভাংগার কথা মুখে আনতেই বাপজি গো ধরে বসলো। ঘাম আর রক্ত দিয়ে গড়া বাড়ি কিছুতেই ভাংতে দেবে না। মার পছন্দের বাড়ি এটা। দরকার হয় অন্য কোথাও বাড়ি করো তবু এ বাড়ি ভাংগা যাবে না।
কিন্তু বাধ সাধলো খোকার মা। নতুন বাড়ি করাতে পয়সা লাগে। এ বাড়ি ভাংলে বেশ কিছু ইট পাওয়া যাবে আর উঠনের উপর এই জংলা রেখেইবা কি হবে?
শেষ পর্যন্ত বৌমার মুখঝামটার কাছে হার মেনে নিয়েছে বাপজি।
আজ সকালে যখন ঘরের আসবাবপত্র বের করে মিশ্রীরা ঘর ভাংগা শুরু করলো তখন বাপজি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো।
আমি কাঠের চেয়ার টা নিম তলায় দিয়ে বসতে বললাম।
বাপজি বসে আছে। বারবার বাপ এমন ভাবে কুঁকড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে মিস্ত্রীর হাতুড়ির এক একটা আঘাত যেন বাপজির বুকে লাগছে -----
আমাদের খোকার মা এসে আরেকবার মুখঝামটা দিয়ে বলে গেল বুড়োত ঢং দেখলে বাচিনা ------
(২)
ধার দেনা আর নিজের সঞ্চিত টাকা দিয়ে বাড়ি করলাম সমাজে একটা জায়গা পাবার জন্য। বাড়ি একেবারে মন্দ হয়নি। সকাল বিকাল ঘুরে ঘুরে শুধু দেখি বাড়ির চারিধার। আহ এক জীবনের সব টুকু কষ্ট এই বাড়ির পিছনে ব্যয় করেছি সাথে সংসার আর ছেলেটার লেখাপড়া চালাতে শেষের দিকে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। বাপজি চোখের জল মুছতে মুছতে তার শেষ সম্বল ব্যাংকে জমানো পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে দিল। দেবেই না বা কেন? ঘরে তো আর আমি একা বসত করব না। বারান্দায় বাপজিকে একটা তক্তা পেতে দেব। বুদ্ধি টা অবশ্য খোকার মা দিয়েছে। মেয়ে মানুষের প্যাচে প্যাচে বুদ্ধি দেখলে সত্যিই অবাক হয়ে যায় মাঝে মাঝে।
ছেলেটা একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছি। একটাই তো ছেলে। মানুষের মত মানুষ করতে যা যা দরকার আমি তার কোন কিছুতেই কম করিনি।
নিজে খেয়ে না খেয়ে ছেলেটাকে টাকা জোগাড় করে দিচ্ছি। আর মাত্র দুই বছর তার পর আর সুখ দেখে কে?
ছেলে নিশ্চয় বড় একটা চাকরী পাবে বিয়ে হবে নাতী হবে। আহ ভাবলেই মনটা প্রশান্তিতে বুক ভরে যায়।
অবশেষে বাপজি ইন্তেকাল করলেন। নতুন বাড়িতে তার বেশি দিন থাকা হল না। খোকার মা ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদলো খানিকক্ষণ কিন্তু আমি জানি মনে মনে কি খুশিই না হল।
মরার আগে বাপজি বোয়াল মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিল। আমি বললাম সামনের হাটের দিন কিনে আনবো। সামনের হাট চিরতরে পিছনে ফেলে বাপ আমার না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন।
যে বাবার বোয়াল মাঝের ঝোল দিয়ে ভাত খাবার সাধ পুরোণ করতে পারিনি সেই বাবার কুলখানিতে কয়েকশো লোক দাওয়াত করে পোলাও মাংস খাওয়ালাম। হাজার হলেও সমাজে একটা নাম আছে আমার। ফকির মিস্কিন খায়িয়ে তো আর নাম।টিকিয়ে রাখা যায় না।
ছেলেটা পাশ দিয়ে বেরিয়েছে। ভাল চাকরিও পেয়েছে। মোটা অংকের বেতন। ছেলে অবশ্য বলেছে বেতনের দিকে তাকাতে হয় না। উপরি ইনকাম বেশি। খোকার মার চুলে পাক ধরেছে। আমিও এখন আর আগের মত শক্তি পাইনা কোন কাজে।
মনটাও ভেংগে গেছে। সারাজীবন যে ছেলের জন্য এত কষ্ট করলাম সেই ছেলে আমাদের না জানিয়ে বড় লোকের মেয়ে বিয়ে করেছে।
ছয়মাস নমাসে একবার বাড়ি আসে। এ বাড়ি নাকি তার ভাল লাগে না। এটাচ বাথ নেই এসি নেই এই বাসা বৌমার পক্ষে থাকা সম্ভব না।
নিমটা গাছটা আজো মরেনি। তবে আগের মত কচি পাতা ছাড়ে না আর। কেমন যেন ঝিমিয়ে গেছে। আমি কাঠের চেয়ার নিয়ে সকালে একবার নিম গাছের নিচে বসে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
বাবার কথা মনে পড়ে খুব আজকাল। শত অনুরোধেও বাবার ভিটেমাটি টা রাখিনি। নতুন ঘর তুলেছি সেখানে। যাদের ভালোর জন্য এই বাড়ি করলাম তারা এখন এই বাড়ি পছন্দ করছে না।
চোখ দিয়ে জল এসে যাচ্ছে।
খোকার মা লাঠিতে ভর দিয়ে এক বাটি মুড়ি নিয়ে পাশে বসলো। বৌমা আর খোকা এসেছে গতকাল।
বাড়িটা ভেংগে ফ্লাট বাসা করতে চাই তারা।
আমি বাধা দিতে গিয়েও থেমে গেছি।
আমি আমার বাবার বাধা শুনিনাই।
রোদ বাড়ছে। মিস্ত্রি এসে গেছে। খোন্তা কোদাল আর হাতুড়ির শব্দে আমার চোখ ফেটে জল আসছে।
সেই নিম গাছ-----
সেই হাতুড়ির এক একটা শব্দ
আমি কুঁকড়ে যাচ্ছি------
এক একটা শব্দ আমার বুকে লাগছে যেন------ সমাপ্ত।
< Prev | Next > |
---|