স্টাফ রিপোর্টার: শিল্পী-লেখক ও ভোক্তাদের সচেতনতার অভাবেই সরকার কপিরাইট আইনের ‘যথাযথ প্রয়োগ’ করতে পারছে না বলে মন্তব্য করেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও দক্ষ লোকবলের অভাব, অপর্যাপ্ত বরাদ্দ এবং আইনগত নানা জটিলতায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কপিরাইট অফিসটি ধুকছে বলেও হতাশা প্রকাশ করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক গ্রন্থ ও কপিরাইট দিবস উপলক্ষে গতকাল রোববার শিল্পকলা একাডেমিতে এক সেমিনারে এ বিষয়ে কথা বলেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, কপিরাইট আইনের প্রয়োগ নিয়ে সরকার কিছুকিছু পদক্ষেপ নিলেও তা যথেষ্ট নয়। আবার যাদের জন্য কপিরাইট আইন, তাদের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতা নেই। আমরা কপিরাইট অফিসের কার্যক্রমকে তাদের সামনে ঠিকমতো তুলে ধরতে পারিনি। যদি পারতাম তাহলে সংস্কৃতির অঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যেতে পারত। কপিরাইট আইনের কিছু ত্রুটি থাকলেও যা সামর্থ্য আছে, তা যদি ঠিকমতো প্রয়োগ করা যেত, তাহলে আমরা অনেক উপকৃত হতাম।
কপিরাইট অফিস আয়োজিত ‘মেধাসম্পদ সুরক্ষায় কপিরাইট আইনের ভূমিকা: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এ সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন রেজিস্ট্রার অফ কপিরাইট জাফর রাজা চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সংস্কৃতি সচিব মো. ইব্রাহীম হোসেন খান। এক সময়ের তুখোড় আবৃত্তি শিল্পী নূর বলেন, আজকাল টিভি-রেডিওতে আমার আবৃত্তির খ-াংশ নিয়ে বাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমি নিজেই জানি না। সবাই ভাবছে, দিয়েছে তো দিয়েছেই। কী আর করব! আমাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে, রয়েছে মানসিকতার সমস্যা। বাজেট বরাদ্দে তলানিতে থাকা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এই প্রতিষ্ঠানটি জনবল আর অর্থবলের ‘অভাবে’ জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেও হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তেমন সচেতন নয়। কপিরাইট আইন প্রয়োগে টাস্কফোর্সটি কিছু করতে পারছে না। কপিরাইট আইনের নানা অসঙ্গতি সমাধানে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের আশ্বাস দেন মন্ত্রী। মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো শিল্পীদের রয়্যালিটি ঠিকমত দিচ্ছে না- এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, এ নিয়ে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের সঙ্গে বৈঠক করবেন। কপিরাইট বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটি ‘বিশেষ’ কর্মশালার আয়োজন করবে বলেও জানান তিনি। সেমিনারের মূল প্রবন্ধে কপিরাইট অফিসের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, সারা পৃথিবীতে শিল্পসম্পদের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হলেও কপিরাইট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কপিরাইট নিবন্ধন ঐচ্ছিক হওয়ায় বাংলাদেশে সৃজনশীল ব্যক্তিরা অনেক সময় তাদের সৃজিত কর্মের নিবন্ধন করতে আগ্রহী হন না।
তিনি জানান, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মাত্র ৭২টি চলচ্চিত্রের কপিরাইট নিবন্ধন হয়েছে। আর ১৯৬২ সাল থেকে এ পর্যন্ত কপিরাইট অফিসে মেধাসম্পদের নিবন্ধন হয়েছে ১৫ হাজার ৮১টি। ২০০০ সালে কপিরাইট আইন প্রণয়নের পরেও সচেতনতার অভাব ও অবহেলার কারণে এর সুষ্ঠু প্রয়োগ করা যাচ্ছে না প্রবন্ধে উল্লেখ করেন চেয়ারম্যান। কপিরাইট বিষয়ক আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব তুলে ধরে তিনি বলেন, কপিরাইট টাস্কফোর্স থাকলেও এর কার্যকারিতা ও সক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। কপিরাইট নিয়ে আদালতে মামলার হার অতি নগন্য। মামলা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইনজীবীর অভাব রয়েছে। অধিকন্তু সৃজনশীল ব্যক্তিরা হয়রানির ভয়ে মামলা করতে ভয় পান। বিদ্যমান কপিরাইট আইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকায় এর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে মন্তব্য করে আইন সংশোধনের কিছু প্রস্তাবও তিনি তুলে ধরেন।
তার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে-
*কপিরাইট টাস্কফোর্সকে কপিরাইট আইনের অন্তর্ভুক্ত করা। *কপিরাইট লংঘন এবং পাইরেসির শাস্তি বাড়ানো। *কপিরাইট বিষয়ে বিরোধ নিরসনে মধ্যস্থতার কার্যক্রম পরিচালনার বিধান রাখা। * রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটকে রিভিউ ক্ষমতা দেওয়া। * প্রতিটি সৃজনশীল কাজের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার আগে মৌলিকত্ব যাচাই পদ্ধতি নির্ধারণ
* ডিজিটাল কাজের কপিরাইট সুরক্ষার বিষয়ে স্পষ্ট ও বিস্তারিত বিধান আইনে সংযোজন। * কপিরাইট আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা এ প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন সংগীত শিল্পী ও বাংলাদেশ লিরিসিস্ট কম্পোজার পারফর্মার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলসিপিএস) প্রধান নির্বাহী সুজিত মোস্তফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. আতিক রহমান এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পরিচালক খান মাহবুব। উন্নত দেশে বড় অংকের রাজস্ব মেধাসম্পদ থেকে আসে- এমন মন্তব্য করে সুজিত মোস্তফা বলেন, আমাদের দেশেও মেধাসম্পদের অভাব নেই। সচেতন হলে এ ক্ষেত্রে আমরাও এগিয়ে যেতে পারি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ সংগীত, প্রকাশনা ও সফটওয়্যার শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শতাধিক ব্যক্তি এ সেমিনারে অংশ নেন।
< Prev | Next > |
---|